কমিক্স রিমিক্সঃ অভিজিৎ সরকার
কমিক্স রিমিক্স
অভিজিৎ সরকার
১
দেব-এর আগের বরেণ্য দেব
আমি একটি প্রভুভক্ত পোষা নেকড়ে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম সন্ধ্যে রাতে একদিন কোনো পানশালায় গিয়ে ডাঁট-সে এক গ্লাস দুধ অর্ডার দিতে।
এই দুই এক্সক্লুসিভ সাধ ছেলেবেলায় আমার মগজে গজিয়ে ওঠার পেছনে দায়ী করা চলে চলমান অশরীরী-কে। খুলি গুহার মহাপ্রভু, অরণ্যদেব। হিন্দিতে যার নাম ছিল বেতাল। আর ইংরেজিতে ফ্যান্টম।
আমার ছোটবেলার সেই প্রাচীন কালে, আমিও ছিলাম প্রাচীন অরণ্যের প্রবাদ কর্তৃক প্রবলভাবে প্রভাবিত। তাই স্কুলের ক্লাসরুমে পাঠ্য বইয়ের আড়ালে হোক কিংবা বাড়িতে প্রাইভেট টিউটরের কাছ থেকে জাল বাথরুম ব্রেক আদায় করার পরে শৌচালয়ের প্রাইভেসীতে হোক …
যে অপাপবিদ্ধ দুষ্কর্ম করার জন্য অসংখ্যবার ধরা পড়ে তিরস্কৃত হতাম, তা হলো ইন্দ্রজাল কমিক্সের কাছে আত্মা বন্দক রাখা!
আহহহ! সে যে কি কমিক্স!
টেলিভিশন, ইন্টারনেট আর স্মার্ট ফোন যুগের আগেকার আদি কমিক্স স্ট্রিপ।
টেলিফোন বলতে যে সময়, পাড়ার হাতে গোনা বাড়িতে গোল ডায়াল যুক্ত কেদো কোলাব্যাঙ মার্কা কালো একটি বস্তু (অধিকাংশ সময় অকেজো) বিরাজ করতো। কোল্ড ড্রিঙ্কস (তখন কেউ সফট ড্রিঙ্কস বলতে শেখে নি) বলতে বোঝাতো কালো ক্যাম্পা কোলা কিংবা কমলা গোল্ড স্পট। রেডিওতে আমিন সায়ানির “বিনাকা গীতমালা” ছিল বিনোদনের সর্বোচ্চ শিখর। আর খবরের কাগজে ফ্রন্ট পেজ পিকচার মানে তখন বেশীর ভাগ দিনই কুট্টির আঁকা সাদা কালো কার্টুন। সপ্তাহে এক বা দুদিন বড় জোর আবছা সাদা কালো ফটোগ্রাফ। বিবরণ শুনে এখনকার জেনারেশন নির্ঘাত ভাবছে, বাপরে! কি ডার্ক এজ রে !
তখন জীবনটা সত্যিই বারো আনা সাদা কালো ছিল। তাই, সেখানে চার আনা রঙ বয়ে আনা ইন্দ্রজাল কমিক্স যে একটা অলৌকিক জানালা হয়ে দাঁড়াবে, তাতে অবাক হওয়ার আছেটা কি?
“জয় ডেনকালী” বলে সেই কল্পনার ভবসাগরে ডুব দিলেই, ভিলেনের গালে আংটির খুলি চিহ্ন ছাপের মাধ্যমে বিতরিত উপযুক্ত শাস্তি দেখার পুলক। আর কিলা উইয়ির সোনা মাখা সমুদ্র তটে দাঁড়ালেই প্রাণ ভরে অবলোকন…পোষা ডলফিন সোলোমন আর নেফারতিতির মাথায় পা রেখে অরণ্যদেব আর ডায়ানা পামার ঢেউয়ের ওপর সার্ফিং করছে।
আমি প্রথম বিকিনি, চিনি সেখানেই।
আর ইন্দ্রজাল কমিক্সের দৌলতেই প্রথম বুঝি যে নায়ক নায়িকার প্রেম পর্ব অবধিই কাহিনীর আকর্ষণ বজায় থাকে। কারণ, অরণ্যদেব ও ডায়নার ছেলেপুলে হওয়ার পর থেকে ওই কমিক্সটা পড়ারই মজা চলে গেল!
২
কোথায় পাবো তারে?
