মনিরুলের জানাযাঃ সৌগত ভট্টাচার্য

মনিরুলের জানাযা

সৌগত ভট্টাচার্য

 

 এক

 

রাতেই খবরটা আসে

হাইওয়ের পাশে ডাঁই করে রাখা বোল্ডারের পেছন থেকে সূর্য উঠলে চ্যাংরাবান্দায় সকাল হয়। ভুটানের পাহাড় ভাঙা টুকরো আর নদীর জল ভেজা বোল্ডার বোঝাই ট্রাকগুলো বাংলাদেশে ঢোকার আগে কাগজপত্র দেখানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে চেকপোস্টে। যেন গোটা ভুটান পাহাড়কে ডলায় নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে একেকটা ডাম্পার। এশিয়ান হাইওয়েতে থাকা সবুজ সাইন বোর্ডের একদিকে লেখা পাশাখা অন্য দিকে লেখা রংপুর, ইন্ডিয়ার ওপর দিয়ে রাস্তা গেলেও ইন্ডিয়ার কোনো জায়গার নাম লেখা নেই। এই সাইন বোর্ডগুলো দেখে আজিজের খুব অবাক লাগে। সূর্য উঠতে না উঠতেই সাইকেলের পেছনে বুলবুলিকে বসিয়ে ট্রাকের লাইন কাটিয়ে হাঁড়ি কমাতের দিকে রওনা হয়। সাইকেলটা জোরেই চালাচ্ছে আর গামছা দিয়ে ঘাম মুছছে, যেন চার কিমির মত রাস্তা শেষ হতেই চায় না। বুলবুলি সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে বসে একটা হাত দিয়ে আজিজের কোমর জড়িয়ে ধরে মাথাটা আজিজের পিঠে। আজিজের পিঠ ঘাম আর বুলবুলির কান্নায় ভিজে যায়।  কাল যখন খবর আসে তখন আর হাঁড়ি কামাত যাওয়ার সময় ছিল না, সন্ধ্যা পাঁচটার পর ক্যাম্পের গেট বন্ধ হয়ে যায়। বিএসএফ সকালের আগে আর কাউকে গ্রামে ঢুকতে দেবে না। আজিজ এসে চেকপোস্টে দাঁড়ায়। কাঁটাতারের এপারে ভঙ্গি পাড়া ওপারেও ইন্ডিয়ারই অন্য আরেকটা গ্রাম আরেক গ্রাম হাঁড়ি কামত। সেখানেই আজিজের শ্বশুর বাড়ি।

"তেরা তো ফরটিন নম্বর হ্যায় না?" বিএসএফের হাবিলদার সুরেশ সিং জিজ্ঞেস করে আরাবুলকে। সে মাথা নাড়ায়। সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে ক্যাম্পের ছোট ছাউনিটার দিকে এগিয়ে যায় আরাবুল। চ্যাংড়াবান্দার থেকে কিছু মুদি বাজার করে এনেছে সে। সেই ব্যাগটা সাথে নিয়ে যায়। অন্য ব্যাগে একটা পাঁঠা মুখ বের করে আছে। বাজারের ব্যাগ থেকে একটা একটা করে জিনিস বের করে আর বলতে থাকে, "তেল পাঁচশ আটা পাঁচশ…" একটা একটা করে জিনিসের নাম খাতায় তুলতে থাকে সুরেন্দ্র। আরো কিছু জিনিসের হিসেব দেওয়ার পর আরাবুল বলে, "সাবান তিনটা…" সাথে সাথে সুরেন্দ্র বলে, "পনের দিন আগে সাবান দুইটা বোরোলিন দুইটা ছিল আজ তিনটা? শালা আটা হাফ কিলো আর সাবান তিনটা?" আরাবুল কিছু বলে না হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। পেছনে চোখ ভরা জল নিয়ে বুলবুলি দাঁড়িয়ে আছে আর ওর বর আজিজ ঘাম মুছছে।

