বাঁচা মরার মাঝখানেঃ পুরঞ্জয় ভৌমিক

বাঁচা মরার মাঝখানে

পুরঞ্জয় ভৌমিক

 

তারপর বুঁচির শীর্ণ হাতটা ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ল। 

চোখের কোলে উঁচু হনুর আড়ালে এক ফোঁটা, বা দু'ফোঁটাও হতে পারে, জল টলটল করেছিল কি না সেটা এখন আর স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না, কারণ ওই সময়ে ওর চোখের কাছে কারও উপস্থিতির প্রমাণ তেমন পাওয়া যায়নি। তবে বিস্মিত এবং কিছুটা অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে মাধবী হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছিল যে, বুঁচি আর বেঁচে নেই। হয় তো এটাকেও প্রমাণ মানা যেতে পারে যে, মাধবীর নাতনিটা ‘দিদা’ বলে চিৎকার করে মাধবীকে জড়িয়ে ধরেছিল ! তবে পাঁচ বছরের মেয়ের প্রথম মৃত্যু দর্শনের আতঙ্ক যদি নেহাত তেমন বিশ্বাসযোগ্য  নাও হয়, যেহেতু সে আগে কোনো মৃত্যু দেখেনি, তাই জীবন-মৃত্যুর পার্থক্য তার চিৎকারে বিশ্বাসযোগ্যতা না পেতে পারে, তাহলেও কিন্তু  বুঁচির নিজেরই পিসির ‘মা'রে’ বলে কেঁদে ওঠা আর ‘সারাটা জীবন কষ্ট পেয়ে গেলি মা’ --- এই স্বগত বিলাপ বুঁচির মৃত্যুর একমাত্র অমোঘ প্রমাণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল।

বুঁচির পিসির কেঁদে ওঠার  সুরটা যখন নানা মূর্চ্ছনায় ভেঙ্গে পড়ছিল তখনই কনক ঘরে ঢুকেছিল। প্রায় সাতাশ বছর পরের এই আকস্মিক সাক্ষাত যা তার মা মাধবীর এ বাড়িতে আসার পরিকল্পনাতে ছিল না, তা যে এতটা নাটকীয় হতে পারে কনক ভাবে নি। তাই একহাতে মেয়েকে ঝটিতে কোলে তুলে আর এক হাতে মাধবীর হাত ধরে পেছনে টেনে আনতে আনতে কনক হয় তো এই আকস্মিক সমাপতন থেকে নিজেদের বিযুক্ত করতে চাইছিল বা এটাই বোঝাতে চাইছিল যে, বুঁচির মুত্যুর এই বাস্তবের সঙ্গে তাদের এ বাড়িতে আসা ও বুঁচির সাক্ষাৎ এগুলো যেহেতু কোনোটাই পূর্ব নির্দিষ্ট ছিল না, তাই সম্পর্করহিত। কিন্তু ততক্ষণে শিপ্রাবৌদি প্রায় দৌড়েই ঘরে ঢুকে পড়েছিল। ওই একই গতিতে বুঁচির মাথাটা ধরে ঝাঁকিয়ে বুঝতে চাইছিল মাধবীর নাতনীর প্রথম মৃত্যু দর্শনের আতঙ্ক ও তার চিৎকার আর বুঁচির পিসির বিলাপের সুর এই দুইয়েরই কারণ একটিই  সত্য কি না  যে, বুঁচি আর নেই। আর তখন সম্ভবত শিপ্রাবৌদি ওর মাথাটা ঝাঁকিয়ে দেওয়ার ফলে বুঁচির চোখের কোল আর উঁচু হনুতে আটকে থাকা একফোঁটা বা দু-ফোঁটা জল বুঁচির গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে থাকতে পারে।

এরপর শুধু পড়ার ছেলেদের খবর দেওয়াই বাকি থাকে। তারপর বাকি সবকিছু গতানুগতিক যেমন হওয়ার কথা ছিল তেমনই হয়েছিল। ডেথ সার্টিফিকেট, লোকজন, বাঁশের খাটিয়া ইত্যাদি। শুধু বুঁচি যেহেতু বিবাহিত ছিল এবং ওর স্বামীও জীবিত তাই মাথায় কেউ কেউ সিঁদুর লেপে দিয়েছিল। বুঁচির পিসি যদিও বিলাপের সুরে বলেই চলেছিল, ‘ওরে ওই সিঁদুরের আর কি কিছু দাম আছে রে, ও তো বুঁচির জীবনেই মরণের স্বাদ দিয়েছে রে...।’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আলতা দিয়ে পায়ের ছাপ কেউ নেয়নি। শিপ্রা হৈমন্তিকে জিজ্ঞেস করেছিল। হৈমন্তি রাজি হয়নি। হৈমন্তী, কনক একই বয়সী প্রায়। এই প্রথম দেখায় একটু বন্ধুত্ব হতে পারত কিন্ত হল না। কারণ এই ছাব্বিশে পৌঁছেও পারলারের সামান্য রোজগারে মা'কে নিয়ে থাকার যে হীনমন্যতা তা আরও বেড়ে গিয়েছিল হৈমন্তির প্রথম আলাপের মাধবীমাসি আর কনকের ঠিকরে পড়া ঔজ্জল্যে। হৈমন্তি বুঝতে পারছিল কনক এই মৃত্যু থেকে  বিযুক্ত হতে চাইছে। তাই হৈমন্তি যে এ সব কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইছে কারণ মাধবী তার মেয়ে-নাতনী নিয়ে এক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিতে আটকে গেছে আর তার লজ্জা হৈমন্তিকে গ্রাস করছে সেটা শিপ্রামামি বুঝে যাচ্ছিল তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায়। এই আচার যত দীর্ঘায়িত হবে ততই বুঁচির জীবনের সে দিকগুলো নিয়ে আলোচনা বাড়তে থাকবে যা হৈমন্তিকে কনকের চোখে আরও হীন করে তুলবে তাই শিপ্রামামি একটু জোরের সঙ্গেই ছেলেদের বলেছিল, ‘তোরা এবার এগিয়ে যা।’ আর বুঁচির দূর সম্পর্কের এক দাদাকে বলেছিল, ‘হীরেন হিমুর খেয়াল রাখিস।’ হৈমন্তিকে শশ্মানে যেতেই হয়েছিল মুখাগ্নি করতে। বুঁচির আত্মীয়স্বজনের জোর ছিল না। শিপ্রার বাড়ীরই পেছনের একটা ঘরে মেয়ে নিয়ে থাকত। তাই বুঁচিকে নিয়ে যাওয়ার পর ঘরবাড়ি ধীরে ধীরে খালিই হয়ে গেল। শুধু কনক মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল মাধবীর সাথে। মাধবীই প্রথম বলল, ‘তাহলে বৌদি আমরাও এগোই। এমন দিনেই দেখা হলো যে...।’

