প্রমত্ত প্রবজ্যাঃ সুকান্ত গাঙ্গুলী
প্রমত্ত প্রব্রজ্যা
সুকান্ত গাঙ্গুলী
১
এ এক হাস্নুহানা জীবন।
শ্রীমতির তীরে তার নাচ, গান, কথকথা। জ্যোৎস্নাবিধুর এই দেশের প্রতিটি রাতই মায়াময়। দূর থেকে গান ভেসে আসে। সঙ্গে বাদ্য। চরাচরের কোথাও হ্যারিকেনের আলোও জ্বলে কিনা বোঝা যায় দায়! ব্যাকুল বাওকুমটা বাতাস কেবলি বয়ে যায়, ফিরে ফিরে আসে। আর শ্রীমতি কি কোমর দুলিয়ে নাচে! মেঘনাদ উদ্দাম বাজায়। প্রতিরাতে এই শব্দ শুনতে শুনতে অমোঘ ঘুমের মধ্যে ঢুকে যাওয়া কি ভালো?
একেক রাতে ঘুমের মধ্যেও তো সেই শব্দ চলে আসে। ঘুম ভেঙে যায়। ভোর রাতে উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেই দেখা মেলে নদীর। তার একেবারে পাশেই তো ঘর। সেই নদীতে জল নেই। শুধুই কাদা। অসংখ্য নাম না জানা পাখি তখন সেখানে নামতে শুরু করেছে। জল বিহীন এক আশ্চর্য নদীর বুকে থলথলে কাদার মধ্যে লুকিয়ে থাকা পোকামাকড় খুঁটে খুঁটে নিচ্ছে তারা। তাদের পিঠের পালকে জ্যোৎস্নার আলো পড়ে তা পিছলে যাচ্ছে নদীবক্ষে। আসলে কাদায় গিয়ে পড়ছে। খুব কাছে গিয়ে দেখলে দেখা যাবে সেখানেও তারা যেন মাঝে মাঝে ঝলসে উঠছে। এখানে গভীর রাত অবধি গান হয়। এই তো সবে তা শেষ হয়েছে। ভোরের আলো এখনই ফুটবে। তার আগে পাশের জঙ্গল থেকে বিচিত্র আওয়াজ আসছে।
এটা তো ফুলমতিয়ার দেশ। এখানে সে লাস্যময়ী, লাজহীনা। হাঁটা পথে কতটা বা দূর ওই টিলা! নদীর পাশেই তো।
কাঠের বারান্দা, সিঁড়ি দিয়ে নেমে সে চলতে শুরু করে। নিস্তব্ধতার মধ্যে মোরামের শব্দ ওঠে। বন্দুকটা ডানহাতের তালুতে শক্ত করে ধরা। ব্যারেল সামনের দিকে ঈষৎ ঝোঁকানো। পকেটে গুলির প্যাকেট। শ্রীমতির ধার ঘেঁষে সে হেঁটে চলে। ঘাসে ঘাসে পায়ের আওয়াজ ওঠে। এসবে তার কি যায় আসে। পথ তো চলতেই থাকে। শুধু বাঁক বদলে বদলে যায়। এই সত্য তার থেকে কে ভালো জানে। না হলে কেন এখনও সে এই নিঃসঙ্গ শ্রীমতির তীরে বারবার চলে আসে। কিসেরই বা এই পথ চলা।
দূরের টিলার উপরে কি আজ ওঠা যাবে। নদী পেরিয়ে। সেখানে তো কাদা, পা কি ডেবে যাবে? তার তো পড়নে ব্রিচেসসম পাজামা। নীচের দিকটা অসম্ভব রকমের চাপা। কিছুটা যে তুলে নেবে তারও তো জো নাই। নদী পাড় হওয়াটা কি খুবই জরুরী। না হলেই বা কি হয়। এপাশেই তো কত পাখি। কিন্তু নদীতে নামলেই তারা উড়ে যাবে। সে ঠিক জানে। এর আগেও বহুবার এমনটা হয়েছে। এমনকি তা নিয়ে দেজাভু অবধি, কি মুশকিল!