রাতে লাইন ট্রাকের ডিউটির পর চ্যাংরাবান্দা থেকে গ্রামে ফিরছে একজন একজন করে। সাথে কেউ কেউ বাজার করে এনেছে। বিএসএফ একজন একজন করে চেক করে গ্রামে ঢোকাচ্ছে। চেকিংয়ের পর ওরাও হাঁড়ি কামাত গ্রামে ঢুকবে। বুলবুলির আর ধৈর্য থাকছে না। মাঝেমাঝেই ডুকরে কেঁদে উঠছে। বুলবুলি কেঁদে উঠলে আজিজ কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। "শালা এই হল গিয়া তোদের গেরামে আসার পবলেম, ইন্ডিয়ার গেরামে ঢুকতে গেলেও এত চেকিংকি যে ভিআইপি গেরাম।" মনসুর আলীও দাঁড়িয়ে ছিল চেকিংয়ের লাইনে। ওকে আজিজকে বলে। হাঁড়ি কামাত গ্রামটা তারকাঁটার ওই পারে পড়েছে, কিন্তু ইন্ডিয়ার গ্রাম। "আর কয় কেন, মেয়ে জামাই গেরামে আসলে মিষ্টি নিয়ে আসে, আর আমাদের গেরামে আই কার্ড ধরি আনার লাগে!" মনসুর বলে।" সুরেন্দ্র সিং তখন খাতা খুলে মনসুরের কিনে আনা পাঁঠাটার রং সাইজ উচ্চতা ইত্যাদি বিবরণ খাতায় এন্ট্রি করছিল। বর্ডারের ভেতর হাঁড়ি কামাত গ্রামের চোদ্দটা বাড়ির জন্য চোদ্দটা খাতা ছিল, কে কী কিনে গ্রামে ঢুকছে কোন সাইকেল নিয়ে যাচ্ছে সব হিসেব ক্যাম্পের খাতায় রাখা হয়। প্রধানই প্রথম বুদ্ধিটা দিয়েছিল, সরকারের খাতায় ছেলে বাপের আলাদা রান্নাঘর দেখতে যাতে ক্যাম্পে ছেলে বাপের আলাদা আলাদা খাতা দেখানো যায় তাতে খোরাকি বেশি আনা যাবে। খোরাকি আর ছাগল নিয়ে তারকাটার ভেতরে হাঁড়ি কামাতে ঢোকে মনসুর। ঢোকার আগে বুলবুলির দিকে নজর পড়ে মনসুরের। এগিয়ে এসে সে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। আজিজ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল বিএসএফ এসে মনসুরকে তাড়া দিয়ে গ্রামের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। আরো কয়েকজনের পর বুলবুলিরা গ্রামে ঢুকবে।

 

 

দুই

 

একটা উঁচু আলের পাশে দাঁড়িয়ে মনিরুল জোরে চিৎকার করে বলে, "আজ কত কইরে মন যাচ্ছে?" রোয়া বোনা থামিয়ে কোমরে হাত দিয়ে হামিদুল বলে, "কাইল প্রধান বাড়ি হাটে বারোশ গেসে!"  উল্টো করা হাঁড়ির মত আকাশের নীচে আড়াআড়ি একটা আল তারপর নিচু জমি। নিচু জামিটা বাংলাদেশ। আলের একপাশে ইন্ডিয়ার গ্রাম হাঁড়ি কামাত আলের ওই পারে বাংলাদেশের গ্রাম প্রধান বাড়ি। মাঝে কোনো তারকাটারর বেড়া নেই। "আমিনাকে ডাক্তার দেখাইলি? ওকে এই সময় জমিতে কাম করতে আসতে দিস না!" হাঁড়ি কামাত থেকে বলে মনিরুল। হামিদুল বলে, "কয় সের দুধ পাচ্ছ চাচা। গরুটা ভালোই ছিল!"  প্রধান বাড়ি থেকে বলে হামিদুল। "ঈদের দিন নামাজ পড়ে আমিনাকে দেখে আসব!" বলে বুড়ো মনিরুল। প্রতিবছর ঈদের দিন প্রধান পাড়া মসজিদে নামাজ পড়তে যায় মনিরুল। হাঁড়ি কামাত গ্রাম থেকে চেকপোস্ট পেরিয়ে সকলে ভঙ্গি পাড়া ঈদগাতে নামাজ পড়তে গেলেও মনিরুল আল পেরিয়ে ওই দেশেই যায় নামাজ পড়তে। ওই পরের প্রধান বাড়ির সব ঘরই মনিরুলের জ্ঞাতি কিন্তু দেশটা নিজের না।