এর উত্তরে শিপ্রার বিশেষ কিছু বলার ছিল না। মাধবীর উপস্থিতি যে অসুস্থ মরণাপন্ন বুঁচিকে আচমকা শ্যামলের কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছে, আর সাতাশ বছর আগের বুঁচির বাসর রাতের অপমান থেকে মুক্তি দিয়েছে একথা শিপ্রা আর মাধবী ছাড়া কেউ জানে না। এখন তারা নিজেদের বন্ধু ভাবতে পারে , প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে বা বুঁচির মুক্তির কারন হতে পারে। তাই ওদের নিজেদের মধ্যে কোনো কথোপকথনের হয়তো দরকার ছিল। কিন্ত তেমন কিছুই হলো না। শিপ্রার উত্তরহীন চেয়ে থাকা, নাতনীর ক্রমাগত ক্রন্দন আর কনকের চলে যাওয়ার উদগ্র ইচ্ছা এসব কিছুর মধ্যেই মাধবীও ধীরে ধীরে বাড়ির বাইরে চলে গেল।

 

শ্যামলকে বুঁচির প্রথম ভালো লাগে যেদিন পাড়ার ফুটবল টুর্নামেন্টে জিতে ক্লাবের ছেলেরা কাঁধে করে শ্যামলকে নিয়ে পাড়ায় ঢুকল। ঘামে ভেজা জার্সিতে একটু কাদামাটি লেগে আর একমাথা অবিন্যস্ত চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দু'হাত হাতে ধরে থাকা শিল্ড, সন্ধের মুখে বাজি পটকার রোশনাইয়ে সে এক অপার্থিব দৃশ্য। বুঁচির কিছু করার ছিল না। অথচ শ্যামলদা এ পাড়ার ছেলে না, মামার বাড়ী সূত্রে যাতায়াত আর ক্লাবের বাঁধা সেন্টার ফরোয়ার্ড।

দ্বিতীয়বার ভালো লেগে গেল দশমীর ভাসানের দিন যখন ট্রাফিক সার্জেন্টের সঙ্গে ইংরাজিতে ঝগড়া করে  শ্যামল ক্লাবের প্রতিমার রাস্তা করে দিল। কে যেন বললো , হবে নাই বা কেন। বনেদী বাড়ির ছেলে, তার ওপর ইংলিশ মিডিয়াম। শ্যামল কাউকে ডরায় না।

আর সেবারেই বিজয়া সম্মীলনীতে ক্লাবের ফাংশানে বুঁচি শ্যামলকে  অর্কেস্ট্রার সঙ্গে বেহালা বাজাতে দেখলো।  বুঁচি দেখছিল যিনি গাইছেন তিনি তিনি বাঁয়ে শ্যামলের দিকে মুখ ফিরিয়ে চাইলেন। তাঁর ওই মুখ ফেরানো না ফেরানোর মাঝামাঝিতেই শ্যামল তার বেহালায় সুর তুললো। গায়ক তখন চুপ করে। শ্যামলের সুর যখন হালকা হয়ে এসেছে বুঁচি শুনতে পাচ্ছিল তবলার আওয়াজ জোরে হয়ে উঠছে,  শ্যামল সুর ধরেই আছে। তারপর তবলা কমে এলে, বেহালা আবার জোরে হয়ে এক জায়গাতে প্রায় থেমে যেতে গায়ক আবার গানটা ধরে নিলেন। তারপর গায়ক, তবলিয়া আর শ্যামল তিন জনের মুখেই একই রকম বাহবার হাসি ফুটে উঠল। বুঁচি তো গান জানে না। সুর চেনে না। তবু ওই সঙ্গীতে অশিক্ষিত কানে এ সব শুনে ও নিজের চোখে মঞ্চের ওই কথোপকথন দেখে বুঁচি জেনে গেল যে সুরেও কথা বলা যায়। সব কথা হয়তো বা মুখে হয় না।

অঘ্রাণের শুরুতে সন্ধ্যায় হাল্কা হিম পড়ত তখন। স্টেজে গোলাপী আলো , পেছনে ভাইফোঁটার পর পঞ্চমীর বাঁকা চাঁদ হিম কুয়াশায় আবছা হয়ে ঝুলে আছে , আর ওই ছড়ের টান এই তিনের মায়াবী মুহূর্তে বুঁচি প্রথমবারের জন্য বুঝতে পারছিল শ্যামলদাই তার সেই জন যার জন্য বাথরুমে কাপড় ছাড়তেও তার লজ্জা করবে। আয়নার সামনে টিপ পড়ার সময় তার আবছা উপস্থিতি টের পাবে। প্রথমবারের জন্য তার টিপ  বেঁকে যাবে। আর পুকুরের ওপারের শিপ্রাবৌদি সেটা ধরিয়ে দিলে বুঁচি কারনহীন একটু আরক্ত হবে হয় তো। 

এ রকমই একটা সময়ে পিসীর বাড়ির একতলার সিঁড়ির নীচে শ্যামল হঠাৎই দু আঙ্গুলে বুঁচির নাকটা চেপে ধরে বলেছিল, ‘এত সুন্দর নাক। তোর নাম বুঁচি কে দিলো রে? ’

সেদিন বুঁচিও একটু সাহসী হয়ে গেল। হাতের পাতাটা ঘুরিয়ে তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে চোখটা রেখে বলেছিল, ‘ইস্ আমার নাম সুনয়না।’

‘তাহলে বুঁচি?’

‘কি জানি?’  যতটা সুন্দর মুখভঙ্গী করা যায় ততটাই করতে করতে বুঁচি বলেছিল। ‘পিসী বলেছে জন্মের পর নাকি নাক চ্যাপ্টা ছিল আমার। পরে ঠিক হয়ে গেল....।’ বুঁচি আরও কিছু বলত হয় তো কিন্তু ওপর তলা থেকে ওর সেই দূর সম্পর্কের পিসী, যে কিনা শ্যামলদার দূর সম্পর্কের মামী, ডেকে ফেলেছিল,  ‘বুঁচি, নারকেলটা কুরে দিয়ে যা মা, কখন থেকে বলছি।’

