উপদ্রুত এলাকা থেকে: একটি পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ অসীম কুমার বিশ্বাস
ওপরের অনুচ্ছেদটি থেকে মহাভারত আনুষঙ্গিক নামগুলোকে বদলে যদি "উপদ্রুত এলাকা থেকে" অনিন্দিতা গুপ্ত রায় বলা হয়! তাহলে? সেটার উত্তর হল, "আসছি বলে পরস্পর অনন্তের দিকে চলে গেল যে সরল রেখারা তাদের দেখা হওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না…." বইটার কালো ব্যাক কভারে সাদা হরফে লেখা এই লাইন। রাজা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞ হয়েছিল মহাভারতের একেবারে শেষে। ঠিক "উপদ্রুত এলাকা থেকে" শেষ পৃষ্ঠায় সাদা হরফগুলো যেন বইয়ের দিক নির্দেশ করে। আদৌ কি দিক নির্দেশ করে? কারণ সরল রেখাদের ফিরে আসার কোন প্রশ্নই ছিল না! এই অস্বস্তি জড়ানো লাইনগুলো শ্লোকের শরীরে কবিতা হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে।
"উপদ্রুত এলাকা থেকে" কাব্য গ্রন্থটিকে মোট ২৪টি পর্বে ভাগ করেছেন কবি। প্রতিটি পর্বে একাধিক শিরোনামহীন কবিতা। প্রতিটি কবিতায় একটি করে খন্ড, এই খন্ডগুলো জুড়ে একটা ভূগোল তৈরি করেছেন কবি, যা শুরু হচ্ছে "পাহাড় পর্ব" থেকে শেষ হচ্ছে "পাঠ পর্ব" এ গিয়ে। কাব্যগ্রন্থটির শুরুতে প্রস্তাবনার ঢঙে শ্লোকের মতোই কবি উচ্চারণ করেছেন,"লিখিত অক্ষর আসলে মায়ানগরের ভুলে যাওয়া মানচিত্র।" পরের লাইনেই লেখা, 'দূরত্ব শব্দের কোন ভূগোল নেই শুধু কিছু দরজা জানলা আছে…" এ যেন শ্লোক-প্রস্তাবনা। "এলাকা" "মানচিত্র" শব্দগুলো যে ভূগোল নির্মাণ করে সন্দেহাতীত ভাবেই চরম রাজনৈতিক, উপদ্রুপকারী ও অস্বস্তিকর। মানচিত্র শব্দের পাশে কবি বসাচ্ছেন "মায়ানগর"... বিশুদ্ধ কবিতা হয়ে উঠছে এলাকা, ভূগোল ও দখল। তারপর সেই মোক্ষম উচ্চারণ "দূরত্ব শব্দের কোন ভূগোল নেই শুধু কিছু দরজা জানলা আছে।" ভৌগোলিক "দূরত্ব" শব্দটির ভেতর যতটা আপেক্ষিকতা থাকে তার চেয়েও বেশি থাকে দরজা জানলা। সেইখানেই কবিতা থেকে শ্লোক হয়ে ওঠে … মন্দ্র সঙ্গীতের মত। দরজার সমানে জানলার সমানে পাঠককে দাঁড় করান অনিন্দিতা।
বইটি শুরু হচ্ছে "পাহাড় পর্ব" দিয়ে। কবি বলছেন, "শীর্ষবিন্দু থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে নামছে সমতলে।/ আমরা বলছি নদী, বলছি পিপাসা।" পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা জলবিন্দুর নদী হয়ে যাওয়ার শ্লোক। পিপাসার আখ্যান। নদী ও পিপাসা শব্দ দুটো পাশাপাশি বসছে, মধ্যিখানে ক্রমশ রচিত হচ্ছে এক সুবিস্তীর্ণ উপত্যকা, "ছদ্ম সরোবরে হৃদপিন্ড", এই তৃষ্ণা, পাথরের বুকের জল ঝর্না হয়ে নামে না পাহাড় থেকে। সে জল যেন পাখির ঠোঁট এর বিন্দু। তীব্র উচ্চারণ, অপেক্ষা বাড়তে বাড়তে পাহাড়ের মত বিরাট আত্বিত্বে নিচে "ছদ্ম সরোবর" হয়ে ওঠে আর ভূগোলকে "এলাকা" বলে নিজের করে নেন কবি। এলাকা কখনো মন হয়ে যাচ্ছে পর মুহূর্তে দেশ…