পোড়া হাঁড়ির মত গোল একটা আকাশের নিচে ছিল ছিল মনিরুলের ঠাকুরদা নাছিরুদ্দিনের বেশ কিছু জমি জায়গা। বুড়ো নাছিরুদ্দিন মারা যাওয়ার আগেই চার ছেলের মধ্যে জমি জমা ভাগ করে দেয়। যখন দেশ ভাগ হয় একমাত্র মানিরুলের বাপ আশরাফের জমি চলে আসে ইন্ডিয়ার হাঁড়ি কামাতের দিকে আর বাকি চাচাদের জমি পড়ে বাংলাদেশের প্রধান বাড়িতে। মাঝে শুধু একটা মোটা আল। আলের শেষ প্রান্তে ৬৪৮ লেখা একটা সিমেন্ট এর খুঁটি, এটাই আন্তর্জাতিক সীমানা। আব্বাস এই আলের ধারে দাঁড়িয়ে মনিরুলকে অনেক গালিগালাজ করে বলেছিল, "এই দেড় হাত জমিন আমার, তোর বাপের দলিল দেখ…" মনিরুল বলেছিল, "আমার বাপ তোর কে হয়! মেজ চাচার কাগজ বের করলেই তো সব দুধ আর পানি বোঝা যাবে!" "তুই পারলে মামলা কর!" আব্বাস মনিরুলকে বলে। মনিরুল বলে "আরে খচ্চরের বাচ্চা আমি কি সাধেই কই! তোর দেশে গিয়ে তোর নামে মামলা করতে পারব নাকি তুই আমার দেশে আইসে মামলা করবি?" আব্বাস মনিরুলের সেজ চাচার ঘরের নাতি। মনিরুল নাকি আগে আব্বাসের জমি দখল করেছিল। বর্ষার সময় নিচু জমিতে পাটের জল জমে এক হয়ে গেছিল ইন্ডিয়া বাংলাদেশ। সেই সময় মনিরুল আব্বাসদের জমি দখল করে। এবার যদিও আলকে টেরা ভাবে কেটে আব্বাস মনিরুলের জমির দেড় হাত মত খেয়ে নিতে গেছিল। মনিরুল-আব্বাসের ঝগড়া ফ্ল্যাগ মিটিং পর্যন্ত গড়ায়। পরে বিএসএফ আর বিজিআর মিলে সমস্যার সমাধান করে। প্রধান বাড়ির সাথে প্রায়ই এই আল কাটা আর জমি দখল নিয়ে সমস্যা লেগেই থাকে হাঁড়ি কামাতের। আল কেটে পড়শীর জমি নেওয়ায় মানে দুই দেশের আন্তর্জাতিক মানচিত্র পাল্টে যাওয়া সেটা মনিরুল বা আব্বাস কেউ কী বোঝে! মাটির আল হাঁড়ি কামাত আর প্রধান বাড়ি গ্রামের মাঝখান দিয়ে ইন্ডিয়া বাংলাদেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানচিত্র আঁকেদুইটা পরিবারের জমি দখলের ঝগড়া দুই দেশের বর্ডারকে পাল্টে দেয়।

 

তিন

 

কুমোড়ের চাকা থেকে সদ্য নামা হাঁড়ির মতোই আধা গোল হাঁড়ি কামাতের আকাশে মাটির রং ধরে আছে। সকাল বেলায়ই বৃষ্টি হয়েছে। বিএসএফের চেকপোস্ট থেকে গ্রামের কাদা রাস্তা সোজা চলে গেছে ৬৪৮ নম্বর খুঁটির সমানে। রাস্তা দুই পারেই ভুট্টা আবাদ হয়েছিল এখন ভুট্টা ছোলার কাজ চলছে,  শ্রাবণ মাস, এখন রোয়া গাড়ার সময়। ঐদিকে হাঁড়ি কামাত আর ভাঙ্গি পাড়ার মাঝ বরাবার কাঁটাতার চলে গেছে। ভঙ্গি পাড়ার মত হাঁড়ি কামাতও ইন্ডিয়ার একটা গ্রাম, কিন্তু বর্ডারের এই পারে, যদিও মূল ইন্ডিয়া দেশের বাইরে। হাঁড়ি কামাতের উত্তরে তার কাটার বেড়া দক্ষিণে একটা একটা ৬৪৮ নম্বর খুঁটি আর আল, আলের পরেই বাংলাদেশের প্রধান পাড়ার গ্রাম, মধ্যে কোন বর্ডার নাই। একটা আলই এইখানে  দুই দেশের বর্ডার। একসময় সবটা মিলে একটাই গ্রাম ছিল। দেশ ভাগের সময় প্রধান পাড়ার আর হাঁড়ি কামাতের একদিকে তারকাঁটা চলে যায় অন্য দিকে আল। তারকাটা আর আল মিলে যেন হাঁড়ি কামাত নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চরের মত গ্রাম। বর্ষার ধূসর আকাশের নিচে হাঁড়ি কামাত যেন একটা চৌকো মাটির খণ্ড।