এই পিসীর কথা বুঁচি কখনোই ফেলতে পারে না। দুনিয়াতে  স্নেহ কি জিনিস বুঁচি হয়তো জানতেই পারত না পিসী না থাকলে। বাকিরা তো মা বাপ খাওয়া বুঁচিকে কবেই খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছিল। পিসীর বাড়ির ফাই ফরমাস খাটা আর পিসীর জায়েদের কলেজে ওঠা মেয়েদের নীচু নজরে কেটে যাওয়া এই যে অকিঞ্চিতকর জীবন সেখানে পিসীর শ্বশুরবাড়ির চোখ এড়ানো একটু প্রশ্রয়,  একটু ভালোবাসা বুঁচিকে কখনো কখনো বেঁচে থাকার একটু আনন্দ দিত। কিন্তু শ্যামলদা এ সবটা অনুভূতিকেই কেমন রঙ্গীন, লজ্জারুণ আর ব্যক্তিগত করে দিল। এতটাই রঙ্গীন যে বুঁচি পুকুরপারের শিপ্রাবৌদির বাড়িতে যেতে হলেও মাঝে মাঝে ঠোঁটে একটু রঙ দিয়ে ফেলত।  

এতটাই লজ্জারুণ যে স্নানের পর আয়নার সামনে মুখ মুছতে মুছতে নিজের দিকে চোখ পড়লে গাল দুটো কেমন লালচে মনে হত । এতটাই ব্যক্তিগত যে যখন তুতো দিদিরা কলেজের পড়া করতে করতে বুঁচিকে চা করতে বলত বা স্নানের পর কাচা কাপড় মেলে দিতে বলত তখন বুঁচি আর আগের মত অনুভূতিহীন এগুলো করতে পারত না। শ্যামলদার কথা মনে পড়ত। আর হঠাৎ কেন যেন চোখ ভিজে উঠত।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে যেতে বুঁচি শুনতে পেল শ্যামলদা একটু চাপা গলায় অথচ বুঁচি শুনতে পায় এমন ভাবে বলছে, ‘বিকেলে বিমলদার দোকানের পেছনে একটু আসিস।’

সেদিন নারকেল কোরাতে গিয়ে বুঁচির হাত কাটেনি।

পিসীর ওপর ভাসুর-দেওরদের , জায়েদের, এমন কি পিসীর বুড়ি শাশুড়ির চাপ বাড়ছিল বুঁচির সঙ্গে শ্যামলের এতটা মাখামাখি নিয়ে। যেদিন রাতে পিসী বুঁচিকে বুঝিয়ে বলবে বলে স্থির করেছিল, সবাইকে অবাক করে সেদিন বিকেলে শ্যামলের মা-ই এ বাড়িতে বুঁচির সঙ্গে শ্যামলের সম্বন্ধের প্রস্তাব নিয়ে এলেন। বনেদি বাড়ি। বাবা নেই। একই ছেলে। রোজগারের চাপও নেই। বিভিন্ন যন্ত্র বাজাতে পারে, শখ বলতে এটুকুই। সে সময়ে অনেক বড় বড় আর্টিস্টের সঙ্গে স্টেজে বাজাতে উঠত শ্যামল। বোম্বে থেকে ডাক এসেছিল বার দুয়েক। বুঁচির যে এতটা ভাগ্য হবে তা কেউ ভাবেনি। সেদিন শিপ্রাবৌদি বুঁচিকে সাজিয়ে দিল। আর তুতো দিদিরা খুব করে আদর করে দিল। নিজেদের পাউডার সেন্ট লিপস্টিক বের করে দিল। হবু শাশুড়ির সামনে বসে বুঁচি ঘরের মেঝের  থেকে দৃষ্টিই তুলল না। শ্যামলের মা ছেলের জেদ জানতেন এবং পিসীর বাড়িতে বুঁচির অবস্থানও। ঠিক হল শ্যামলদের পাড়াতেই শ্যামলের বাবার এক বনেদি বন্ধুর বাড়িতে বিয়ে হবে। পরদিন বৌ তার পাশেই শ্বশুরবাড়ি আসবে। 

তৃতীয় দিনে বৌভাত , ওইদিন আসল লোক নিমন্ত্রণের অনুষ্ঠান। সবটাই বুঁচির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা করবে। পিসী সে রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পেরেছিল এত সহজে বুঁচির বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায়।

বিয়ের দুদিন আগে বুঁচিকে ওরা শ্যামলের বাবার বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে গেল। ওখানেই ওই মেশোমশাই-এর মেয়ে মাধবীর সঙ্গে বুঁচির প্রথম আলাপ। দু'রাত মাধু বুঁচির সাথে শুলো। দ্বিতীয় রাতে ওদের আলাপ যখন প্রায় বন্ধুত্বে পৌঁছেছে তখন মাধু বুঁচিকে জাপটে ধরে বলেছিল, ‘অ্যাই মেয়ে শ্যামলদাকে কি করে পটালি রে? কি নাক উঁচু লোক রে বাবা, কারো দিকে তাকায়-ই না।’

বুঁচি ভেতরের অহঙ্কারটা প্রাণপণ চেপে রাখতে রাখতে একটু লজ্জার ভাব করে বলেছিল, ‘ধ্যাত।’ তারপর একটু বাজিয়ে দেখার  জন্য বলেছিল, ‘কেন গো, লোভ ছিল না কি তোমার’ মাধু বাঁধনটা একটু আলগা করে অন্যমনস্ক সুরে উত্তর করেছিল, ‘না রে। আমার তো অশোকই আছে। আজ বিকেলে দেখলি না প্যান্ডেলের তদারক করছে।’ তারপর একটু শ্বাস ছেড়ে বলেছিল, ‘এই ব্যবসা করে তো, তাই বাড়ির কেউ পছন্দ করে না ওকে। আচ্ছা বল, মানুষ তো কোথাও থেকে শুরু করবে। সবার তো আর বাপের রেখে যাওয়া টাকা থাকে না।’ শেষ মাঘের শীতে লেপের ওম নিতে নিতে ওই অন্ধকারেই বুঁচি মাধুর মুখটা দেখার চেষ্টা করছিল। বুঝতে চাইছিল মাধুর কথায় কতটা শ্লেষ আছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকে পরের সংসারে একটু উপেক্ষায়,  অবহেলায় বড় হতে হতে এই আকস্মিক ভাগ্যের সন্ধিক্ষণে হয়তো বুঁচির আত্মরক্ষা ওকে এ কথোপকথনে চুপ করে থাকাই শিখিয়েছিল। মাধবী আবার জড়িয়ে ধরে ওর কানের কাছে হিসিয়ে উঠেছিল, ‘জানিস তো এদের বাসর রাতে বর-বউ ছাড়া কারো থাকার নিয়ম নেই। বাসরে শুধু তুই আর শ্যামলদা, আর কেউ থাকবে না। শোন মেয়ে কালকে সাজিয়ে দেব সুন্দর করে। সকালে উঠে আমাকে কিন্তু বলতে হবে আদর টাদর কেমন হলো।’ ওর জীবনভর অনাদর বাসর রাতের আদরে কেমন করে বদলে যাবে তার কোনো প্রস্তুতি  বুঁচিকে কেউ বলে দেয় নি। শিপ্রাবৌদি শুধু বলেছিল, ‘যা বলবে শুনবি। সরে যাবি না।’ এ গূঢ় ভাষ্যের অর্থ বলে দেওয়ার মত বন্ধু বুঁচির ছিল না। তাই বুঁচি মাধবীর দাবী আর শিপ্রাবৌদির আপ্তবাক্য এই দুইয়ের মাঝে অসহায়ের মত শুধু বলতে পেরেছিল, ‘আচ্ছা।’