আগেও বলা হয়েছে সৌতি কোনো গল্প সরাসরি বলেন না। আবছায়া আর রহস্য তৈরির মধ্যেই যেন তাঁর মুন্সিয়ানা, যা তার পরের গল্পে যাওয়ার আকর্ষণকে আরো বাড়িয়ে তোলে। অনিন্দিতার ভাষার নিজস্ব একটা চলন আছে। অসম্ভব মেধাবী ডিক্সন, কোথাও একটা বাড়তি শব্দ রাখেননি সে। প্রাণী দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গর মতোই 'বেসিক মিনিমাম ' শব্দ ব্যবহার করে কবিতার শরীর নির্মাণ করেছেন। কিন্তু সেই শব্দের আকর্ষণ সৌতির বলা গল্পের মতোই। "মাছ পর্ব" এ "কড়াইয়ে যা পুড়ে যাচ্ছে – সামান্য আঁশটে গন্ধ ছাড়া তাতে কোনো নদী লেগে নেই।" না থাকা নদীর চলন, যা ভীষণ ভাবে না থেকেও উপস্থিত। তারপরই বলেছেন, "...সাজানো হয়েছে লালে হলুদে তারপর সাবধানে নামিয়ে দিয়েছে তেলে – … কাটা খুলে বেরিয়ে আসছে গোলাপি স্পর্শ/ চমকে উঠে ছিটকে পড়ছে দেওয়াল আর ছাদে। যে শব্দ শুনে কান্না ভাবছো তা আসলে হয়তো হাওয়ার যাতায়াত " কবি গন্ধের অনুষঙ্গ দিয়ে সমস্ত রন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন সেখানে গোলাপি স্পর্শে প্রেম থাকেনা, তীব্র অস্বস্তি থেকে। কবি স্পেস তৈরি করেন হওয়ার যাতায়াতের, কান্নার অনুপস্থিতিই, একমাত্র সত্য। প্রথম লাইনটি শুরু হচ্ছে কড়ায় যা পুড়ে যাচ্ছে… পুড়ে যাওয়ার গন্ধ হাওয়ার যাতায়াত হয়ে ফিরে আসে। এই কবিতায় কোন কন্যা থাকে না। অনিন্দিতা এক চিরন্তন ব্যথার ছাপ রেখে যান কী অসম্ভব সাবলীল ভাবে!
"বিদায় পর্বে" অনিন্দিতা লিখছেন, "অপেক্ষা ফুরায় না শুধু অপেক্ষায় আছি বলাটুকু থেমে যায়.… চলে গেলে ডাকবে না ফিরে এ কথা জানার পর নিজের কাছেই গুরুভার" । না ফুরনো অপেক্ষার মধ্যে আবার যে পরিসরকে সে ব্যবহার করেছেন তার ভেতরে একটা নদী একটা সমুদ্র একটা পাহাড় একটা আকাশ একটা দেশ একটা ভূগোল একটা দূরত্ব একটা জানালা একটা দরজা আরো জাগতিক বিষয়-আশয় আর যাবতীয় প্রেমকে আঁটিয়ে তোলেন। "অপেক্ষায় আছি বলাটুকু থেমে যায়" অথচ এই বলার মধ্যে আরো অপেক্ষাকাকে দীর্ঘ করে তোলে, হাহাকারের শব্দ অনুরণিত হতে থাকে। কী নিপুণ ভাবে জড় আপেক্ষিকতাবাদ ভাববাদে অনূদিত হয়, দূরত্ব তো অপেক্ষাবাদের একক। অপেক্ষারা কবিতা হয়ে ওঠে, দূরত্ব ঘোচে। অবিরাম ভালাবসা প্রেম চুইয়ে পড়ে "অপেক্ষা" শব্দের মধ্য দিয়ে কান্নার মত। অথচ কবি এখানে ভীষণ সংযত শুধু "অপেক্ষায় আছি বলাটুকু" থেমে যাওয়ার মত কবিতাও এখানে থেমে যায়। বাকি না বলা যন্ত্রণা ধ্রুপদী স্তোত্রর মত রেশ থাকে পাঠক মনে।
