ছবিতে নারী এবং নারীর ছবিঃ শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়
ছবিতে নারী এবং নারীর ছবি
শ্রেয়সী গঙ্গোপাধ্যায়
এগারো
"Post impressionists had changed human consciousness, forcing writers and painters into less certain, experimental efforts." - Virginia Woolf, 1924.
উত্তর অন্তরমুদ্রাবাদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো কতগুলো ছোট ছোট পদ্ধতিতে বা ধারায় কাজ হতে থাকে এ সময়। যেমন সুরাটের বিন্দুবাদের কাজ যা নতুন অন্তরমুদ্রাবাদ নামেও পরিচিত। যেখানে ছবিকে কতগুলো বিন্দুর সমষ্টি হিসাবে একটি প্রতীতী গড়ে তোলা হয়। এমিলি বার্নার্ড আবার নিয়ে এলেন সিন্থেটিজিম যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বস্তুর স্বাভাবিক ফর্মের একটা আউট ওয়ার্ড উন্মেষ, যেখানে আর্টিস্টের ভাবনা ও অনুভূতি পাবে প্রকাশ। লুই অ্যানকুইনটিন আবার সামনে নিয়ে এলেন ক্লোজনিজম যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল গাঢ় লাইন দিয়ে বিভিন্ন সমতলে ছবিকে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করা। এছাড়া রয়েছে পন্ট অ্যাভেন স্কুল যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো গাঢ় রঙের ব্যবহার। এছাড়া রয়েছে লেস নাভিস অর্থাৎ যারা বিশ্বাস করতেন ফ্ল্যাট রঙের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ছবি করতে। এছাড়া রয়েছে সিম্বলিজম যেখানে মেটাফোরিক্যাল ইমেজের গুরুত্ব সর্বাধিক।
উত্তর অন্তরমুদ্রাবাদের সময় যে সকল মেয়েরা ছবি এঁকেছেন তারা হলেন-মেরি শেপার্ড গ্রিন ব্লুমেনশেইন (১৮৬৯-১৯৫৮) - আমেরিকান চিত্রী মেরি ছবির পাশাপাশি করতেন অলংকারের নকশার কাজ। জাপানের শৈলী দ্বারা ছিলেন প্রভাবিত। বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত মেরি প্রদর্শনী করেছেন একাধিক।
অ্যানি সুইনারটন (১৮৪৪-১৯৩৩) - ব্রিটিশ চিত্রী অ্যানি ছিলেন রয়াল একাডেমী অব আর্টসের প্রথম মহিলা নির্বাচিত সদস্যা। প্রধানত এঁকেছেন প্রতিকৃতি এবং নিসর্গ দৃশ্য, তবে তাঁর ফিগারেটিভ কাজগুলো শক্তিশালী ড্রইংয়ের প্রমাণ। তাঁর কিউপিড এবং সাইকি, দ্য সেন্স অফ সাইট, ইয়ং মাদার, ইলুউশনস উল্লেখযোগ্য। ছবিতে নিওক্লাসিসিজম এবং প্রিরাফালাইটিজমের প্রভাব স্পষ্ট। মেয়েদের ভোট দেওয়ার অধিকারের দাবিতে তিনি সর্বদা সোচ্চার ছিলেন।জিন জ্যাকমিন (১৮৬৩-১৯৩৮) - ফ্রেঞ্চ চিত্রী জ্যাকমিন ছিলেন উত্তর অন্তরমুদ্রাবাদের সিম্বলিস্টদের অন্যতম। তাঁর জীবিত অবস্থায় মাত্র ৪০টির মত কাজ প্রদর্শিত হয়েছিল। তাঁর ছবিতে একাকীত্ব ও রহস্যময়তায এক বিশেষ চরিত্র হিসেবে ধরা পড়ে।
এলেন থেসলেফ (১৮৬৯-১৯৫৪) - ফিনিশ চিত্রী এলেন এঁকেছেন প্রধানত নিসর্গ চিত্র। ছিলেন মোনেটের কাজ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। তাঁর আঁকা মডেল উইথ মীরর অন দ্য বিচ এবং ফ্লোরেন্সের নিসর্গ চিত্রগুলো সিম্বলিজমের অন্যতম কাজ।
সুজান ভ্যালাডন (১৮৬৫-১৯৩৮) - ফ্রেঞ্চ চিত্রী সুজান ছিলেন ন্যাশনাল সোসাইটি অফ ফাইন আর্টসের মহিলা সদস্যা। মূলত ছবি এঁকেছেন মেয়েদের নিয়ে। তাঁর আঁকা জয় অফ লাইফ উল্লেখযোগ্য কাজ। দেগা ও রেনোয়া তাঁর কাজের প্রতি ছিলেন আকৃষ্ট। মূলত সুজান এঁকেছেন নিসর্গ চিত্র ও ফুল তথা স্থিরচিত্র। কাস্টিং দ্য নেট, আবানডনড ডল, দ্য বাথ, আদম ও ইভ, ন্যুডস এবং একাধিক স্থিরচিত্র তাঁর প্রতিভাকে তুলে ধরে। তাঁর আঁকা প্রতিকৃতিগুলোও বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দেয়। ১৯৮৮ সালে তুলুজ লোত্রেক দ্য হ্যাংওভার বলে একটি ভ্যালাডনের প্রতিকৃতি আঁকেন। (ছবি- ৪৩)
