মকদমপুর ... দিশারি ... কোর্টঃ শুভ্র মৈত্র

 

মকদমপুর ... দিশারি ... কোর্ট

শুভ্র মৈত্র 

 

 

এই যে আপনাকে, হ্যাঁ আপনাকেই বলছি, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছে মারুতি গাড়ি। নিয়ে যান, বৌদিকে চমকে দিন মারুতি মারুতি মারুতি”—- উফ, এমন করে বলে না, রাস্তার প্রতিটি মানুষ ঘুরে তাকাবেই। লোভ না জাগিয়ে ছাড়বে না! বাবলু অবশ্য আগেই দেখেছে, কয়েকদিন ধরেই হাঁকডাক শুনছে, “… প্রথম পুরস্কার মারুতি, দ্বিতীয় পুরস্কার হোন্ডা মোটর সাইকেল, তৃতীয় পুরস্কা … ।” আর শুধু কি মাইকের ঘোষণা, রাস্তার উপরে তো খাড়া করেই রেখেছে সব পুরস্কার। চকচকে, নতুন। প্যাসেঞ্জার নিয়ে যাতায়াতের পথে রোজ দেখছে। টিভিটা যত্ত বড়, ওর ঘরেই ঢুকবে না। আসলে আর কিছু না, বাবলু দ্যাখে শুধু ঐ লাল রঙের মোটর সাইকেলটা। রাজার মতো দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়, একদিকে আলগোছে ঘাড় বেঁকিয়ে। টায়ার গুলোও কতো মোটা। উফ, চালাতে যা লাগবে না! ভটভট ভটভট

টোটোর হ্যান্ডেলে হাত রেখে বাবলু ফিরে যায় চেনা ছন্দে, “মকদমপুর, দিশারী, হাসপাতাল, কোর্ট হাঁকতে থাকে। শালা, টোটো এত বেড়েছে রাস্তায়, প্যাসেঞ্জারই হয় না। উঠলেও ভাড়া নিয়ে কাঁইকিচির। ধ্যুস। আর এই গাড়িটাও হয়েছে, স্টার্ট করলেই থরথর করে কাঁপতে থাকে। ব্যাটারি চার্জ দিয়েছিল কাল রাতেও, কিন্তু তবু সকাল থেকে যেন চলার ইচ্ছেটাই নেই। তার উপর রোজ সকালে রাস্তায় যা ভীড়, গাড়ি নিয়ে এগোতে হয় ঠোক্কর খেতে খেতে। 

কোনরকমে এগোতে এগতেই শুনতে পেল, “আর মাত্র কয়েকটা টিকিট। কয়েকজন ভাগ্যবানের জন্য। গাড়ি, বাইক, ফ্রীজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন যে শুনবে তারই লোভ লাগবে। তখনই আরেকবার টানে বাইকটা। ইসস, যদি পেত ওটা? এই ভিড় রাস্তার মধ্যেও একেবেঁকে ঠিক চালিয়ে নিয়ে যেত গাঁ গাঁ করে। সবাই তাকিয়ে দেখতো। 

বাবলুর গাড়িতে একজন বুড়ো মানুষ। একটাই প্যাসেঞ্জার। অনেক চিৎকার করেও আর কাউকে পেল না। এরকম প্যাসেঞ্জারের অবশ্য একটা সুবিধা আছে। তাড়া দেয় না। গ্রাম থেকে এসেছে। টাউনের রাস্তায় এমনিতেই একটু ভয়ে ভয়ে থাকে। দেরির জন্য উশখুস করে না। বাবলু এগোচ্ছে টোটো নিয়ে। থামতে থামতে। এখন যেখানে দাঁড়িয়েছে, তার পাশেই ফুটপাথে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসেছে ক্লাবের ছেলেরা। ভাগ্যপরীক্ষা আর মাত্র দুই দিন পরেই…।”

কত করে টিকিট? — মাইক নিয়ে এতক্ষন ধরে যে কত আদর করে ডাকছিল, এখন যেন শুনতেই পাচ্ছে না, যতটা সম্ভব তাচ্ছিল্য মাখিয়ে জানালো, ‘একশো টাকা 

একশো? সারাদিনে ভাড়া মেরে কত হয়, তার মধ্যে কত টাকা কেটে নেবে মালিক, কত দিতে হয় পাড়ার দাদা, রাস্তার সিভিক পুলিশকে এই টোটো চল চল, আগে বাড় … । গাড়ির পেছনে লাঠির বাড়ি। এগোতে হবে, সম্বিত ফেরে বাবলুর।

বাইকটার দিকে একবার চোরা চোখে তাকিয়ে নিল এগোনর আগে। কাছ থেকে আরও সুন্দর লাগে। লাল রঙটা যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। তার উপরে মাখনের মতো মসৃণ কালো ঢেউ খেলানো সিট। পেছনটা আবার একটু উঁচু হয়ে শেষ হয়েছে। মানে পেছনে যে থাকবে সে একটু উঁচুতে বসবে। উঁচু থেকেই দেখবে, জিন্স পরা পা দুটো দুদিকে, কোঁকড়া চুলগুলো হাওয়ায় উড়বে, বাতাস এসে মুখে ঝাপটা মারবে, টি শার্ট এর নীচে উঁচু বুকদুটো বাবলু’র পিঠে আলতো ধাক্কা মারছে, খিলখিল করে হাসি, আরও জোরে চালাবে বাবলু …