পরদিন বুঁচির বিয়ে হয়ে গেল। পিসীর বড় ভাসুর সম্প্রদান করলেন। তুতো দিদিরা বিয়ের পুরোটা সময় বুঁচির পাশে পাশে থাকল। স্ত্রী আচারের সময় শ্যামলের পেছনে লাগতেও ছাড়ল না। শিপ্রাবৌদি একটু বেশিই চুপচাপ ছিল। রাতে চলে যাওয়ার আগে বুঁচির মাথায় হাত দিয়ে বলে গেল, ’সব দিক সামলে চলিস। কাল সকালে আসব আবার।’ শুধু মাধবীকে সন্ধের পর থেকে দেখা গেল না। 

অনেক রাতে, বাসরে তখনও শ্যামল ঢোকেনি, দোতলায় একটা শোরগোল উঠেছিল। বাড়ির পুরুষেরা উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিল। কেউ বেরিয়ে গেল। কেউ দোতলায় দৌড়ল। কেউ বলল, পুলিশে খবর দাও। কেউ বলল, লাভ নেই দুজনেই অ্যাডাল্ট। মেয়েরা বাসর ছেড়ে কথা বলতে বলতে চলে গেল। একা বুঁচি ওই বিশাল কড়ি বরগা দেওয়া নিঝুম বাসরে অমঙ্গল আশঙ্কায় ভয়ে হিম হয়ে বসে ছিল। শেষে শ্যামলের মা বাসরে এসে বুঁচিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সুনয়না , কাল রাতে বা আজ সাজানোর সময় মাধু কি তোমাকে কিছু বলেছিল?’ বুঁচি ওর অনুমানে বুঝে যাচ্ছিল কাল রাতে মাধবীর কৌতুহল এই নতুন মা জানতে চাইছেন না। তাই শাশুড়ি যখন বললেন, ‘মাধুকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওই প্যান্ডেলের ছেলেটার সঙ্গে পালিয়েছে। তুমি কি কিছু জানো?  মাধু তোমাকে বলেছিল?’ ---  তখন বুঁচি শ্যামলের মার মুখভঙ্গী,  কথা বলার ধরন হাতের বিভঙ্গ ইত্যাদি দেখে পরিষ্কার আন্দাজ পাচ্ছিল যে ওর শ্বশুরবাড়ির সবাই প্রায় ধরেই নিয়েছে যে, মাধবী এ কাজ সুনয়নার বুদ্ধিতে করেছে।  নইলে এত বড় বনেদি পাড়ায় যা আগে হয় নি তা এই কুলহীন মেয়েটা বউ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘটল কি করে! শেষ মাঘের ঠান্ডাটা বুঁচিকে আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছিল। বুঁচি জানত না অসত্য অস্বীকারের ভাষা কি। তার তো শুধু শ্যামলদার অপেক্ষা। যে পুরুষ ট্রাফিক সার্জেন্টের সঙ্গে ইংরাজিতে ঝগড়া করতে পারে, যার বাঁ পায়ের শট বিপক্ষের গোলকিপার ভয় পায়, যে হাজার দর্শকের সামনে স্টেজে বেহালার ছড়ে ঝড় তোলে, তার সেই নিজস্ব পুরুষ বাসরে এ অন্যায় সন্দেহের প্রতিরক্ষা হবে এমনটাই সে রাতে বুঁচি ভেবেছিল।

শ্যামল এলো আরও রাতে। দরজাটা বন্ধ করে দিতে ওপর তলা থেকে মাধবীর মা'র কান্নার মৃদু আওয়াজ আবছা হতে হতে মুছে গেল। শ্যামল কোনো ভনিতা না করে, শাশুড়ির মার্জিত বনেদিয়ানার বাস্পাচ্ছন্নতা না রেখে বুঁচির কাঁধ ধরে স্পষ্ট প্রশ্ন করেছিল, ‘কোথায় গেছে মাধু? অশোকের বাড়িতে তো নেই।’ বুঁচির ব্যাথা লাগছিল। ‘জানি না’ এ সহজ উত্তর ছাড়া তার আর কিছু বলার ছিল না। কিন্তু শ্যামল কাঁধ ধরে এত জোরে ঝাঁকাচ্ছিল যে ওটুকুও গলার কাছে আটকে যাচ্ছিল। শ্যামল হাঁফাচ্ছিল, ‘জেঠামনিরা, কাকুমনিরা না করেছিল, আমি শুনিনি। প্রথম দিনেই সম্মানটা খেলি আমার।’ বুঁচির সমস্ত কথা, সমস্ত প্রতিরোধ, সমস্ত আত্মরক্ষা তখন থেমে গেছে। কিন্তু শ্যামল থামেনি। তারপর ... অনেকদিন পরে তখন বুঁচি পাকাপাকি ভাবে শিপ্রাবৌদির বাড়ির পেছনের টিনের ঘরটায় হৈমন্তিকে নিয়ে উঠে এসেছে । কখনো সেলাইয়ের অর্ডার সাপ্লাই করে, কখনো ব্যাপার বাড়ির রান্নার কাজ করে, কখনো যাত্রা দলের একস্ট্রা হয়ে, বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, শিপ্রাবৌদিকে এক ভরা বর্ষার সন্ধ্যায় বুঁচি বলেছিল ওর নষ্ট দাম্পত্যের প্রথম অসম্মানের কথা। বলেছিল ডান কানের তলায় সে বিস্ফোরণের কথা। প্রথমবারের মত প্রসাধনে রাঙিয়ে ওঠা ওর গালে শ্যামলের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে যাওয়ার কথা। বলেছিল তখন, যখন বুঁচি বা ওর শিপ্রাবৌদি জানত না যে বুঁচির ভেতরে বিষাক্ত কর্কট তার মারণক্ষমতা ছড়িয়ে দিচ্ছে শরীরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। 

শেষ রাতে শ্যামল ওকে শরীরের তলায় পিষে দিতে দিতে ঘরঘর করছিল, ‘শুধু বলে দে মাধু কোথায়। চুলের মুঠি ধরে নিয়ে আসব।’  সামান্য ডেকরেটর ব্যাবসাদারের সঙ্গে মাধবীর নিষ্ক্রমণের ঔদ্ধত্য এ বাড়ির গর্বিত বনেদিয়ানার পৌরুষকে যে আঘাত দিয়েছিল, তার দায় কে নেবে বুঁচি ছাড়া ! 