যা হয় হোক। আজ তো নদীতে নামতেই হবে। দুধ সাদা, টাইট পাজামা সমেত লায়েক নদীর বুকে পা নামিয়ে দেয়। শ্রীমতি বহরে অধিক ছিল না কোনওদিন, তার জানা আছে। এই ভোরে সে শান্ত, স্লেট রঙের। তার বুকে বুকে পাখির ঝাঁক মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছে। আবার কিছু দূর উড়ে গিয়ে বসে পড়ছে। লায়েকের শান্ত গমনে যদিও তারা ঠিক উড়ে যায় না, সরে সরে যায়। যেন বা পথ করে দেয়। এত অসংখ্য পাখি কোথা থেকে আসে। চরাচর ভেদ করে আবার কোথায় চলে যায়, লায়েকের এসব ভাবার বিষয়াবলীর মধ্যে পড়ে না। সে ভয়ানক মাংসাশী। পাখির উড়াল নিয়ে তার কোনও চিন্তা নাই। সে বন্দুকটা আরও শক্ত করে ধরে কিছুটা বগলের দিকে টেনে নেয়। কোনও কোনও জায়গায় কাদা ও পাঁক তার পায়ের কাপমাসেল অবধি ডুবিয়ে দিচ্ছে। একেকটি পা তুলে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে স্টেপ ফেলতে বেশ কিছুটা সময় বয়ে যাচ্ছে। সামনে কি কাদা আরও বেশী গভীর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে? যদি তাই হয় তাহলে তো নদী পাড় হওয়াই মুশকিল হবে তার পক্ষে।
বেশ কিছুক্ষণ লাগাতার প্রচেষ্টার পর এখন শ্রীমতিকে সে তার ঠিক পিছনে দেখতে পাচ্ছে। ভোরের আলোয় পাশ ফিরে শুয়ে আছে। যদিও সে এখন আর তার দিকে তাকাতে চাইছে না। সেই নাচ, গানের আওয়াজ কি গভীর রাতে এখানে এলে শোনা যায়? হয়তো যায়।
এখানে একটা ছোট্ট দহ আছে। নদীর ধার ঘেঁষে। তার পাশে গাছ। সবুজ একেবারে। তাতে খুব ছোট ছোট ফুল ফুটেছে। খুব মৃদু অথচ মিষ্ট ঘ্রাণ। লায়েকের নাকে এসে লাগছে। সেই সঙ্গে বয়ে চলা স্বচ্ছ বাতাসের গন্ধ তাকে একেবারে পাগল করে তোলে। দহের জলের পাশে সে বন্দুকটা রাখে। পাজামা সহ প্রায় কোমড় অবধি ধুয়ে ফেলে। সে জানে কিছুক্ষণ পড়েই পাজামা শুকিয়ে যাবে। তারপর একেবারে ফ্রেশ। সে আবার হাঁটতে শুরু করে। এবার ধীরে ধীরে জঙ্গল শুরু হয়। এই অরণ্য গভীর নয়। এর ছায়া দীর্ঘতর নয়। শ্রীমতির অতীত অবসম্ভাবী প্রমত্তা। তার সঙ্গে সাযূজ্য বজায় রাখতো এই বনভূমি। কিন্তু আজ তো আর তেমনটা নাই। কিছুটা গাছগাছালি পেরিয়ে গেলেই নাবাল ভূমি। তারপর ঘাস বিছানো পথ। এখানেও রাতে ক্যাম্পফায়ার করে থাকা যেতে পারে। বালিহাঁস, পানকৌড়ি কি ওই সব পাখিদের ঝাঁকের মাঝে মাঝে থাকে, লায়েক জানে না। বন্দুক হাতে সে হাঁটে। তার বাংলোবাড়ি থেকে এই পথ কতটা দূর হবে সে এখনও ভাবে নি। তবে মাইল তিনেক পথ এতক্ষণে নিশ্চয় চলে এসেছে। জঙ্গল এলাকাটা পার হলেই টিলার গোড়া শুরু।
এখানে এসে সে একটা ছায়া ঘেরা জায়গা দেখতে পায়। এটাই কি তাহলে সেই জায়গা। যা সে এত দিন ধরে শুনে এসেছে। তাহলে এখানকার দহটা কোথায়। লায়েক আশপাশে তাকাতে তাকাতে আরও কিছুটা ডান দিক ঘেঁষে হেঁটে দহটা দেখতে পায়। আগেরটার থেকে এটা কিছুটা বড়। এরও চার পাশে নানা গাছ দিয়ে ঘেরা। গাছ, দহ, দহের জলে গাছের ছায়া, ভোরের নরম আলো সব মিলিয়ে এখানে একটা মায়াবী আলো চারপাশে চকচক করছে। যেন সবুজ ছলকে ছলকে পড়ছে। এমারেল্ড গ্রিন। লায়েক দহের পাড়ে বসে পড়ে। ঘাসের উপরে বন্দুকটাকে আলতো করে শুইয়ে দেয়। তার সারা গায়ে এখন ঘাম বিনবিন করছে। কিন্তু এই একাকীতেও সে গায়ের পাঞ্জাবী খোলে না। বন্দুকের পাশে সেও শুয়ে পড়ে।