বুলবুলের আর আজিজের জন্য সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল মনসুর। আজিজ একটার পর একটা প্রশ্ন করছিল ক্যাম্পের বিএসএফ। বুলবুলি এখন কাঁটাতারের বাইরের মানুষ। ক্যাম্পের কোনো খাতাতেই আর বুলবুলির নাম নেই। যদিও এই গ্রামেই ওর জন্ম। এখন আই কার্ড দেখিয়ে গ্রামে ঢুকতে হয়। জামাই ক্যাম্পের খাতায় কলমে এই গ্রামের গেস্ট। ওরা চেকপোস্ট পেরিয়ে এলে একসাথে গ্রামের দিকে রওনা দেয়।

"কি হল বুলবুলির কাঁদে ক্যান?" আজিজকে জিজ্ঞেস করে মনসুর। সেই কথার উত্তর না দিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে আজিজ বলে,"কাঁটা বেড়ার চেকিং পার হয়ে এই পারে আসাই এক ঝামেলা! মানুষ মরি গেলেও  তোমাদের গ্রামে আসা যায় না। তোমাদের গেরাম ইন্ডিয়ার আর দশটা গেরামের মত না! ইস্পেশাল গেরাম! পুরা ভিআইপি গেরাম! জীবনে কেউ শুনছে নিজের গ্রামে ঢুকতে পরিচয়পত্র লাগে!" খারাপ কিছু একটা হয়েছে গ্রামে টের পায় মনসুর। কিন্তু কাল রাতে চ্যাংড়াবান্দায় ডিউটি থাকায় গ্রামের কোনো খবর পায় নাই। আজিজও আমিনাকে সবটা খুলে কিছুই বলেনি। আমিনাকে সে আড়াল করে রেখেছে দুঃসংবাদ থেকে। মনসুর সাইকেলে উঠেনি, সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছিল আর মাথা বের করে পাঁঠাটা ডাকছিল। মনসুর বলে, "বর্ডারে তারকাটা বসানোর সময় যদি তারকাটাটা একটু ট্যারা করে আমাদের গ্রামটাকে দ্যাশের মধ্যে ঢুকিয়ে নিত তাহলে আজ আমাদের এই রকম মোরেও বেঁচে থাকতে হত না! কাঁটাতারের বেড়ায় এই বিচার হবে কোনো দিন জানতাম যে নিজের দেশেই নিজে খাঁচায় বন্দি হয়ে যাব আমরা পনেরটা ঘর! না আমার বাংলাদেশের না ইন্ডিয়ার!" সদ্য রোয়া বোনা সবুজ মাঠে বুলবুলির লাল শাড়ির ছায়া পড়েছে ওরা আজই বিকেলে চেক পোস্টের গেট আটকানোর আগেই চ্যাংরাবান্দা ফিরে যাবে। জামাই এর সাইকেল চেকপোস্টেই রেখে যেতে হয়েছে। বুলবুলি এই গ্রামের মেয়ে হলেও এখন সে বাইরে থাকে জামাইও এই গ্রামের বাসিন্দা না। আকাশে মেঘ করে থাকলেও গুমোট গরম। জামাই আজিজ রাগের গলায় বলে, "ইন্ডিয়া বাংলাদেশ কিসু না, তোমাদের হাঁড়ি কামাত আলাদা একটা দেশ! মারার জন্যই তোমরা এখানে আছো!"