শ্যামলের সম্ভোগে বুঁচির যোনির লাঞ্ছিত মন্থন বুঁচির মেয়ে থেকে নারী হয়ে ওঠার অমোঘ সাক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছিল। ওই প্রবল রমণে তলপেটে একরাশ ব্যাথা সহ্য করতে করতে নারীত্বের প্রখর বোধে বুঁচি ওর দাম্পত্যের পরিণতি বোধহয় বুঝতে পেরে গেল।  এবং এ অসহ যন্ত্রনা বুঁচিকে ভালোবাসা নামক এক যৌবন বাধ্যতার অনাবশ্যক দাম্পত্যশর্ত থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি দিচ্ছিল, কারণ বুঁচি তার রক্তাক্ত অবশ প্রবেশপথে, তার বস্তিদেশে,  তার জঙ্ঘায় শ্যামলের উদ্ধত ঘর্ষণে বুঝে নিচ্ছিল যে, তার শ্যামলদার আর পুরুষ হওয়া হলো না। এসবই হচ্ছিল যখন শত শত আলোকবর্ষ দূরে তারাদের নিভে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে, শেষ রাতের রাস্তা কাঁপিয়ে দু একটা ট্যাক্সি চলে যাচ্ছে হাওড়ার দিকে, বুঁচির পাড়ার পুকুরের এপারের পিসী আর ওপারের শিপ্রাবৌদি রাতের শেষ ঘুমেও বুঁচির মঙ্গল- অমঙ্গল চিন্তায় চোখ মেলে জেগে,  একশো বছরের পুরনো বাসর ঘরের কোনায় কোনায় পোকা মাকড়রাও ঘুমিয়ে পড়েছে। বুঁচি গোঙাচ্ছিল অসহ্য যন্ত্রণায় , শ্যামল গোঙাচ্ছিল বনেদিয়ানার আহত পৌরুষে।

এরপর বুঁচির শ্বশুরবাড়ি আগমন, কালরাত্রি বাস, বৌভাতের অনুষ্ঠান সব হয়েছিল নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে। মাসখানেক পর শ্যামল বম্বে গেল। ফিরে এলো চার মাস পার করে। ততদিনে নষ্ট বাসরের ধ্বস্ত সম্ভোগে বুঁচির শরীরে গর্ভসঞ্চারের লক্ষণ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

হৈমন্তি এলো অঘ্রাণে, শ্বশুরবাড়িতে। শাশুড়ি খুশি হতে হতেও হতে পারলেন না। ততদিনে মাধবীর পালিয়ে যাওয়ার স্মৃতি সময়ের সাথে সয়ে এসেছে। বুঁচির গর্ভ যদি ছেলের জন্ম দিত, তাহলে বুঁচির এ বাড়ির ওপর কিছুটা অধিকার হয়তো জন্মাত। শাশুড়ি খুশি হওয়ার ভাব করলেন, শ্যামল মেয়ের মুখ দেখে কেন যেন বুঁচির মাথায় হাত দিয়ে বললো, ‘দুঃখ কোরো না। ভাগ্যে থাকলে ছেলে হবে খন।’  শিপ্রাবৌদি অনেক কাঁথা করেছিল। তা নাকি জন্মের আগে বলতে নেই। এ বাড়িতে মেয়েদের অন্নপ্রাশন হতে নেই। সাত মাস পরে মেয়েকে প্রথম ভাত খাওয়ানোর সময় শিপ্রাবৌদি ফিসফিস করে বলেছিল, ‘যদি পারিস। এরা রাজি  হয় তো নাম রাখিস হৈমন্তি। তোর পিসীরও পছন্দ।’

হৈমন্তি বড় হচ্ছিল নিজের নিয়মেই। শ্যামলের তখন খুব ব্যস্ততা। মাঝে একবার দুবার বুঁচির হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলত, ‘রেখে দাও।’  বুঁচি রেখে দিত। বাচ্চার কান্নায় শ্যামের ঘুম নষ্ট হবে তাই সে ক'দিন শ্যামল অন্য ঘরে শুত। 

এদের পরপর বড় বড় পুরনো বাড়িতে দশ- পনেরো শরিকের বসবাস। এতবড় বনেদি বাড়িতে বুঁচির ভাব জমানর সখী কোথায়, যখন এ কথা জানাই আছে এ মেয়ে পুরুষ ফুঁসলে বড় ঘরে এসেছে আর এরই ফোঁসলানিতে বড় ঘরের মেয়ে ঘর ছেড়েছে। শিপ্রাবৌদি পিসীকে নিয়ে কয়েকবার এসেছিল। তারপর ওদের আসাও কমে গেল। প্রথম ভাদ্রমাসে শিপ্রাবৌদি আর পিসী  বুঁচিকে নিয়ে যেতে চাইল। ওইমাসে নাকি শাশুড়ির ব্যাটার বউয়ের পা দেখতে নেই। 

বুঁচির তখন ভরা গর্ভ।  শাশুড়ি বললেন, ‘থাক না বেয়ান। এত বড় বাড়ি মুখ দেখারই জো নেই তো পা দেখব কখন। শুনেছি আপনার বাড়িতে ঘরের অভাব। আর বাপের বাড়ি বলতে তো কিছু নেই তেমন ! বলুন!’  এ শীতল ঔদ্ধত্য শত বছরের জমিদারি শাসনের রক্ত সঞ্জাত। গেঞ্জীমিলে কাজ করা লোকের নিঃসন্তান বউ এর সাথে যুঝবে কি করে। পিসীর ব্যাগের ভেতরের মিষ্টির প্যাকেট ব্যাগেই রয়ে গেল।

সেভেন পাশ বুঁচি হৈমন্তিকে তিন চার বছর বয়স থেকেই অক্ষর চেনানর চেষ্টা করছিল। ভেতর ভেতর সাহস তৈরী করছিল যে, এবার শ্যামল এলে ওকে বলবে যে, হৈমন্তিকে অন্তত পাড়ার নার্সারি হলেও ভর্তি করে দিতে। এমনই একটা দিনে হৈমন্তি অম্বুবাচীতে শাশুড়ির হবিষ্যিতে হাত দিয়ে ফেলেছিল। শাশুড়ি আবারও মনে করিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘এ সব সহবত গুলোও পড়ার সাথে শেখাও সুনয়না।’ তারপর আদর করার ছলে হৈমন্তির গাল টিপে বললেন, ‘বড় বাড়ির মেয়ে তুমি। এ সব তো শিখতে হবে মা।’

