অদ্বিতীয় সূত্রঃ সুপ্রিয় ঘটক
অদ্বিতীয় সুত্র
সুপ্রিয় ঘটক
বেশ কয়েক বছর আগে টিভিতে একটি বিজ্ঞাপন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল । বিজ্ঞাপনটিতে দেখানো হয়েছিল নাসার এক প্রদর্শনী কক্ষে উপস্থিত দর্শকদের সামনে এক গম্ভীরমুখো বিজ্ঞানী তাদের তৈরি রকেট ‘জুনো’-র ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তিনি জানান এই জুনো এমন প্রযুক্তিতে তৈরি যে বৃহস্পতি গ্রহতে পৌঁছতে তার মাত্র এক বছর সময় লাগবে। এর পর আধুনিক প্রযুক্তির হদ্দ-মুদ্দ দু-এক কথায় সেরে, ‘কারুর কোন প্রশ্ন আছে’ – বলে তিনি প্রায় চলেই যাচ্ছিলেন। এমন সময় এক ভারতীয় দর্শক সরলভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করেন- “ কিতনা দেতি হ্যায় ?” অর্থাৎ, এই রকেটটা মাইলেজ কেমন দেয়? এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে সেই গম্ভীরমুখো রকেট-বিজ্ঞানীর চোয়াল ঝুলে পড়ে। এর পরেই মারুতি-সুজুকির এই বিজ্ঞাপনে ঘোষক জানান যে ভারত এমন একটা দেশ যেখান সকলেই মাইলেজ নিয়ে চিন্তিত।
কেন সবাই মাইলেজ নিয়ে চিন্তিত? কারণ এর উপর নির্ভর করছে গাড়ি চালাতে কত খরচা হবে। সাদা বাংলায় মাইলেজ কথার অর্থ হল প্রতি লিটার পেট্রোল বা ডিজেলে গাড়িটি কতো কিলোমিটার যায়। অর্থাৎ মাইলেজ যতো বেশি সে গাড়ি ততো পয়সা সাশ্রয়কারী। জ্বালানী তেলের দাম যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাতে মাইলেজের চিন্তা আসবে সে তো স্বাভাবিক!
অবধারিতভাবে যে প্রশ্ন এর পর মনে আসবে সেটা হোলো – গাড়ির মাইলেজ বাড়াবার উপায় কি?এর সঙ্গে আর একটি লেজুর প্রশ্ন হোলো – মাইলেজ কিসের ওপর নির্ভর করে? এবার একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। আমাদের কাছে গাড়ি হোলো একটি ব্ল্যাক-বক্স – যার মধ্যে আমরা জ্বালানী তেল ঢালি, আর অন্য দিকে চাকা ঘোরে। কিন্তু এবার এই ব্ল্যাক-বক্সে উঁকি দিতে হবে। উঁকি দিলে দেখতে পাবো যে জ্বালানী তেল আমরা গাড়িতে ভরি, সে জ্বালানির দহন ঘটে ইঞ্জিনে। দহনের ফলে জ্বালানির মধ্যে উপস্থিত তাপশক্তির মুক্তি ঘটে, ঠিক যেমন ভাবে রান্নার গ্যাসের দহনে তাপশক্তির মুক্তি ঘটে। এবার ইঞ্জিনের যান্ত্রিক কারসাজিতে এই তাপশক্তি রূপান্তরিত হয় যান্ত্রিক শক্তিতে অর্থাৎ চাকার ঘূর্ণনে। মোদ্দা কথা হোলো গাড়ির ইঞ্জিনের মূল কাজ হোলো তাপশক্তি থেকে যান্ত্রিক শক্তি তৈরি করা। নীচের ছবিতে এই রকম একটি তাপ-ইঞ্জিনে শক্তির প্রবাহ রেখাচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হোলো। তুলনা করে বোঝাবার সুবিধের জন্য ডান দিকে একটি জল-শক্তি চালিত টারবাইন দেখানো হোলো।