ঘুম ভাঙার পর কিছুক্ষণ সে বুঝতেই পারে না ঠিক ক’টা বেজেছে। রোদ উঠলেও তাতে তেমন তেজ নেই। সে কি জীবনে এই প্রথমবার কোনও দহ ও জঙ্গলের মাঝে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। আগেও কি এমন হয়েছে। আগের কথা তার এখন মনে পড়ছে না। সে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে। বন্দুকটা বাগিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করে। এবার সামনের পথ বেশ চড়াই। পাথুরে, সরু আপাত পাকদন্ডী পথ ধরে সে হাঁটতে শুরু করে। বেশ কিছুটা হাঁটার পর তার হাঁফ ধরে যায়। টিলার শক্ত দেয়ালে গা ঠেকিয়ে, বন্দুকটাকে খাড়া করে দাঁড় করিয়ে সে বসে থাকে। দূরে শীর্ণকায়া শ্রীমতি। সে এখন আর বয়ে চলে না। যদিও তার এই স্তব্ধতা লায়েককে ছোঁয় না। শ্রীমতির বুকের উপরে এখনও অসংখ্য পাখি উড়ছে, বসছে, খাওয়া শেষে শাবকের জন্য ঠোঁট ভরে কীট নিয়ে উড়াল দিচ্ছে। তাদের বাসা নিশ্চয় শ্রীমতির আশাপাশে। লায়েক জানে না।
২
থেমে থেমে, বিশ্রাম নিয়ে, অনেকটা হেঁটে লায়েক আজ দুপুরের আগেই এই টিলার উপর উঠেছে। এখন সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে। তার চোখের সামনে থেকে শ্রীমতি ক্রমশঃ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে সে বসে রয়েছে। সামনে আগুন জ্বালানো। এটা একটা অতি অনুচ্চ নির্জন টেবল হিল বৈ তো নয়! টিলার ওপারে গ্রাম। সেই গ্রামের রাতআলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। সেই সময় ফুলমতিয়া আসে, আর তার মাস্টারনি শ্রীমতি। মেঘনাদ হয়তো আগেই এসেছে। শতরঞ্চির উপরে সে তার খোল ঠিক করছে। তার টংঠং টং...ঠং আওয়াজ লায়েকের পাশ দিয়ে টিলার নীচের দিকে ভেসে যাচ্ছে। কিছুটা দূরে একটা পলকা তাবু খাটানো হয়েছে দুপুরে। তার পাশেই বসেছে রান্নার আয়োজন। লায়েক ভাবছে ভোর রাতে না বেরিয়ে বেলাবেলি বের হলেও চলতো। কিন্তু চড়া রোদে হাঁটার থেকে সকলের নজর এড়িয়ে ভোর রাতে বেরিয়ে আসাটা তার পক্ষে ভালো হয়েছে। দুপুরে সে যথেষ্ট ঘুমিয়ে নিতে পেরেছে। এখন সে একদম ফিট। একটু পরেই গান শুরু হবে। সেই সঙ্গে নাচ। তবে এখানে কথোকথার কোনও আয়োজন নাই। কেউ অভিনয়ও করবে না। শুধুই নাচ, গান।
অনেকটা ঘনিষ্ট হয়ে তারা সকলে বসেছে। সামনে জ্বালানো আগুনে এখন আরও কাঠ পড়েছে। পাশে একটা বড় হ্যারিকেনও জ্বলছে। সেইসব আলোতে আশপাশ রহস্যময় হয়ে উঠেছে। ফুলমতিয়া আজ সেজেছে। তার গায়ে আঁটো করে বাঁধা হলুদ শাড়ি তার চিকনতাকে প্রকট করছে। কানে লাল রঙের ঝুমকো দুল। কিছুটা উমনোঝুমনো চুল টিলার বাতাসে ভাসছে। সেকি একাই নাচবে, নাকি তার সঙ্গে আরও কেউ আছে, লায়েক বসে বসে ভাবে। তার বন্দুক, মার্লবোরো সিগারেটের প্যাকেট, পেট্রল লাইটার সামনে রাখা। সে পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে রয়েছে। আকাশের দিকে চাইলে এখন তারা দেখা যাচ্ছে। নবমীর চাঁদ ভেসে আছে। সন্ধ্যা উতরে রাত এখন ক’টা হবে সেটা বোঝার চেষ্টা করে লায়েক।
সেই সময় শ্রীমতি একেবারে তার পাশে চলে আসে, ---শুরু করি?