জলপাইগুড়িতে ইন্দ্রজাল কমিক্সের প্রাপ্তিস্থান ছিল বড়ই সীমিত। হাতের কাছে তিন চারখানা লাইব্রেরির ফ্রি রিডিং রুম থাকলেও, সেগুলোর সব কটাতেই কেন যেন চক্রান্ত করে ইন্দ্রজাল কমিক্স না রাখার অভিজাত ফ্যাশন চালু ছিল। তবে সাইকেল চেপে টাউনে খবরের কাগজ বিলি করতো যে হকাররা, তাদের সাইকেলের সামনের রডে ঝোলানো লোভনীয় ম্যাগাজিনগুলোর মধ্যে উঁকি দিত প্রতি সপ্তাহের নতুন ইন্দ্রজাল কমিক্স। পকেট যখন জিরো ব্যালেন্স, তখন তক্কে তক্কে থাকতাম হকার কখন সাইকেল স্ট্যান্ড করে কিছুক্ষণের জন্য অনুপস্থিত থাকবে। এটা সম্ভবও ছিল কারণ, টাউনে বেশির ভাগ বাড়ির সামনেই তখন অনেকটা করে খোলা জায়গা। তাই গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে ওই দূরত্ব পেরিয়ে মূল বাড়ির জানালা দিয়ে কাগজ দেবে হকার, তারপর আবার হেঁটে ফিরে আসবে। ওই কয়েক মিনিটের মধ্যে অসম্ভব অ্যাঙ্গেলে মাথা বেঁকিয়ে রডে ঝোলানো কমিক্সের যতটুকু পড়ে ফেলা যায় সেটাই বিনি পয়সার লাভ!
এরপর আরেকটু বড় হতে হাত খরচ মিলতে শুরু করলো। তখন জলপাইগুড়ি কমার্স কলেজের বিপরীতে ন্যাংটো বইয়ের দোকানটায় ঢুঁ মারতে বেজায় ভালো লাগতো। লম্বা দড়িতে কাপড় শুকোনোর মতো করে কমিক্স আর স্বপন কুমার পাশাপাশি টাঙ্গিয়ে রাখা থাকতো সেই দোকানে। খোলা আকাশের নিচে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে। যেন একটা ফুলের বাগান! আর সেই বাগানের মালিক ছিল শীর্ণ দরকচা মারা চেহারার বুড়াদা। পরবর্তী কালে কদমতলার বিখ্যাত মাতাল পিন্টুদার গাল ভাঙ্গা চোপা দেখে রিয়ালাইজ করেছিলাম যে বুড়াদা ওই সেম মডেলেরই প্রাণী ছিল। সেম দোষে দুষ্টও। ফলে দোকান ভর্তি অরণ্যদেব সাজিয়ে রাখলেও, বুড়াদা কোনদিন পানশালায় গিয়ে দুধ পান করার পন্থাতে অনুপ্রেরিত হয়নি। একটি বাজে উপমা সরূপ বলা চলে যে এতেই প্রমাণ হয়ে যায়...শুঁড়ি কখনো নিজের হাঁড়ির মদ চেখে দেখে না!
বুড়াদা দুম করে মরে গিয়েছিল, কমার্স কলেজের সোশালে রাতভর বাংলা মদ পান করার পরে ডজনখানেক ডিমসেদ্ধ ভোজন করে, পরদিন সকালে।
টাউনের ওই সবচেয়ে বড় ওপেন এয়ার কমিক্স (এবং ম্যাগাজিন) শপ-টিও এরপর উঠে যায়!
৩
তাহাদের কথা
শুরুর দিকে দেখতাম ইন্দ্রজাল কমিক্স পুরোপুরিই বিদেশী খেলোয়াড়ে তৈরি ক্লাব। অরণ্যদেব, ফ্ল্যাশ গর্ডন, রিপ কার্বি এবং জাদুকর ম্যান্ড্রেক...এরা সব সে ক্লাবের এক একজন ফ্রন্টলাইন প্লেয়ার।
স্বদেশী কেরামতি দেখাতে সেই জগতে একদিন এলো এক ভারতীয় নায়ক। বাহাদুর। "শোলে" সিনেমা আর চম্বলের ডাকু গব্বর সিং ভারত বিখ্যাত হয়ে যাওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে এই নায়কের আগমন। আর সেই জন্য, সিনেমার হিট ফর্মূলার আঁচ এই গল্পেতেও জল গরম করার তাপ যুগিয়েছিল অনেকদূর অবধি।
নায়ক বাহাদুরের বাবা মা চম্বলের ডাকাতের হাতে খুন হয়। প্রথম দিকের গল্পে ছিল, সেই ডাকাতদের শায়েস্তা করতে বাহাদুর সাইকেলের রড দিয়ে দিশী বন্দুকের নল তৈরি করছে একটি কামারশালায় বসে বসে। সেই দৃশ্য একদম মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। এরপর কতদিন যে নিজের সাইকেলের পেটের তিন কোনা রড সমন্বয়ের দিকে লোভী চাউনিতে তাকিয়েছি আর বেচারা সাইকেল অঙ্গহানির আশংকায় শিউড়ে উঠেছে, তার হিসেব নিকেশ নেই কোনও।