গ্রামে ঢোকার সাথে সাথে আতিবুল কোথা থেকে যেন এসে আজিজের সমানে এসে দাঁড়ায়। অতিবুলের মুখ গম্ভীর। অতিবুল মনসুর জিজ্ঞেস করে, "খবর পাইছ মিয়া?" আজিজ সবটাই জানে। কিন্তু বুলবুলির সামনে কী বা আর বলবে! তাওজিজ্ঞাসা করে, "কি খবর কি হইসে?" অতিবুল একটা বিড়ি এগিয়ে দেয় আজিজের দিকে। দুই এক ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়। ওই দেশের প্রধান পাড়ার দিক থেকে বৃষ্টিটা হওয়ার মত ঝাপটা দিয়ে হাঁড়ি কামাতের দিকে আসতে থাকে। "মনিরুল চাচা আর নাই…" জানা কথাটা আবার জানলো আজিজ আর বুলবুলি।

 

চার

 

চারদিকে সুপারি গাছ ঘিরে আছে দুই কামরার টিনের চলাবাড়িটা। সুপারি গাছগুলো বেয়ে জঙ্গল ঝোপ ঝাড় আকাশ ছুঁয়েছে। মনিরুলের দেহ উঠানে শুইয়ে রাখা হয়েছে একটা খাটিয়ায়। "বাবা আমার কি সর্বনাশ হয়ে গেল…" বলে কেঁদেই যাচ্ছে বুলবুলি। মাথার কাছে বদনাটা রাখা। উমর এসে আজিজকে বলে, "মিন্টুকে খবর দেওয়া হয়েছে?" আজিজ বলে "মোশারফ খবর দিয়েছে শুনলামকিন্তু ওকে খবর দেওয়া না দেওয়া সমান ব্যাপার। ওনার কিসমতে ছেলের হাতে মাটি নাই!" মনিরুলের ছোট ছেলে দুবাইয়ে গাড়ির ফিটার। কাঁদতে কাঁদতে বুলবুলির চোখের জল শুকিয়ে গেছে। শাহ আলম মাইদুল চিকলু খইলু আজিজুল রোজকার মত আলের বর্ডার পার করে সক্কাল সক্কাল চলে এসেছিল হাঁড়িকমাতে, রোয়া বোনার সময় আসলে ওই পার থেকে দিন মুজুরির জন্য অনেকে এপারে চলে আসে। আজ গ্রামে ঢুকে এই অবস্থা দেখে কেউ আর মাঠে যায় নাই।

মনিরুলের বংশের কোনো ছেলে এই ইন্ডিয়ার হাঁড়ি কামাতে থাকে না ওর সব আত্মীয় মানে আব্বাসরা প্রধান বাড়িতে থাকে। ছেলে আসার তো প্রশ্নই নেই। মফিজুল আজিজকে উদ্দেশ করে বলে, "মনিরুল চাচার গোরে কে মাটি দিবে তোমরা ঠিক করেছ?" আজিজ বলে, "মনিরুল মিঞা সবার তাই সবাই মাটি দিবে!" মফিজুল বলে,"নিজের আত্মীয়র মধ্যে দিলেই ভালো হয়, তারপর তো আমরা আছি!"  আজিজ বলে, "ওই দেশ থেকে মনিরুল মিঞার চাচাত ভাইরা আসতে তো অনেক সময় লেগে যাবে, আমাকে তো পাঁচটার আগে চেকপোস্ট পার হতে হবে!"  মফিজুল বলে, "শোন আজিজ, চাচা কোনো দিন ইন্ডিয়া পাকিস্তান মানে নাই! পার্টিশন মানে নাই। পুরা হাঁড়ি কামাত আর প্রধান পাড়া নিয়েই নিজের গ্রাম ভাবত। তাই তো প্রতি বছর ঈদের নামাজ পড়তে ওই দেশে যেত!" চিকলু বলে, "মনিরুল চাচা কিন্তু নিজের ভিটা ছাইরে আমাদের দেশেও যায় নাই।" মফিদুল বলে, "মনিরুল চাচা বলত এটা ওর বাপ ঠাকুরদার জামিন, এই টুকু বোঝে ইন্ডিয়া পাকিস্তান বোঝে না!" প্রতি বছর আব্বাসের সাথে নিজের জমির মাটি দখল নিয়ে কিন্তু কোন দেশের জমির মানচিত্র আঁকতো আর কোন দেশের জমি বাঁচাত মনিরুল নিজেও জানে না। মনিরুল বলত, "প্রধান বাড়ি আর হাঁড়ি কামাত সবটা মিলেই আমার দেশ! কেউ মানুক আর নাই মানুক!"