লায়েক মুখ না ঘুরিয়ে একটু তাকায়,---হুম, অসুবিধে কি?
শ্রীমতি আগুনের ধার ঘেঁষে কিছুটা দূরে চলে যায়। মেঘনাদের খোলের আওয়াজ সজাগ হয়ে ওঠে। আর আগুন ভেদ করে ফুলমতিয়া লায়েকের সামনে চলে আসে। মাটি থেকে বেশ কিছুটা উপরে মৃত নদী, মৃতপ্রায় অরণ্যের মাঝে, তারাভরা রাতে, অস্ফুট জ্যোৎস্নায় এই জায়গাটি মুহূর্তে যেন অমরাবতীতে রূপান্তরিত হয়। পারিজাত বৃক্ষ না থাকলেও আশপাশ থেকে বাতাসে ভর দিয়ে সুগন্ধ আসছে। লায়েক টের পায়। তার সঙ্গে রান্নার গন্ধ মাঝে মাঝে মিশে যাচ্ছে। আগুনের ওপার থেকে শ্রীমতি তার ঈষৎ স্বরভঙ্গ গলায় গাইছে। যা তার গানকে আরও বিশিষ্ট করে। আর সেই গানের সঙ্গে ফুলমতিয়া তার দেহকে যেন ভেঙ্গে ভেঙ্গে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে নাচছে।
চার দিকে ছাই রঙের অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে আগুনের আলো ভেদ করে মেঘনাদ খোল সমেত উঠে এসেছে ফুলমতিয়ার পাশে। সেও তার পাশে পাশে নাচছে। লায়েক সিগারেট ধরায়। রাত গড়াতে থাকে।
ওদিকে হাঁসের মাংস রান্না শেষ হয়েছে। ভাত নেমেছে। দুপুর থেকে কারা এসব ব্যবস্থা করেছে সেদিকে কোনও নজর দেয় নি লায়েক। বিকাল বিকাল শ্রীমতি, ফুলমতিয়া আর মেঘনাদ আসার পর থেকে তাদের সঙ্গে বসে গল্প করেছে। এই নদী পাড়ের প্রাচীন বৃত্তান্ত, নতুন গল্প শুনেছে। বহু পূর্বে, শ্রীমতির গা বেয়ে ভেসে যেতো পালতোলা নৌকা। নদীর ধারে ধারে কত না গাঁ, গঞ্জ। কিন্তু এক সময় এই নদীর অভিশাপ লাগে। উৎস থেকে তার জল আসা বন্ধ হয়ে যায়। ঘোর বর্ষায় যখন অন্য নদী ফি বছর জলে ভরে উঠেছে সেই সময়েও এই নদীতে আর জল আসে না। বৃষ্টির জলে নদীর পুরানো মাটিতে কাদা ছাড়া কিছুই উৎপন্ন হয় না। যুগের পর যুগ এভাবেই চলতে থাকে। শ্রীমতির চেহারা আরও শুকিয়ে যেতে থাকে। নদীর আশপাশে ধানি জমি ধীরে ধীরে নদীকে গ্রাস করতে শুরু করে। আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষ আসে। তারা শ্রীমতির বুকে ধান চাষ শুরু করে দেয়। সেই ধান ক্ষেতের মাঝে মাঝেই ছোট ছোট দহ তৈরী হয়ে যায়। সেখানে স্বচ্ছতোয়া জল থাকে। কিন্তু সেখানে তেমন মাছ নাই। সুদূর দেশ থেকে পরিয়ায়ী পাখিরা আসে। তারা পাড়ে পাড়ে বাসা বাঁধে। এই সবই গল্প কাহিনী হয়ে লোকগাঁথা হয়ে যায়। শ্রীমতির গানে গানে মিশে যায়।
'একটি মৃত প্রায় নদীর নামে তাহলে তোমার নাম কেন, শ্রীমতি?'