এমন ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল বুঁচির, যেমন করে ঘরের কোনা পোকামাকড়ের নিশ্চিন্ত আশ্রয় হয়, বাল্বের হলুদ আলোর পাশ দিয়ে টিকটিকি হেঁটে যায়, তারপর হারিয়ে যায় জানলার খরখরির ফাঁকে, বিশাল শোবার ঘরের খাটের তলা থেকে হঠাৎ খোলা মেঝে পেয়ে ইঁদুর যেমন অপ্রস্তুত দৌড়ে খুঁজে নেয় অন্ধকার গর্তের সন্ধান , তেমনি করেই নিজের প্রয়োজনের ব্যস্ততায়, আর সবার অপ্রয়োজনের উপেক্ষায়। তারপর একদিন , সেদিনও খুব শীত ছিল, শরিকদেরই একজনের বাড়ি জন্মদিনের নিমন্ত্রণ ছিল, শাশুড়ি নিজের আলমারির একটা ভালো কাপড় পড়তে দিয়েছেন বুঁচিকে, যেমনটা উনি যে কোনও অনুষ্ঠান বাড়ি যাওয়ার আগে বুঁচিকে পড়তে দিতেন কারণ বুঁচির পিসীর বাড়ির থেকে পাওয়া কাপড়ের যা ছিরি তা পড়ে কোনো ভদ্রবাড়ি যাওয়া যায় না, শ্যামল কাবেরীকে নিয়ে বাড়িতে এলো। পরিচয় করিয়ে দিলো। কাবেরী উঠতি গায়িকা। সামনের মাসে বম্বে যাবে শ্যামলের সঙ্গে। ওরা প্রণাম করল একসাথে। শাশুড়ি চিবুক ছুঁয়ে বললেন, ‘দীর্ঘজীবি হও মা।’ 

এতদিন পরে, সেই  কবে শ্যামলের সঙ্গে প্রথম সিনেমা যাওয়া আর অন্ধকার সিনেমাহলে শ্যামলের অবাধ্য হাতের অজানা শিহরনে নিজের বড় হয়ে ওঠার সুখ খোঁজার পরে, সেইদিন বুঁচির  প্রথমবারের জন্য আবার নিজেকে মানুষ বলে মনে হলো। সেইদিন বোধহয় বুঁচি তার এতদিনের যাপনের অভিজ্ঞতায়, তার নারীত্বের অস্তিত্ববোধে বুঝতে পারছিল যে, সিদ্ধান্তের অধিকার অর্থ শিক্ষা বনেদিয়ানা নির্ভর নয়। আর সেইদিনই সে হাতের ব্যাগে পিসীর বাড়ি থেকে আনা সামান্য কাপড় আর কিছু টুকিটাকি গুছিয়ে মেয়ের হাত ধরে শিপ্রাবৌদির উঠোনে এসে দাঁড়ালো।

শিপ্রা যেন বুঁচিকে দেখতেই পেল না। উঠোনে নেমে এসে হৈমন্তিকে কোলে তুলে আদর করতে করতে বলে চলল, ‘এতদিন পর মামাবাড়ি এলি মা। তোর মামা চলে গেল বৈশাখে, এই পৌষের শেষে আমি যে তোকে পিঠে করেও খাওয়াতে পারব না মা। আমার যে কাল অশৌচ। ... কপালে থাকলে পরের বার হবে। আর যেতে হবে না কোথাও। তোর মা বড় হতভাগী রে ... আয় তুই আমি তোর মা'কে আদরে সোহাগে রাখি।’  বুঁচি কাঁদছিল, শিপ্রাও। এতটা ব্যক্তিগত সে দুঃখ যা শিপ্রাবৌদির স্পর্শে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠছিল। কিছু কষ্ট এত গোপন যে তা গোপনতাকেও অতিক্রম করে যায়। এই কান্না বিলাপের মাঝে শিপ্রাবৌদি বলেছিল, ‘জানিস তো বিহারীদার পাগলামো। ব্যবসার নেশায় দক্ষিণের কোনার ঘরটাকে গোডাউন বানিয়েছিল। ক'দিন ধরে সত্যম বলছিল, ‘মা ঘরটাকে পরিস্কার করি। হপ্তাখানেক আগে পরিস্কার করালো,  আলো পাখাও লাগালো। বললো, লোকজন এলে তো লাগেই। ... তোর বিহারীদা শেষের ক'দিন খুব বলতো রে তোর কথা। ঘর তো তোর সেই করে দিয়ে গেছে। আজ আমার কাছেই থাক, কাল থেকে ব্যবস্থা হবে’খন।’ পুকুরপারের টিমটিমে আলোয় শেষ পৌষে শিপ্রার সাদা সিঁথি জ্বল জ্বল করছিল। বুঁচি পায়ে পায়ে ঘরে উঠে এলো।

পরদিন সকালে পিসীও এলো। পিসীর শ্বশুরবাড়ির লোকজনও। পুরুষেরা বলল, ‘কেস করা উচিত, অধিকার ছাড়বি কেন। তুই চলে এলি,  এখন তো শ্যামলের সোনায় সোহাগা। এ বোকামি কেউ করে! মেয়ের ভবিষ্যত আছে না? এক পয়সা ছাড়া উচিত না।’ পিসী হতভম্ব হয়ে বসে ছিল। শুনছিলাম সব। বুঁচি শুধু বললো, ‘আমি তো ওর দেওয়া টাকাও ও বাড়ির আলমারিতে রেখে এসেছি।’ শিপ্রাবৌদি বলল, ‘বেশ করেছিস।’

বুঁচি শিপ্রাবৌদির সংসারে হাত লাগাল। আর শিপ্রা বিভিন্ন খবর আনা শুরু করল ।কোথায় সেলাইয়ের লোক লাগবে, কোন দোকানের জন্য মুড়ি প্যাকেট করতে হবে, কোথায় লোকজনের জন্য রান্না করে দিতে হবে এমন সব সামান্য কাজের খবর। হৈমন্তির পাড়ার কর্পোরেশনের ইস্কুলে যাতায়াতও শুরু হল। আর পুরনো হারমোনিয়াম বের করে ঝেড়েঝুড়ে হৈমন্তিকে নিয়ে শিপ্রামামি সন্ধেবেলা বসা শুরু করল। 