"প্রাত্যহিক পর্বে", বেড়াতে যাওয়ার আগে আয়নার সামনে দাঁড়ান কবি। চোখের জায়গায় অ্যাকোরিয়াম…সাদাকালো নুড়ি আর জল। ঠোঁট বরাবর। নৌকো আর ঠোঁটকে একই জায়গায় রাখেন, ভাসানের গল্প বলেন, "হাসির মুদ্রায়"। এখানে সমুদ্র জীবনের এতগুলো উপমা অনুষঙ্গ নিখুঁত এবং অপরিহার্য ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সত্যিই যেন ফ্যাকাশে দিগন্ত রেখাকে স্পর্শ করে অক্ষর। শেষে পাটাতনের আশ্রয় নেয় জীবন। মাছঘর আকাশ হয়ে যায়। নিজের জীবন কে কী নিদারুণভাবে হাসির ছদ্মবেশে লুকিয়ে তিনি ভাসমান জীবনের গল্প বলছেন অ্যাকোরিয়াম আকাশ হয়ে যাওয়ার গল্প বলছেন আমাদের সকলের হয়ে। তখন আকাশ স্পর্শ করার না পারার যন্ত্রণা, কবিতাটি বিশেষ থেকে নির্বিশেষে হয়ে ওঠে।
অন্ধতা পর্বে "ফিরে আসার গল্প বড় বেশি কল্পনা প্রবণতা" বিচ্ছেদ বারবার করে ফিরছে তার লেখায়, ফিরে আসা ততই অমূল্য হয়েছে। "তাকে ভিখিরি ভেবে তোমার স্পর্ধা খুচরো বিষাদ গোনে। চশমা বদলের আগে খোঁজ নিলে জেনে যেতে জন্মান্ধ আমার কোন চাঁদে বা সূর্যে কিছু তাই যায় আসেনা!" অপূর্ণতাকে কবিতায় রূপান্তর করেন করেন। পাঠককে স্বস্তি দেন না, "খুচরো বিষাদের" মত অস্বস্তি লেগে থাকে "উপদ্রুত এলাকায়।"
"উপদ্রুত এলাকা থেকে" কাব্যগ্রন্থে অনিন্দিতা প্রতিটি পংক্তিতেই বিশুদ্ধ কবিতা রেখে গেছেন। অন্যভাবে বলা যায়, পাঠককে পঙক্তির মধ্যে কবিতা খুঁজে বেড়াতে হয়নি। অনিন্দিতার ভাষা যেমন স্বকীয়, স্বাধীন, ঠিক তেমনি কিছুটা রহস্যাবৃত অথচ জটিল নয়। এই রহস্য পাঠককে একটি অন্য স্তরে পৌঁছে দেয়। "জ্যামিতি পর্বে" চরকা নিয়ে "এক বুড়ি শুধু সাদা সুতো কেটেই যাচ্ছে একা একা শীতের আয়োজনে।" "একা" শব্দটির দুইবার প্রয়োগ অনন্ত এক কুয়াশা মাখা শীতের অপেক্ষাকেই ইঙ্গিত করে আবার সেই স্পেস তৈরি করে চরকার জ্যামিতিক নকশায়। অপেক্ষার নাম হয় শীতের আয়োজন। অপেক্ষা হয়ে ওঠে জ্যামিতিক। এরকম "বর্ষা পর্ব" শুরু হয় "সারাটা বছর নদী তোমার বুক পকেটে লক্ষ করনি ভেজা ভাব থমকানো চোখ টানটান ভ্রু ভাঁজ।" প্রকৃতিকে বকুলের গন্ধ বিপদসীমা ঘোলা জল নৌকো চিহ্ন দিয়ে বর্ণনা করেন। বর্ণনার জন্য বেছে নেওয়া শব্দ খুব চেনা হলেও, প্রথাগত কাব্যিক নয়, বহু ব্যবহৃত নয়। অনায়াসে সেই শব্দের ব্যবহার মেধাবী ছাপ রাখে বৃষ্টির ফোঁটার মত। মেধার সাথে যুক্ত হয় এক শুদ্ধ অপরূপ মায়া, এখানেই অনিন্দিতা আলাদা হয়ে ওঠেন। পরের লাইনে লেখা হয় "বজ্রপাতের ঘোরে খান খান হতে দেখো নিজেকেই লিখছে রোজ নদীর পাতায়।" বর্ষা আবার নতুন করে নামে সেই উপদ্রুত এলাকার "জানলা ও দরজায়।"