এই প্রথম সে শ্রীমতির নাম ধরে কথা বলে।
শ্রীমতি হাসে, রহস্যময়ীর মতো উত্তর দেয়, --- 'আমিও তো মৃতকল্পা! মৃতবৎসাও!'
লায়েক চমকে ওঠে। এই গহীন কথা সে এ কোথায় বসে শুনছে? এই প্রথম সে শ্রীমতির দিকে ভালো ভাবে তাকায়। তার মুখের আদল কি অনেকটা এথেনার মতো নয়! এই বোধের ছটা কি সেখান থেকে লব্ধ। কিন্তু কি তার উৎস। কে তার পূর্বপুরুষ? এই ভাষা এখানে কোথা এলো? লায়েকের সমস্ত হিসাব এলোমেলো হয়ে যায়। এরপর থেকে সে শুধু শ্রীমতিকে দেখছে। তার তৎপরতাতেই তো ফুলমতিয়া সেজে উঠেছে। সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে আসর জমে উঠছে। রান্নার দিকেও শ্রীমতি নজর দিয়েছে। এরপর সঠিক সময়ে গান শুরু করার অনুমতিও নিয়েছে সে, কিছু আগে।
টিলার মাথায় রাত বাড়ে। নীচে শ্রীমতির তীরে তীরে এখনও সেই প্রতি রাতের গান বাজছে কিনা লায়েক বুঝতে পারে না। তবে এদিন তো তার জন্য এখানে গান হচ্ছে, নাচ হচ্ছে। ফুলমতিয়ার যৌবন আগুনের আঁচে আঁচে ঝলসে উঠছে। রান্নার কাজ কিছুটা এগিয়ে যেতেই একজন একটা প্লেটে করে হাঁসের মাংস দিয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে একটা বোতল আর গ্লাস। লায়েক নিজেই গ্লাসে ঢেলে নিয়েছে। খুব ধীরে ধীরে দু’পেগ খাওয়ার পর সে সিগারেট ধরিয়েছে।
ফুলমতিয়া কি মেঘনাদের বউ? হঠাৎ এই প্রশ্নটা লায়েকের মাথায় আসে। যদি তাই হয় তাহলে এই সব আসরে সেকি শুধুই নাচে? আর কিছু নয়! অর্থের বিনিময়েও নয়? নাকি মেঘনাদ সবই জানে। এটাই তার পেশা। এমন ঘাড় অবধি লম্বা লম্বা চুল। দীর্ঘ সময় ধরে পেশল বাহু দিয়ে খোলে তাল ধরে রাখা। দম তো কম নয়! কি কালো মিশমিশে চেহারা। ফুলমতিয়া কি তার কেউ নয়? সে কেবলই ভাড়াটে বাজিয়ে। এখানে বাজিয়েই সে ফিরে যাবে।
গান থামে। নির্জনে রাত বেশী বলে মনে হয়। লায়েক এখনকার মতো মদ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। এবার খাওয়ার পালা। রান্নার জায়গার অদূরেই খাবারের জায়গা তৈরী করা হয়েছে। লায়েককে একটা আলাদা জায়গায় বসিয়ে বাকিরা একধারে সার দিয়ে বসেছে। গরম গরম খাওয়ার পরিবেশন করছে একটি ছেলে। খোল রেখে তাকে সাহায্য করছে মেঘনাদ। ফুলমতিয়া এসবে নেই। সে খাবার জায়গায় বসে পড়েছে। হয়তো দীর্ঘক্ষণ নেচে সে কিছুটা ক্লান্ত। শ্রীমতি তদারকিতে ব্যস্ত। লায়েকের খাবার সে নিজের হাতে বেড়ে নিয়ে এসেছে। ভাত, টকটকে লাল রঙের হাঁসের মাংসের ঝোল আর স্যালাড। ব্যস, এই। ক্যাম্পফায়ারের আলো যেন কিছুটা দমে গিয়েছে। ফুলমতিয়ার নাচের সময় সেটি যেমন প্রজ্জ্বল এখন আর তেমনটা নেই। সেই নাচে লায়েকের শরীরে কি আগুন ধরে? তা অবশ্য বোঝা দায়।
৩