বুঁচির ক্যান্সার ধরা পড়ল যখন হৈমন্তি বছর তিনেক চার পাঁচটা পারলারে কাজ করার অভিজ্ঞতায় আর কিছু জমানো টাকার ভরসায় নিজেই একটা বিউটি পারলার খোলার কথা ভাবছিল। শিপ্রামামির উৎসাহ ছিল খুব। শিপ্রামামিরই উৎসাহে কলেজে পড়তে পড়তেই পার্ট টাইম কয়েকটা বিউটি কোর্সও হৈমন্তি করে নিয়েছিল। কিন্তু বুঁচির শরীর ভাঙ্গছিল খুব তাড়াতাড়ি। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যখন রোগ ধরা পড়লো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। একটা সময় এলো যখন বুঁচি বিছানায় পড়েই গেল।

মানুষের জীবনে বোধহয় এমন সময় কখনো কখনো আসে যখন তারা বড় হয়ে যায়। নিজের ইচ্ছে, শখ, প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তখন তারা সরিয়ে রাখে অবশ্যম্ভাবী বর্তমান মাথায় রেখে। হৈমন্তির এখন সেই সময় চলছিল। সকালে বেরিয়ে দুপুরে বাড়ি আসা। তারপর মা'কে খাইয়ে আবার বিকেলে বেরিয়ে রাতে ফেরা। শিপ্রামামি একটু বেশী করে দুধ রাখা শুরু করল। পিসীদিদা চলে আসত দুপুরের পরেই। রাতে বুঁচির খাওয়ার পর বাড়ি যেত। বুঁচি একটা সময়ে ঘোরে চলে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। এমন অবস্থায় বুঁচি পিসীকে একদিন বলেছিল বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা, একদিন বলেছিল পুকুরে মাছ ধরার গল্প বলতে, আরেকদিন এমনই কোনো অপ্রাসঙ্গিক কিছু। বুঁচি যখন এমন প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছিল তার অস্পষ্ট স্বরের কথায়, কারণ ওর অস্তিত্বে তখন এটুকু শব্দমাত্রই অবশিষ্ট ছিল, তখনই একদিন ভরা সন্ধ্যায় মাধবী এসেছিল চন্দনার বুটিকে।

সত্যম চাকরির কাজে আরও বেশী ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল, ওদের মেয়েটাও তখন এতটা বড় হয়ে গিয়েছিল যখন নিজে নিজে সব কাজ করা যায়, চন্দনা বায়না ধরেছিল বাড়ির উত্তর দিকে সদর দরজার পাশে পুরনো গ্যারেজটায় ও একটা শাড়ির বুটিক করবে শুধু দুপুরে। সন্ধের পর থেকে তো মেয়ের পড়া তাই দুপুরে। শিপ্রা একমাথা কাঁচা পাকা চুলে ভরা মাথাটা হেলিয়ে রাজি হয়ে গেল একবারেই। এটুকু ছলনা বুঝতে তো শিপ্রার ভুল হওয়ার কথা না যে এ সব ব্যবসা সন্ধের পরেই জমে ভাল, ওই শাশুড়িকে রাজি করানোর জন্যই তো ‘শুধু দুপুরে’ বলা। এক ছেলের বউ এর এ সব বায়না না শিপ্রার ভালোই লাগে।

সেদিন বিকেলে চন্দনা গেল মেয়েকে নিয়ে ব্যারাকপুরে বাপের বাড়ি।  ব্যারাকপুরে এক কবিরাজের ওষুধ বুঁচি খায়। খেলে শরীরের জ্বালাটা কমে। কালকে ওটা নিয়ে একবারে ফিরবে। চন্দনা এদিক ওদিক গেলে শিপ্রাই বসে এখন। বিশেষ কিছু করার অবশ্য থাকেনা। দু'জন মহিলা আছে । ওরাই কাপড় দেখায়, দাম বলে, টাকা নেয়। শিপ্রার বসে থাকতে ভালোই লাগে। চন্দনা বলে গিয়েছিল, ‘মা, একা একা বসে থাকতে হবে না। তুমি বুঁচি পিসীর কাছেই থেকো বরং।’ শিপ্রার ভালো লাগে এই অনুভূতিটুকূ। অবশ্য ওর বসার উপায়ও নেই। সন্ধের সময় বুঁচি একটু দুধ খায়। তখন হৈমন্তি থাকে না । শিপ্রাই গরম করে চামচে করে খাইয়ে দেয়। এই দুধটুকুই যা একটু খায় মেয়েটা। বুঁচির পিসী গল্প করতে থাকে, শিপ্রা খাওয়ায়। বিকেল গড়িয়ে যেতে শিপ্রা দোকান বন্ধ করতে বলল। কাউন্টারের মেয়েটি একটু আস্তে করে বলল, ‘মাসিমা, কাস্টমার।’ শিপ্রা দেখল একজন মহিলা বুঁচির বয়সী হবে , সঙ্গে একটি মেয়ে হৈমন্তির সমান হতে পারে আর একটি বাচ্চা মেয়ে মহিলার নাতনি হতে পারে, দোকানে ঢুকছে। মেয়েটি আঙ্গুল দিয়ে একটা কাপড় নামাতে বলছিল আর মহিলাটি বারবার শিপ্রার দিকে তাকাতে তাকাতে বলেই ফেলল, ‘আচ্ছা আপনার নাম কি শিপ্রা? মানে আপনি কি শিপ্রাবৌদি?’ শিপ্রা প্রখর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো,  তারপর বলল, ‘আমারও খুব চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি বলো তো?’ সমস্ত বোধে, সমস্ত স্মৃতিতে, বুঁচির সঙ্গে এতদিনের ওতপ্রোত সহবাসে শিপ্রা চিনতে কোনো ভুল করেনি তবু মহিলাটির নিজের মুখেই শুনতে চাইছিল ওর পরিচয়, নাম। তাই মহিলাটি যখন বলল, ‘আমি মাধবী। মাধু।' শিপ্রা অবাক হলো না মোটেই। 

‘আমাকে তোমার মনে আছে? কোথায় দেখেছ বলো।’ মুখের ভাব এতটুকু না পাল্টে শিপ্রা জানতে চাইছিল মাধবীর কতটুকু মনে আছে।

‘ওমা মনে থাকবে না। শ্যামলদার বিয়ের দিন আমরা তো আপনাকে নিয়েই বলাবলি করছিলাম। এত সুন্দরী বৌদি বুঁচির! কত নজর সুনয়নার দিকে!’ মাধবী হাসি হাসি মুখ করে বলছিল। তারপর মেয়েটিকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘এই আমার মেয়ে বৌদি। কনক। আর এটা নাতনী। কনক প্রণাম কর। ইনি একজন মামী তোর।’ কনক এই আশ্চর্য কথোপকথন শুনছিল। প্রণাম করার জন্য নীচু হচ্ছিল আর তখনই শিপ্রা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মাধু, তুমি কেমন আছো? ও বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আছে তোমার?’