 

পাঁচ

 

সূর্য হেলতে শুরু করেছে। মনিরুলকে গোছল করানো বেশ কিছুক্ষণ আগেই হয়ে গেছে। বাড়ির পেছনেই মনিরুলকে গোর দেওয়া হবে যেখানে বুলবুলির মা তছলিমার গোর আছে। আজিজ আজ কি ভাবে ফিরবে জানে না। মফিজুল বলে, "আল্লা আমাদের প্রত্যেকের কিসমত আলাদা করে দিয়েছে, বংশের মাটি না থাকলে কী করা যাবে! আল্লার ওপরে তো কেউ নেই!" কাফান পরিয়ে গোর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় মনিরুলকে। জানাযার নামাজও শুরু হয়। সূর্য অনেকটা প্রধান বাড়ির দিকে হেলে পড়েছে। বাতাসে একটা মৃদু হাওয়া। কবরে মনিরুলকে শোয়ানো হয়েছে। পাড়ার একজন একজন করে কবরে মাটি দিচ্ছে। বাকি মাটি ভরাট হয়ে গেছে প্রায় কবরে। এই সময় হাঁফাতে হাঁফাতে বাঁশ ঝারের পেছন দিয়ে পায়ে কাদা মেখে শুয়ে আল টপকে হাজির হয় আব্বাস। মনিরুলের ইন্তেকালের খবর পেয়ে আব্বাস। নিজের চাচার ছেলে হলেও মনিরুলের  সাথে আব্বাসের কথা ছিল না আল কাটা নিয়ে ঝগড়ার জন্য। কবরের সমানে এসে আব্বাস দাঁড়ায়। সকলে আব্বাসকে দেখে অবাক হয়ে যায়। যাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ সে কি না চাচার জন্য হাজির। কেউ কিছু বলার আগেই আব্বাস বলে, "আমাকে একদিন বলছিল তুই শালা আমার মারা শরীলটায় মাজ্জিদের মাটি দিস বাপ…"  আব্বাস কাদা মাখা লুঙ্গির কোচ থেকে সামান্য এক মুঠো মাটি বের করে মনিরুলের কবরে ছিটিয়ে দেয়। এই মাটি ছিল প্রধান পাড়া মসজিদের মাটি।

একে একে সকলে বাড়ি ফিরছে। আব্বাস আবার লুকিয়ে লুকিয়ে আল টপকে বাংলাদেশের প্রধান পাড়ায় ফিরছে, আজিজ কাঁটাতার বিএসএফ ক্যাম্প পেরিয়ে ওই দিকের অন্য একটা ইন্ডিয়ায় ফিরছে। মাঝে হাঁড়ি কামাত গ্রামটা যেন একটা চৌকো কবরের মত একা শুয়ে আছে, যে কবরের একদিকে কাঁটাতার অন্য দিকে মাটির আল। মাইকে প্রধান পাড়া মসজিদ থেকে জুম্মাবারের আজান শোনা যাচ্ছে। কে যেন মনিরুলকে বলেছিল, আজানের শব্দ কবরের ভেতরে থাকা মানুষকে মুক্ত করে দেয় সীমানাহীন করে দেয়। সন্ধ্যা বেলা সেই কবরের মধ্যে শুয়ে আছে মনিরুল মিঞা যার বুকের ওপর এক মুঠো প্রধান পাড়া মসজিদের মাটি, যে মাটি ক্রমশ মিশে যাচ্ছে ইন্ডিয়ার মাটির সাথেহাঁড়ি কামাতের মাটিতে শুয়ে প্রধান বাড়ি মসজিদের মাটি নিয়ে মনিরুল আল পাহারা দিচ্ছে।

 

 

 মূল পাতায় যান

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

                     

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

সূচীপত্রঃ শারদ সান্ধ্য জলপাইগুড়ি

বাজারি গপ্পোঃ নিঝুম ঠাকুর