 

—- শশশালা … ! সামনের টোটোটা হঠা ব্রেক মেরেছে, বাবলুও গিয়ে ধাক্কা মেরে দিয়েছিল প্রায়। হুঁশ ফিরতেই খেয়াল হলো, এতক্ষন বাইকটা নিয়েই ভাবছিল, রাস্তায় মন ছিল না। আর ভাবনাটা কখন পাখনা ছড়িয়ে ঐ যে পেছনে বসা মেয়েটায় থিতু হয়েছে, মানে ওদের গলির মুখে বিশ্বাস বাড়ির মেয়েটাকে কখন যে ওর বাইকের পেছনে বসিয়েছে ওর নিজেরই খেয়াল নেই। 

রোজ রাতে টোটোটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে বাড়ি ফেরার সময় বাবলু দ্যাখে, মেয়েটার ঘরে আলো জ্বলছে। ব্যালকনিতে দাঁড়াতেও দেখেছে কতদিন। বাবলু জানে, মেয়েটা ওকে দ্যাখে। কোঁকড়া চুল, ফর্সা, ফোলা গালের মেয়েটা জিন্স পরে। ইংরেজী লেখা টি শার্ট পরে। সকালে নিশ্চয়ই পাঁউরুটি খায়। নাহ, বাবলু কোনোদিন সাহস করে তাকাতে পারে নি, তবে ও জানে, মেয়েটা ওকেই দ্যাখে। 

তাকাবে, বাইকটা নিয়ে যেদিন ঢুকবে, সেদিন তাকাবে। কথাও বলবে। ভয়টা কেটে যাচ্ছে আসতে আসতে। 

“— আর মাত্র দুইদিন, মাত্র কয়েকজন ভাগ্যবান পাবেনপ্রথম পুরষ্কার মারুতি গাড়ি, দ্বিতীয় পুরষ্কার হোন্ডা বাইক, তৃতীয় পুরস্কার  !”

বাবলু সকাল থেকেই আজ আনমনা। প্যাসেঞ্জার ডাকা-হাঁকাতেও মন নেই। সকালে মনস্কামনা মন্দিরে প্রণাম করে এসেছে, একটা মানতও করেছে। আর স্ট্যান্ড থেকে খালি গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে গেল, প্যাসেঞ্জার নেই, খালি। সোজা গিয়ে ঐ টেবিলটার পাশে। তিনবার গুণে গুণে একটা পঞ্চাশ আর পাঁচটা দশ টাকার নোট বের করলো ব্যাগ থেকে। ওকে ভাড়া দেওয়ার সময় অনেক প্যাসেঞ্জার এমন টিপে টিপে দেয়। টিকিটের নম্বর নাকি বাছার কী সব নিয়ম আছে, বাবলু জানে না। নিজের জন্ম তারিখ, জন্মের মাস সব হিসাব টিসাব করে টিকিট কাটতে হয়। ও সেসব হিসাব করলো না। শুধু মনে মনে একবার মনস্কামনা ঠাকুরকে প্রণাম করে নিল। আর আড়চোখে আরেকবার দেখে নিল বাইকটাকে। ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে, ঘাড়টা বেঁকিয়ে, গম্ভীর হয়ে। আজ তাকাতেই ভেসে উঠলো পেছনে বসা বিশ্বাস বাড়ির মেয়েটা, চুল উড়ছে  

সারাদিনের ভাড়া মারার ফাঁকে অনেকবার গ্যাছে ঐ কাউন্টারের সামনে দিয়ে, শুনেছে চিৎকার, প্রথম পুরস্কার মারুতি গাড়ি। রাত পোহালেই খেলা । বারবার দেখতে দেখতে টিকিটের নম্বরটা মুখস্থ হয়ে গেছে। জে সাত শূন্য নয় । কোন সিরিজ থেকে শুরু, মোট কতগুলো টিকিট কিচ্ছু জানে না। ও শুধু জানে ঐ বাইকটা আসবে এই টিকিটেই জে সাত শূন্য নয় পাঁচ 

সন্ধ্যার মুখে এক মাতাল প্যাসেঞ্জার পেয়েছিল আজ। অনেক ঘুরিয়েছে। ভয়ে ভয়ে ছিল বাবলু, নিশ্চয়ই ভাড়া দেবাড় সময় ক্যাঁচাল করবে। শেষমেশ হাইওয়ের পাশে ধাবাতে নামলো যখন, খানিক ভয়ে ভয়েই বাবলু চাইল, ‘পঞ্চাশ। কী আশ্চর্য,একটা দুশো টাকার নোট হাতে ধরিয়ে মাতাল বলল, ‘রেখে দে’! গোটা একটা দুশো টাকার নোট। গেরুয়া রঙের। ভুল করে নয়। বাবলু’র সারাদিনের ইনকামের চেয়েও বেশি। টাকাটা হাতে নেবার সময় কী বলবে বুঝতে পারছিল না, কিন্তু প্রথমেই মনে এলো ঐ বাইকটা হাত ঘুরিয়ে গতি বাড়াচ্ছে পেছনে খোলা চুল হাসি  