খাওয়া শেষ। তারপর আর সময় নেয় না কেউ। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব কিছু গোছগাছ করে, হিসাব বুঝে নিয়ে টিলার অপর প্রান্ত দিয়ে যে রাস্তা নেমে গিয়েছে সেখান দিয়ে সকলে নেমে যায়। লায়েক টিলার উপর থেকেই তাদের চলে যাওয়া দেখে। তারা কিছুদূর নেমে যাওয়ার পর তাদের আবছায়াও আর দেখা যায় না। শুধু একটা আলো কিছুক্ষণ পরপর বাঁকে বাঁকে দৃশ্যমান হয়। ফের মিলিয়ে যেতে থাকে। লায়েক সেদিকে তাকিয়ে থাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট শেষ করে সে দুর্বল তাবুটার কাছে ফিরে আসে। আকাশের নীচে, টিলার উপরে জনমানবহীন এই এলাকায় সে এখন একেবারে একা। তার ভয় নাই। বয়স যাই হোক না কেন, ভয় সে কবেই বা পেয়েছে? নির্জন তার বড় প্রিয়। লায়েক তাবুতে ঢোকে। তাবুর ভিতরে বিছনাটা দুপুরের পর আবার পাটপাট করে সাজানো হয়েছে। এক পলক দেখেই সে বুঝতে পারে। মাঝের সরু খুঁটিতে একটা হ্যারিকেন ঝুলছে। এরা এসব রেখে গিয়েছে মানে কাল আবার আসবে। ভাবতে ভাবতে সে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয়। তার কি ঘুম এসেছে। চোখ বন্ধ করে আরও একটা সিগারেট ধরায়। বন্দুকটাকে পাশে রেখে সিগারেট টানতে থাকে।
সিগারেট শেষ করে সেটিকে বাইরে ফেলতে যাওয়ার জন্য উঠে বসতেই লায়েক দেখতে পায় তাবুর ঠিক সামনে অদ্ভুদ ভঙ্গিমায় কেউ বসে রয়েছে। একবার খুব তীক্ষ্ণ চমকে ওঠে ভেতরে ভেতরে।
‘কে?’
‘আমি।’
শ্রীমতির সেই অতিবিরল শান্ত কন্ঠস্বর ভেসে আসে।
‘ভেতরে এসো। ফিরে এলে যে?’ লায়েক মোলায়েম আহ্বান জানায়।
‘একা যদি থেকে যান এখানে...’
‘একা থাকতেই তো এসেছি।’
‘তাই ফিরে এলাম।’
সেই রাতে লায়েকের বিছনার একেবারে পাশে এসে বসে শ্রীমতি। এই তাবুতে কতটুকুই বা জায়গা? তার পরনে অতি সাধারণ শাড়ি। লায়েক লক্ষ্য করে, এই বয়সেও শ্রীমতি মোহময়ী। তার গ্রীবা অত্যন্ত দীর্ঘ। হ্যারিকেনের হলদে আলোতে তার গাল থেকে আলো চুঁইয়ে পড়ছে। লায়েক বিছানার উপরে এসে বসে। শ্রীমতির চাউনি লক্ষ্য করে। এই অঞ্চলে সে বহু দিন থেকেছে। এক ডাকে তাকে সবাই চেনে। তার প্রতিপত্তি সকলেরই জানা। ইদানিং মাঝে মাঝে আসা হয়। বাংলোতে দু’চার দিন কাটিয়ে আবার ফিরে যেতে হয়। কিন্তু এবার আসার পর থেকেই তার মাথায় বারবার এখানে রাত কাটানোর কথা এসেছে। সেই মতোই সে এসেছে। সব ঠিকঠাকই হয়েছে। কিন্তু শ্রীমতির ফিরে আসা তার সব হিসাব গুলিয়ে দিয়েছে। রাত গভীর হয়। দু’চার কথায় কথা গল্পে গড়ায়। শ্রীমতি ঠায় বসে থাকে। লায়েক সিগারেট ধরায়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর আবার পেগ বানায়। সে বোঝে শ্রীমতির এসবে কোনও আসক্তি নেই। সে তার গানের কথা বলে। জীবনের কথা বলে। যৌবন থেকে সংগ্রাম শুরু করে ধীরে ধীরে দুর্বিষহ শুকিয়ে যাওয়ার কথা বলে। তার শরীরে অসংখ্য পাখির উড়ে আসা, খুঁটে খুঁটে আনন্দআহার তুলে নেওয়ার ব্যাপ্ত ইতিহাসের কথা সে মৃদু ভাসিয়ে দেয় লায়েকের সামনে। সেইসব পাখিরা দূর থেকে আসে। বাসা বাঁধে। আবার সময় হলেই দূরে দুরে চলে যায়। কোনও দিনই শ্রীমতির ধারে তারা চিরস্থায়ী নয়। সেই সুদীর্ঘ ইতিহাসের চলনে এক সময় রাত ভোর হয়ে আসে।