"সমীকরণে চিরকাল অপটু আমি হাওয়া থেকে কুড়িয়ে তুলি ফেলে দেওয়া পুরনো চিঠিদের" "উড়ান পর্বে" অথবা "কুয়াশা পর্বে" "ফাঁকা কাঠামোর মধ্যে শুধু ট্রেনের হুইসল প্লাটফর্ম ছেড়ে যাওয়া বাজাচ্ছে" দুটো মধ্যে যে হাহাকার লুকিয়ে থাকে তাকে যত্ন করে কুড়িয়ে নুড়ি পাথরের মত কবি আশ্রয় দেন চোখের তারায়, সেই নুড়ি দিয়ে ঠোকাঠুকি করতে করতে যে কবিতা লেখা হয় তা পাঠককে আবার স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। এই যত্নের কাছে নতজানু হতে হয় পাঠককে। "বাগান পর্বে" তিনি বলেন সেই সমস্ত ফুটে ওঠাকে আমি ব্যাখ্যা করতে চাইলাম…নোলকের রং ফেরানো ঝুমঝুমি!" খেয়াল করলে বোঝা যায় সমস্ত রকম কাব্য সম্ভাবনাকে ভেঙে নোলকের রং ফেরানো ঝুমঝুমির মতন শব্দ তিনি ব্যবহার করছেন। এখানটাই তিনি নিজের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করছেন হওয়ার বুকে।
"গম্ভীরা থেকে ভাওয়াইয়া অব্দি একটা মানচিত্রের উপর একটানা বৃষ্টি" ঝরলে বোঝা যায় উত্তরের ভূমির যে বিরাট এলাকা বা অঞ্চল তা গান হয়ে আসে, অবশ্যই তা লোকগান। অবশ্যই অপরিচিতের হাসির মতো তিনি রূপান্তর পর্বে সমস্ত অংশ জুড়ে যেন এক বিস্তৃত ভূমির কথা বলেছেন মালদার গঙ্গা ভাঙন থেকে বারোবিসার কালজানি সমস্ত যাপন উঠে এসেছে রূপান্তর পর্বে। কবিতার বইয়ে ভূগোল লেখা হয়। অসম্ভব মেধা থাকলে কবিতার মধ্যে মাত্র এক পৃষ্ঠার মধ্যে ধরে রাখা যায় একটা বিস্তীর্ণ অংশ একটা পান্ডব বর্জিত অঞ্চল ও তার ইতিহাস সম্ভাবনাকে। ভূগোল এই এলাকা এই মানচিত্র কখনো কবিতার থেকে সরে আসেনি, এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। "ফানুসের গায়ে স্বাধীনতা শব্দটি উড়ে যাচ্ছে সীমানাটি নিয়ে।" মানচিত্রের থেকে মানচিত্রান্তর হচ্ছে সীমানা ভাঙছে, সীমানার পুনর্নির্মাণ হচ্ছে এই কয় লাইনের মধ্য দিয়ে। বলছেন "পালাতে পালাতে নিজেরাই মানচিত্র হয়ে উঠি কবে। যতদূর সরে আসি ততদূর নদী ততদূর ভাঙ্গনের নতুন কাহিনী, ঝপঝপ করে ঘুমের ভেতর মাটি ধসে ভাঙা কাঁচের ওপর দাঁড়িয়ে পায়ের ওড়ানোর গল্পে আমরা তো লালন লিখেছি শুধু ফকির লিখিনি।" তিনি লালন ও ফকিরকে পাশাপাশি বসিয়েছেন। রূপান্তর পর্বে তার উপদ্রুত এলাকা মায়ের যত্ন হয়ে ওঠে যত্ন "লালন" হয়ে ওঠে বাকিটা ফকিরের গল্প…