এমন অপ্রস্তুত প্রশ্নের জন্য মাধবী তৈরী ছিল না। একটু চুপ করে থেকে গলার স্বর নামিয়ে অল্প অল্প করে বলেছিল, ‘আছে বৌদি ... কনক হওয়ার ক'বছর পর মা বাবা … মানে সব ঠিক হয়ে গেল ...এখন তো মা বাবা আর নেই ...বাড়িটাও বিক্রি হয়ে গেল।’  তারপর শিপ্রার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি জানি বৌদি ... সুনয়না ও বাড়ি থেকে চলে গেছে।’

‘কোথায় গেছে জানো?’  শিপ্রা যেন ভুলেই গেছে বুঁচির দুধ গরম করার কথা।

এবার মাধবী চোখ নামিয়ে আরও আস্তে বলল, ‘শুনেছিলাম আপনার বাড়িতে এসেছিল।’ তারপরই হঠাৎ দ্রুত কৈফিয়ত দেওয়ার মত করে বলল, ‘কিন্তু বৌদি আমি জানতাম না এটা আপনার বাড়ি, বিশ্বাস করুন তাহলে আসতাম না।’

কনক অবাক হয়ে শুনছিল। বিশেষ কিছু বুঝতে হয়তো পারছিল না কিন্তু কৌতুহল হচ্ছিল খুব। শিপ্রা এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে ভেসে আসা শাঁখের আওয়াজে বুঝতে পারছিল বুঁচির দুধ খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কাউন্টারের মেয়েটাকে বুটিক বন্ধ করতে বলে একবার মাধবীর দিকে তারপর কনকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এসো দেখে যাবে। ... কনক আয় মা।।’ 

 

বুঁচি আধশোয়া হয়ে বসে ছিল। আজ একটু শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। পিসী কোনো রকমে পেছনে দুটো বালিশ দিয়ে মাথাটা উঁচু করে দিয়েছিল। অন্যান্য দিন দুধ খাওয়ানোর সময় শিপ্রাই দেয়। বুঁচি চার পাশের ভেসে আসা শঙ্খধ্বনিতে বুঝতে পারছিল আজ বৌদির দেরী হচ্ছে। বৌদি ওর মুখে প্রথম চামচের দুধ দেওয়ার পর শাঁখের আওয়াজ আসে। বুঁচি ওর বাঁ পাশের দক্ষিণের জানলায় অন্ধকারে  বৌদিকে আবছা দেখতে পায়। সঙ্গে আরও কেউ। হৈমন্তি এলো? এত তাড়াতাড়ি! শিপ্রাবৌদি ঘরে ঢোকে। বুঁচির বিছানাটা প্রায় একটা পাক দিয়ে ওর ডানপাশে এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে মাধবী, কনক, মাধবীর নাতনী। পিসী বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়,  বুঝতে পারে না এরা কারা। শিপ্রা খুব আলতো করে ডাকে, ‘বুঁচি। দেখ তো। চিনতে পারিস কি না।’ বুঁচি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। ঘন সন্ধেয় বাল্বের হলদে আলোয় ওর ঘোলা চোখ আরও ঘোলা দেখায়। মাধবী বিস্ফারিত চোখে  তাকিয়ে থাকে কঙ্কালসার সুনয়নার দিকে।

শিপ্রা আবার বলে, ‘বুঁচি চেয়ে দেখ। ও মাধবী। মাধু। তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।’ বুঁচি যেন জন্মান্তরের ডাক শুনতে পায় এবার। মাধবীর অন্যমনস্ক বাড়িয়ে দেওয়া হাত কাঁপা হাতে ধরে নেয়। শ্বাস নেয় হাঁ করে। শিপ্রা আবার বলে, ‘এই দ্যাখ মাধু, ওর মেয়ে নিয়ে এসেছে।  এই দ্যাখ নাতনী।’ বুঁচি আর কিছু শুনতে পায় না, দেখতে পায় না। অস্পষ্ট ফ্যাঁসফেঁসে গলায় গুমরে ওঠে, ‘মাধু, এলে তুমি।’ কনকের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমার মা আমাকে বিয়েতে সাজিয়েছিল।’ বুঁচির হাসি বিকৃত হয়ে ওঠে। শিপ্রা পিসীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘পিসী যাই ওর দুধটা নিয়ে আসি। কনক আয় আমার সঙ্গে।’ শিপ্রার বেরোনোর পর কনক অনিচ্ছা সত্বেও ঘর থেকে বেরোয় শিপ্রার পিছু পিছু। মাধবী ওর হাতটা ছাড়াতে চাইছিল। কিন্তু বুঁচি ছাড়ে না। তারপর বুঁচি ওর সমগ্র অস্তিত্ব , ওর এই মৃত্যুপথযাত্রার অতল তল এ সমস্ত কিছু মথিত করে মাধবীর হাতটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে এ প্রশ্ন করে ফেলেছিল,  ‘বলো তো মাধু। সেদিন তোমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ায় আমার কি কোনো হাত ছিল? আমি কি তোমাকে এ বুদ্ধি দিয়েছিলাম? মাধু বলো ...!’ 

এ প্রশ্নের উত্তর বুঁচির নিজের  অজানা ছিল না। তবু সাতাশ বছর পর মাধবীর নিজের মুখে ‘না’ শোনাটা ওর অসম্মানিত এবং বিপন্ন জীবনের নিজেরই দায় হয়ে উঠছিল তখন। যেন এই একটা প্রশ্নের উত্তর জানার জন্যই এতদিন এই বেঁচে থাকা। মাধবীর উত্তর ছাপিয়ে ওর জিজ্ঞাসা ধীরে ধীরে একটা চিৎকৃত ধ্বনিতে পরিণত হচ্ছিল। উত্তর শোনার দায় আর বুঁচির ছিল না। তখন শত শত আলোকবর্ষ দূরে তারাদের জেগে ওঠার সময় হয়েছে, ঘরের কোনার ঘন অন্ধকারে পোকা মাকড়েরা এবং বাইরের ঘনতম অন্ধকারে রাতপাখিরা সজাগ হয়ে উঠেছে, শিপ্রাবৌদির উনুনে বুঁচির দুধ উথলে উঠেছে, পিসীর আদরের হাত বুঁচিকে জড়িয়ে ধরে থামানোর চেষ্টা করছে। বুঁচি গোঙাচ্ছিল তার মুক্তির যন্ত্রণায়।

তারপর বুঁচির শীর্ণ হাতটা ধীরে ধীরে এলিয়ে পড়ল। 



 মূল পাতায় যান





 



  














    

 

Comments

Popular posts from this blog

সূচীপত্রঃ শারদ সান্ধ্য জলপাইগুড়ি

বাজারি গপ্পোঃ নিঝুম ঠাকুর