‘এবার আসি।’
‘চলে যাবে?’ লায়েক জিজ্ঞাসা করে।
মুখ তুলেও শ্রীমতি কোনও উত্তর দেয় না। খুব ধীরে তাবুর ভিতরে থেকে বেরিয়ে আসে। একবার পিছন ফিরে তাকায়। তারপর চোখের আড়ালে চলে যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লায়েক বেরিয়ে আসে। তার হাতে বন্দুক। সে আর দাঁড়ায় না। যে পথ দিয়ে গতকাল সে টিলায় উঠেছে সেই পথেই নামতে শুরু করে। শুধু বুঝতে পারে না শ্রীমতি কি টিলার ওপারের গ্রামের দিকে নামছে নাকি সে যেদিকে নামবে, বাংলোর দিকে, শ্রীমতির দিকে, সেদিকে নেমেছে। খুব দ্রুত ঢাল বেয়ে সে নেমে আসে। আজ তো কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রীমতির ধারে চলে আসা গিয়েছে! গতকালের মতোই সময় এখন। লায়েক বুঝতে পারে ঠিক চব্বিশ ঘন্টা সে এপাড়ে থেকেছে। এই বয়সে এতটা ঝক্কি নেওয়া কি তার ঠিক হয়েছে?
ফের কাদা পেড়িয়ে শ্রীমতির এপাড়ে এসে ওঠে। এপাড়ে কোনও স্বচ্ছতোয়া দহ তো নেই। তাই তার শুভ্র পাজামায় কাদা লেগেই থাকে। কাদা লতপত করতে থাকায় তার অস্বত্বি লাগে। বন্দুকটা বাগিয়ে কিছুদূর হনহন করে হেঁটে যায়। এখান থেকে বাংলো খুব বেশী দূর নয়। হঠাৎ সে শ্রীমতির দিকে ফিরে দাঁড়ায়। পকেট থেকে গুলি বের করে বন্দুকে ভরে নেয়। আজও অজস্র পাখির ঝাঁক সেখানে। লায়েক অত্যন্ত সতর্ক হয়ে ওঠে। তা পা শিকারি বেড়ালের মতো হয়ে ওঠে। খুব ধীরে ধীরে সে আবার নদীতে নেমে যায়। ঝাঁকের যতটা কাছে নিজেকে নিয়ে যাওয়া যায় তার চেষ্টা করতে করতে তার গা শিউরে ওঠে। শরীর শক্ত হয়ে যায়। বন্দুক তাক করে সে এবার লক্ষ্য স্থির করে গুলি চালিয়ে দেয়।
একঝাঁক পাখি সেখান থেকে উড়ে অনেকটা দূরে গিয়ে বসে। লায়েক দেখে অনেক পাখি উড়ে গেলেও একটা পড়ে রয়েছে। কাদা ভেঙে সেটিকে তুলে সে পাড়ে উঠে আসে। এখন আবছা আলো অনেকটাই পরিস্কার হয়েছে। ভোরের সেই পবিত্র আলোতে লায়েক দেখতে পায় শ্রীমতির বুক থেকে শিকার করা সেই সাদা পাখিটির সুদীর্ঘ গ্রীবায় তার অব্যর্থ গুলিটি লেগেছে। আর তার হলুদ ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ঘন, গরম, লাল রক্ত। এক ঝলক দেখে নিয়ে ডান হাতে বন্দুক সামলে বাঁ হাতে পাখিটার ঠ্যাং দু’টো ধরে তাকে ঝুলিয়ে নিয়ে লায়েক বাংলোর দিকে হাঁটতে শুরু করে। এই সময় তার খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দুই হাত আটকে থাকায় সেই ইচ্ছে তাকে আপাততঃ দমনই করতে হয়।
লায়েক কি ট্রমা আক্রান্ত কোনও সন্ন্যাসী পুরুষ? যে কিনা শেষ বয়সে হঠাৎই প্রমত্ত।
এষ বৃত্তান্তঃ তিষ্ঠতু।
Comments
Post a Comment