প্রেম ও পর্ব দুটি শব্দের মাঝে একটা হাইফেন। "আচমকা মাটির কাছে নেমে এলে প্রকৃত দূরত্ব সরে যায় আকাশ" অপরিহার্যতা পাখির স্বভাব। প্রকৃত "দূরত্ব" শব্দটি আবার ফিরে এসেছে। দূরত্ব কখনো যে মানসিক কখনো ভৌগোলিক কখনো বা শুধুই রাজনৈতিক। "উপদ্রুত এলাকা থেকে" "প্রেম-পর্বের" যে রূপ অরন্য বা কেল্লা পর্বে বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে সেখানে বলেন এই গণহত্যার বদলে আমাদের দেওয়া হবে স্বর্গের সিঁড়ি দৌড়বাজ হাইওয়ে উজ্জ্বল ভেপার ল্যাম্প কোন অন্ধকার অথবা ভিখিরি নেই। কবি লেখেন "বাতাসের চেয়েও দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল যে শ্রমণ তাকে অনুসরণ করি।" লক্ষ্যণীয় কবির ব্যাপ্তি, শ্রমণকে অনুসরণ করছেন যেন মাধুকরী পর্বে। ভূগোল প্রসারিত হচ্ছে, এলাকা প্রসারিত হচ্ছে, ধর্ম প্রসারিত হচ্ছে স্তোত্রর মত, সঙ্গীতের মত। এখানে "দ্রুত পা" শব্দটি যেন মার্গ সংগীতের ঝালায় এসে পৌঁছেছে সর্পযজ্ঞে উচ্চারিত গীতমালা।
স্বদেশ পর্বে গিয়ে অনিন্দিতার লেখা কিছুটা অভিমুখ বদলায়। "তীব্র বমি ভাব স্থির থাকতে দেয় না শুরুর দিকে পোয়াতি মায়ের মত মর্নিং সিকনেস গুলো জলের দিকে চেয়ে থাকলে কম আসে।" জলের ঢেউ এর সাথে যে সখ্য কবি বোধ করছেন ঠিক বিপ্রতীপেই থাকে তার তীব্র বমি ভাব। লিখছেন স্বদেশ পর্ব লিখছেন প্রতিস্পর্ধা নিজে অবস্থান থেকে যেখানে "আদার বেপারীর নাম নেই ধাম নেই স্থায়ী ঠিকানা নেই।" যেখানে একটি সাধারন রেখা সরল ও নমনীয়। যাকে ওরা পারাপার বলে ডাকে মাঝে মাঝে। এই পারাপার শব্দের শব্দের মধ্যে অনন্ত দেশ সম্ভাবনাকে তিনি চিহ্নরূপে ছেড়ে দেন পাঠকের কাছে। তারপরই বলেন, "আরো কাছে সরে এল অন্ধকার।" মর্নিং সিকনেসে থেকে কবি স্পষ্ট উচ্চারণ "সব ঝুটা হ্যায়" এ যেন এক স্বদেশ নির্মাণের পর্ব শুরু হয়। অনিন্দিতা স্বদেশ ও তার ধারণা লম্বা লম্বা চুলের মতন গোছা পাকিয়ে ওঠা দাগ চিহ্ন ও সীমান্ত। বোঝা যায় স্বদেশ নির্মাণ হচ্ছে চিহ্ন ও সীমান্ত দিয়ে এ তো স্বাভাবিক, আঁকা শব্দটা স্বদেশকে চিহ্নিত করতে এতটা রাজনৈতিকভাবে পূর্বে কখনো ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা সন্দেহ থাকে কবিতা মা চুলের গোছা দাগ কিভাবে আটপৌরে বয়ান থেকে রাজনীতি হয়ে যায় তার এক বড় উদাহরণ এই স্বদেশ পর্ব।
আবার অপেক্ষা পর্বতে লেখা হয়,"আর শুধুমাত্র আলো খুঁজতে বেরিয়ে কেউ কেউ ফিরেই আসেনা, চিরকাল" লক্ষ্য করলে বোঝা যায় ফিরে"ই" শব্দটার মধ্যে ই এর ব্যবহার। অনিন্দিতা সেই দার্ঢ্য রূপান্তরিত হয় শব্দের একটি মায়াতে, একটি অসহায়তা। যেখানে কবি অনেক মমতাময়ী, তার অপেক্ষার হাহাকার যেন "ই" শব্দটাই থাকে তার সম্পূর্ণ চেয়ে থাকাকে বোঝাতে কমা দিয়ে তিনি কাল ইঙ্গিত করেন, চিরকাল। অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে যে অপেক্ষার নির্মাণ হয়, কবির বেদনা পাঠকের মূল্যবান সঞ্চয় হয়ে ওঠে চোখে রাখা নুড়ি পাথরের মত। পর্বে, "কলসির মাথায় ভর দুপুরে পেরিয়ে