গ্রেস কোসিংটন স্মিথ (১৮৯২-১৯৮৪) - অস্ট্রেলিয়ান চিত্রী গ্রেস উত্তর অন্তরমুদ্রাবাদকে প্রবর্তন করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। তাঁর সূর্যের আলো ছায়ার একটা অদ্ভুত প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় যা উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার ও দাপুটে তুলির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তাঁর কাজকে করে তুলেছিল সমসাময়িক চিত্রীদের তুলনায় অগ্রণী। তাঁর নিসর্গ চিত্রগুলো অনেক ভাস্বর কাজ।
কেমিল ক্লডেল (১৮৬৪-১৯৪৩) - ক্লডেল ছিলেন ফ্রেঞ্চ ভাস্কর। মূলত কাজ করতেন মার্বেল ও ব্রোঞ্জে। ১৮৮৩ সাল হতে তিনি রঁদ্যার ওয়ার্কশপে কাজ করেন। ভাস্কর্যের মধ্যে দা ম্যাচিওর এজ, ১৮৯৯ উল্লেখযোগ্য যা জীবনের তিনটি দশকে দর্শায়। ১৮৮৮ সালে ক্লাডেল মার্বেলে করেছিলেন শকুন্তলা বলে একটি ভাস্কর্য যা তাঁর মাস্টারপিস বলে প্রখ্যাত। দ্যা ওয়েব আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ। পাঠিকা বিস্তৃত জানতে এক্ষেত্রে ক্লডেলের লেখা চিঠি পড়ে দেখতে পারেন।হেলগা ভন ক্র্যাম (১৮৪০-১৯১৯) - সুইস চিত্রী হেলগা এঁকেছেন মূলত স্থিরচিত্র। বিশেষত ফুলের ছবি। সারা জীবনে একাধিক প্রদর্শনী করেছেন। এছাড়া করেছেন একাধিক বইতে অলংকরণের কাজ।
জেসি নিউবেরি (১৮৬৪-১৯৪৮) - স্কটিশ চিত্রী নিউবেরির মাধ্যম ছিল মূলত এমব্রয়ডারির কাজ। পরিচিত ছিলেন গ্লাসগো গার্ল নামে। তিনি নিজে সর্বদা আকৃষ্ট ছিলেন ডেকোরেটিভ আর্টের দিকে এবং ১৮৮৪ সালে গ্লাসগো আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তাঁর কাজ সবদিক থেকেই ছিল স্বতন্ত্র। রঙের ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিশেষ সতর্ক ও পারদর্শী। ভিক্টোরিয়ান ড্রেসকে রিফর্ম করার ক্ষেত্রে ও মেয়েদের ভোটাধিকার প্রবর্তনের পথেও তিনি ছিলেন সমানভাবে আগ্রহী ও সচেতন।
ওলগা বোজনামাস্কা (১৮৬৫-১৯৪০) - পোলিশ চিত্রী ওলগার ছবি অন্তরমুদ্রাবাদের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তিনি নিজে এই বিভক্তিকরণকে অস্বীকার করেছেন। তাঁর কাজগুলো ছিল মূলত প্রতিকৃতি, নিসর্গ, ও স্থিরচিত্র। ১৮৯৮ সালে যোগ দেন 'Sztuka', ১৮৯৪ সালে তিনি আঁকেন গাঁদা ফুল সহ বালিকা ছবিটি যা তার অন্যতম কাজ হিসাবে ধরা হয়। এই ছবির রহস্যময়তার আবহাওয়া ও কালার এসেন্স একটি অন্য মাত্রা প্রদান করেছে ছবিটিকে। (ছবি - ৪৪)
ছবি - ৪৪
ক্যাথে কোলভিটজ (১৮৬৭-১৯৪৫) - জার্মান চিত্রী ক্যাথে ছিলেন একাধিক মাধ্যমে পারদর্শী। তিনি ছবি যেমন এঁকেছেন তেমনি এচিং, লিথোগ্রাফ, উডকাট, ভাস্কর্য করেছেন সমানতালে। তিনি ছিলেন প্রুসিয়ান আর্ট একাডেমির সদস্যা। ১৯০৩ সালে করা তাঁর এচিংয়ের কাজ প্রেইং ওম্যান, মিজারি, ইয়ং কাপল, ওয়াকিং, ওমান দা মাদার্স উল্লেখযোগ্য অধিক চর্চিত কিন্তু তার ভাস্কর্যগুলোও বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