খালি হিরো একা গল্প জমাতে যথেষ্ট নয়। তাই অরণদেব স্টাইলে বাহাদুরকে দেয়া হয়েছিল ছামিয়া নামে একটি কুকুর আর বেলা নামে একজন বান্ধবী! বেলার সাথে বাহাদুরের বিয়ে টিয়ের কোনও ব্যাপার গল্পে ছিল না। তার মানে, আজকের ভাষায়, ওটা লিভ ইন রিলেশনই হবে।
বিদেশী কমিক্সগুলোর লিখিয়ে আঁকিয়ের নাম গোত্র জানা ছিল না। তবে বাহাদুরের বেলায় লেখক জগজিৎ উপ্পল এবং শিল্পী গোবিন্দ ব্রাহ্মানিয়ার নাম ছাপা থাকতো প্রতিটি কমিক্সে। এছাড়া অরণদেব আর ম্যান্ড্রেক-এর কমিক্সের প্রচ্ছদে পাতা জোড়া ছবির নীচে “Shehab” নামে একটা সই চোখে ধরা দেয়ায় অনেকদিন অবধি ভেবেছি, এই লোকটাই বোধহয় কমিক্সগুলো আঁকে। তবে আঁকা বোঝার চোখ আরেকটু তৈরি হলে তখন চোখে ধরা দিলো যে বইয়ের বাইরের আর ভেতরের পাতার ড্রয়িঙে বিস্তর ফারাক। Shehab কেবল মাত্র কভার পেজগুলোই আঁকতো। যার ভিত্তিতে ধারণা করা যায় যে বিশ্বে আর কোথাও বোধহয় চটি বইয়ের আকারে অরণ্যদেব-এর কমিক্স প্রকাশিত হয়নি।
স্কুলের ক্লাসরুমে বেআইনি কমিক্সের আনাগোনা জীবনের আরেক রোমাঞ্চকর অধ্যায়। ক্লাস মেট-দের সাথে কমিক্স আদান প্রদানের অভ্যেসটা, ক্লাস চলার ফাঁক ফোকরে বেশ শেকড় গেড়ে বসেছিল, ক্লাস সেভেন এইটের সময়। হাতে নতুন বই এলে ক্লাস খতম হওয়ার তর সইতো না এক এক দিন। স্যার পড়াচ্ছেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আর আমি তখন অরণ্যদেব-এর গোপন কুয়োর ভেতরে রেডিও রুমে পৌঁছে গেছি। সেখান থেকে ডেনকালী পুলিশ দপ্তরের সাথে রেডিওতে জরুরী কথা বলছেন অরণ্যদেব। আমি তার অদৃশ্য সাক্ষী।
এমন সময়, আচমকা কানে একটি বলিষ্ঠ মুঠির থাবা! ব্যাথায় মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। আর চোখের পলকে কমিক্স বাজোয়াপ্ত।
এরপরের দৃশ্য হলো, কান ধরে বেঞ্চির ওপর দণ্ডায়মান হওয়ার দণ্ড।
আমাদের হিন্দী শিক্ষক ঝাঁ স্যার, সন্ধি সমাস একাকার করে এক হুঙ্কারে যখন এই দণ্ড শোনাতেন, সেটার ধ্বনি ছিল- "বিদ্যুৎবেগেবেঞ্চিরওপরচড়!"
ওই মহামন্ত্রের শক্তি, নিঃশব্দে পাঠ করলে মালুম হবে না বন্ধু। গলাটা সাফ করে নিয়ে একবার চেঁচিয়ে উচ্চারণ করে দেখো, " দিমাগ কা বত্তি" জ্বলে উঠবে!
স্যার স্বয়ং এরপর ক্লাস মুলতুবি করে দিয়ে, কমিক্সটি নিজে চুপচাপ বসে বসে পড়তেন। আর কোনও কোনও স্যার চক্ষুলজ্জার খাতিরে ক্লাসে বসে ওটার পাতা ওলটাতেন না বটে। তবে ক্লাস শেষে গম্ভীর মুখে বইটি বগলদাবা করে নিয়ে ততোধিক গম্ভীর স্বরে বলতেন, "ছুটির পরে টিচার্স রুম থেকে ফেরত নিয়ে যাবি!"
জীবনে উন্নতির লক্ষণ হিসেবে এটাকেই আমি সূচক গণ্য করেছিলাম। কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় টিউশনি করতাম চুটিয়ে। সেই সময় অবশেষে পাশা উলটে দিতে সক্ষম হই। কমিক্স পাঠের দোষে একদিন যে ক্লাসে কান ধরে বেঞ্চে দাঁড়াতো, ছাত্রকে অঙ্ক কষতে দিয়ে সেই একই ব্যক্তি ছাত্রের ষ্টকের ইন্দ্রজাল কমিক্স পড়ছে রীতিমত আয়েশ করে!
এটাকে উন্নতি বলবো না তো আর কাকে বলব?
ছবিঃ লেখক
বাল্যকাল আর বেতাল।
ReplyDeleteআষ্টেপৃষ্ঠে এক হয়ে আছে আজও স্মৃতির পাতায় পাতায়। সময় পেলেই আজও ছেলেকে নিয়ে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে দেখি।