আসা পিপাসা ততক্ষণ দরজা থেকে বেশ কিছুদূর। অথচ সেই শূন্য পাত্রের দিকেই ঘুরে যাচ্ছে পাথরের টুকরো তোমার ঘর থেকে।" পাথরের উড়ে যাওয়া দেখছেন কবি নিজেকে রিক্ত করে শূন্য করে। শেষে বলছেন, শিকারি কুকুরের চোখ খুঁজেও পাবেনা। শূন্য পর্বে লিখছেন "নিরাপদ দূরত্ব থেকে নৌকা ভাসুক। হে নাবিক অতিবৃষ্টির চালে ডালে আমি কেউ নই।" "হে নাবিক" বলে সম্বোধন এবং তালে ডালে বসিয়ে দেওয়ার থেকে এক উদাসীন বর্ষাকাল এবং নিরাশক্ত অভ্যাস যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরে ঝরে পড়ে ঝরে চলে। শূন্যতা আসলে হাড়িতে চাল ডাল এর মতোই এক উপস্থিতি বৃষ্টির মতোই সত্য শুধু দূরত্ব শব্দটিকে তিনি এখানে ব্যবহার করে যে স্ববিমুক্তি ঘটিয়েছেন, নিজেও যেন গল্প এর চরিত্র হয়ে উঠছেন, সে চরিত্র সৌতির মত গল্প বলে যাওয়াই যার একমাত্র কাজ। বন্যা পর্বে, "উদ্দেশ্য বা বিধেয় কোন কিছুই বিবেচ্য ছিল না সামান্য পথের তফাতে পৌঁছানোরও কথা ছিল না।" উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় চিহ্ন জলোচ্ছ্বাসের কথা মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টির কথা। আর শিকড়ের অন্যমনস্ক চলাচল কোন সংকেত ছাড়াই উপড়ে ফেলে গাছ। কবি সেখানে স্থির। বন্যার জলের উপরিভাগের দৃশ্যমানতা নয় এ যেন এক চোরা তীব্র স্রোত যা শিখরহীন গাছটাকে মাটি সরিয়ে সরিয়ে একা করে দেয়।
এই কাব্যগ্রন্থর শেষ পর্বে এসে "পাঠ পর্ব" এ কবি অমোঘ উচ্চারণ করেন, "যে আগুন পোড়ায় আর যে আগুন আলোক ঘরে ধর্মত উভয়েই এক।" এমন একটি কবিতা পঙক্তির জন্য যেন চব্বিশ পর্ব ধরে অপেক্ষা থাকে পাঠকের। পুরানো ও আলো করার মাঝে থাকে আগুন। আগুনের শিখা অক্ষর হয়ে ওঠে চব্বিশ পর্বে। সৌতি আসেন জনমেজয়ের যে যজ্ঞে এখানে এসে সৌতি গল্প বলেছিলেন মহাভারত লেখা হয়েছিল শ্লোকে। বারো বছর ব্যাপী চলা সেই যজ্ঞে যে আগুন জ্বলেছিল তার অনির্বাণ শিখা উৎসারিত স্তোত্র গান হয়ে মিশে গেছিল এই ভারত ভূখণ্ডে। ভূখণ্ড নির্মাণ হওয়া শুরু হয় নতুন করে মহাকাব্যিক যুগে… অনিন্দিতার গ্রন্থের নাম উপদ্রুত এলাকা থেকে… চব্বিশটি পর্বে বিভক্ত একাধিক খন্ড…শেষ বইয়ের পিছন পৃষ্ঠায় কালোর মধ্যে সাদা দিয়ে লেখা "আসছি বলে পরস্পর অনন্তের দিকে চলে গেল যে সরলরেখা তাদের দেখা হওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না" শুধু কিছুটা আগুন জ্বালানোর প্রয়াস ছিল, সে মন্দ্র শ্লোক আর আগুন মিলে অপূর্ব এক আলো জ্বলেছিল, সে কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।
উপদ্রুত এলাকা থেকে
অনিন্দিতা গুপ্ত রায়
সৃষ্টি সুখ
মুল্য ১২৫ টাকা।
Comments
Post a Comment