ইভা ফ্রান্সিস (১৮৮৭-১৯২৪) - নরফকে জন্মে ইভা ছবির সঙ্গেই বড় হচ্ছিলেন। ১৯০৪ সালে নরফোক ছেড়ে রেক্সহ্যামে চলে আসেন। তাঁর ছবি রয়েল একাডেমী ও অন্যান্য নানান গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়। তিনি কাজ করতেন মূলত জলরঙে এবং তাঁর রঙের ব্যবহারের যে বালান্স, ছিল তা উল্লেখ্য।গুয়েন জন (১৮৭৬-১৯৩৯) - জন মূলত এঁকেছেন প্রতিকৃতি। তাঁর রং ব্যবহারের প্রণালীতে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। ইয়ং ওম্যান উইথ রেড সল, দ্য কনভালিসেন্ট, দ্য নান, দ্য পিলগ্রিম তাঁর আঁকা ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম। গুয়েন জনের রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে চাপা অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায় যা অদ্ভুত ব্যালেন্সের নিদর্শন। (ছবি - ৪৫)
ছবি - ৪৫
চীনে সে সময় মেয়েরা কাজ করেছেন। মূলত ল্যান্ডস্কেপ ও পশুপাখির ছবির পাশাপাশি নারী অবয়ব আঁকার দিকে একটা ঝোঁক লক্ষ করা যায়। চীনের শিল্পীরা এই সময় পাশ্চাত্যের ছবি সংস্পর্শে আসে অনেক বেশি করে, ফলে আস্তে আস্তে ন্যুডের ব্যবহার অথবা বিমূর্ততার দিকে ঝোঁক ও ক্যালিগ্রাফি রূপায়নে বৈচিত্রতা আসে। জাপানে এই সময়টায় এডো পিরিয়ড। এই সময়ের ছাপটা ধরতে একটু পিছিয়ে কাটশুশিকা ওইয়ের (১৮০০-১৮৬৬) কাজ নিয়ে একটু কথা বলতেই হয়। হাকুশাইয়ের কন্যা ওই কাজ শিখেছেন বাবা ও তুৎসুমি তোরিন তিনের কাছে। তাঁর কাজের মধ্যে বিউটি ফোলিং ক্লথ ইন দ্য মুনলাইট ওশিওয়ারা নাইট সিন, বিউটি অফ স্প্রিং নাইট, মাউন্ট ফুজি থ্রু আ বাম্বু ফরেস্ট, থ্রি ওম্যান প্লেইং মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্ট তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিগুলোর মধ্যে অন্যতম। ( ছবি - ৪৬)
ছবি - ৪৬
তাঁর কাজ নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্য তাঁর ছবিতে পাশ্চাত্য কম্পোজিশনের একটা প্রভাব ও পার্সপেক্টিভ রচনায় দেখা যায় অভিনবত্ব। এর প্রভাব পরবর্তী জাপানি চিত্রীদের উপর পড়েছিল নিশ্চিতভাবে। এর পরবর্তীকালে জাপানি চিত্রীদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইউমুরা শোয়েন (১৮৭৫-১৯৪৯)। তার কাজগুলো মেইজি তাইসো ও শোয়া অধ্যায়ের। তাঁর স্টাইলকে বলা হয় নিহোঙগা। যা স্পষ্টত পশ্চিমের কারিগরি পন্থা হতে আলাদা। শোয়েন সর্বপ্রথম জাপানি চিত্রী ছিলেন যিনি ১৯৪১ সালে ইম্পেরিয়াল আর্ট একাডেমীতে আমন্ত্রণ পান। তাঁর কাজের মধ্যে জ্যোৎস্না, স্বচ্ছ দিন, বসন্ত অন্যতম। ১৯৪৮ সালে পান অর্ডার অফ কালচার। চিগুসা কিতানি (১৮৯৫-১৯৪৭) জাপানি চিত্রীদের মধ্যে তাইসো ও শোয়া অধ্যায়ের অন্যতম। কিতানিও নিহোঙগা পদ্ধতিতে কাজ করতেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে চিত্র প্রদর্শনীর জন্য তাঁকে নির্বাচিত করা হয়। তাঁর কাজের মধ্যে স্মল বোর্ড ফর প্লেয়িং জোরুরী মিউজিক অন্যতম।
উত্তর অন্তরমুদ্রাবাদের সময় অতএব ছবি হয়েছে সারাবিশ্বে। নিজের নিজের ঘরানায় নিজের নিজের মতো করে। আমরা ইউরোপীয় শিল্প আন্দোলনগুলোর তলায় বাকি সকল সময়কে চাপা দিয়ে দিই স্বভাববশত কিন্তু ছবিতে সকল দেশই অবদান রাখে নিজের নিজের মতো করে আর তাই সকল দেশের ছবিতে একটা স্বতন্ত্রতা লক্ষ করা যায়। ইউরোপীয় দাপটকে মাথায় রেখেও লোকায়ত আসলে বাঁচে তার নিজের মত করে। আপন ফল্গু ধারাকে বয়ে নিয়ে চলার মধ্য দিয়ে। উত্তর অন্তরমুদ্রাবাদ বারবার খণ্ড-বিখণ্ড হয়েও একটাই কথাকে বলে চলে তা হল শিল্পী ও ছবির মনোজগতের একাত্মতার কথা, প্রকাশের কথা।
Comments
Post a Comment