 

সন্ধ্যার পরেই বেরোবে বাবলু। এই সারাদিনের টোটোর ঘাম জীবনের শেষে। রাস্তাটাও তখন অনেক মায়াবী হয়, হলুদ হ্যালোজেন আর শপিং মলের নীল নিয়নে সকালের জ্যাম-জটের দুর্গন্ধ কেটে যায়। ঘিনঘিনে শহরটাতেও তখন বকুলের গন্ধ পাওয়া যায়। তখনই বের করবে বাইকটা। বাড়ি থেকে স্টার্ট দিয়ে জানান দেবে সবাইকে। ছুটে এসে পেছনে বসবে ও। তারপর বড় রাস্তা দিয়ে সোজা হাইওয়ে। হু হু করে বাতাস আর ভারি দুটো চাকায় ভর দিয়ে চলে যাবে অনেক দূরে। স্পীডোমিটারের কাঁটা ছোঁবে চল্লিশ ষাট আশি নব্বই । পেছনে ছুঁয়ে থাকবে ও, আর হাসবে খিলখিল করে। ভয় পাবে, তবু হাসবে। আর বাবলু ছাড়িয়ে যাবে শহর। ঐ ঘুপচি ঘর, ভাড়া নিয়ে দড়াদরি, মালিকের মুখ ঝামটা, ট্রাফিক পুলিসের খিস্তি --- সব ছাড়িয়ে যাবে। কেউ ছুঁতে পারবে না। সবাই অনেক পেছন থেকে দেখবে বাইকের পেছনের লাল আলোটা ক্রমে ছোট হয়ে আসছে । হু হু করে ছুটছে বাবলু …। আহ

কাল রাতে খেলা হয়েছে। সন্ধ্যা থেকেই রাস্তা পুরো আটকে হয়েছে লটারি। ভিড় হয়েছিল খুব। নেতা মন্ত্রী এসেছিল মনে হয়, বাবলু দূর থেকে ভালো বুঝতে পারে নি। গান বাজনা ভাষন চলছে, আর মাঝে মাঝে লটারি। বাবলু জানে সান্ত্বনা পুরষ্কার থেকে শুরু করে, আসলগুলো আসতে মেলাই রাত। ও থাকে নি। চলে এসেছে ঘরে। গলির মুখে ঐ বড় নিঝুম বাড়িটা। একটা ঘরে কী আলো জ্বলছিল তখনও? কী জানি। 

সকালটা হলো আর পাঁচদিনের মতোই। কলের লাইনে জল নিয়ে ঝগড়া, এঁটো বাসনের নড়াচরা, মায়ের কাশির শব্দ, রাতের বাসি রুটি দিয়ে জলখাবার, তারপর রোজকার মতো টোটোর চাবি নিয়ে বেরনো। 

কাল রাতের লটারির গল্পই চলছে এখন স্ট্যান্ডে। নাহ, স্ট্যান্ডের কোনও টোটোওয়ালার ভাগ্যে কিছু জোটার প্রশ্ন নেই। টিকিটই বোধহয় নেয় নি কেউ। তবু যে গাড়িটা যে পেয়েছে সে কত চেনা লোক, ‘ফ্রীজটা তো পেল মহেশমাটির সুকু !’—এসব চর্চাতেই ব্যস্ত। টিকিটের নম্বর দিয়ে রেজাল্ট টাঙিয়ে দিয়েছে ক্লাবের সামনে। বাইকটা কে পেল কে জানে, কালকে তো কেউ আসেনি’, ভজার গলা শুনতে পেল। বাবলু দেখতে পাচ্ছে ঐ লাল রঙের বাইকটা। একদিকে ঘাড় কাৎ করা। 

‘‘মিলাবি না টিকিট? যাবি না?’’— বুধন জানে বাবলু টিকিট কেটেছিল। 

নাহ, বাবলু টোটো অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়, নিস্পৃহ মুখে ডাকতে থাকল, ‘মকদমপুর, দিশারী, হাসপাতাল, কোর্ট …।” দিনেরবেলার টাউনের রাস্তায় ভিড় ক্রমশ বাড়ছে, গরমও। এর মধ্যেও বাবলু’র কানে এলো ভটভট ভটভট । পেছনে খোলা চুল, হাসি

 

 

 মূল পাতায় যান

 

 

                                                                  

 

Comments

Popular posts from this blog

সূচীপত্রঃ শারদ সান্ধ্য জলপাইগুড়ি

বাজারি গপ্পোঃ নিঝুম ঠাকুর