টারবাইনের ক্ষেত্রে ওপরের উচ্চতা থেকে জল নীচে পড়ার সময় টারবাইনের ব্লেডে আঘাত করছে, ফলে টারবাইনে ঘূর্ণন গতির সৃষ্টি হচ্ছে। এর সঙ্গে তুলনা করে বলা যায় যে, তাপ ইঞ্জিনের বেলায় তেমনি যেন তাপশক্তি উচ্চ তাপমাত্রা থেকে নিম্ন তাপমাত্রায় প্রবাহিত হছে, আর এই প্রবাহের মাঝে ইঞ্জিন চলছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এটা বোঝাবার সুবিধের জন্য একটা উদাহরন মাত্র, একটু তলিয়ে দেখলে প্রচুর অমিলও দেখা যাবে। যেমন, টারবাইনের ব্লেডে আঘাত করার পর সেই জল কোথায় যাবে? অবশ্যই নীচের আধারে জমা হবে। যে পরিমান জল ওপরের আধার থেকে ছাড়া হচ্ছে সেই পরিমান জলই নীচের আধারে জমা হচ্ছে। কিন্তু তাপ ইঞ্জিনের বেলায় ব্যাপারটা অন্য রকম। উচ্চ তাপমাত্রার আধার থেকে যে তাপশক্তির প্রবাহ হচ্ছে সেটাই ইঞ্জিনে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে, যেটুকু রূপান্তরিত হতে পারছে না সেই পরিমান তাপশক্তি প্রবাহিত হচ্ছে নিম্ন তাপমাত্রার আধারে। অর্থাৎ, ওপরের আধার থেকে যদি Q1 পরিমান তাপশক্তি প্রবাহিত হয় এবং Q2 পরিমান তাপশক্তি যদি নীচের আধারে বর্জন করা হয় তবে এই দুই তাপশক্তির পার্থক্যের সমান হবে উৎপন্ন যান্ত্রিক শক্তির পরিমান (W)। সহজ সমীকরণে বলা যায় Q1-Q2= W । এই সময়ে ছোটবেলায় শেখা শক্তির নিত্যতা সূত্রটি একটু মনে রাখতে হবে – শক্তির মোট যোগফল অপরিবর্তনীয়, শুধু রূপান্তর ঘটতে পারে।
ফিরে আসি আমাদের পুরনো প্রশ্নে – মাইলেজ বাড়ানো যায় কি ভাবে? আর একবার ইঞ্জিনের শক্তি প্রবাহের ছবিটা দেখা যাক। এখানে উচ্চ তাপমাত্রার আধার তৈরি হচ্ছে কি ভাবে? অবশ্যই যে জ্বালানী গাড়িতে ভরা হচ্ছে তার দহনের ফলে। এই তাপশক্তির কতটা যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হবে তার উপর নির্ভর করবে মাইলেজ। এই জন্য ইঞ্জিনের দক্ষতা বলে একটি রাশি তৈরি করা হয়েছে যেটা দিয়ে আমরা অঙ্ক কষে বের করতে পারি শতকরা কতো ভাগ তাপশক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। তার মানে দাঁড়ালো যে ইঞ্জিনের দক্ষতা বেশি তার মাইলেজও বেশি। সমীকরণের আকারে লিখলে ব্যাপারটা হচ্ছে এই রকম
দক্ষতা = ইঞ্জিনে উৎপন্ন যান্ত্রিক শক্তি/ইঞ্জিনে তাপশক্তির জোগান
এই অনুপাতকে শতকরা হারে পরিণত করলেই আমাদের অভীষ্ট সংখ্যাটি পেয়ে যাবো। যদি অঙ্ক কষে কোনো ইঞ্জিনের দক্ষতা বের হয় ৪০%, তবে বোঝা যাবে জ্বালানীর দহনের ফলে উৎপন্ন তাপশক্তির শতকরা ৪০ ভাগ যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে আর বাকি ৬০% বর্জিত হয়েছে নিম্ন তাপমাত্রার আধারে। তাহলে শেষ মেষ দাঁড়ালো এই যে মাইলেজ বাড়াতে গেলে ইঞ্জিনের দক্ষতা বাড়াতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে গেলে জ্বালানী দহনের ফলে প্রাপ্ত তাপশক্তির যান্ত্রিক শক্তিতে বেশি বেশি করে রূপান্তরিত করতে হবে। প্রথমে দেখা যাক জল শক্তিতে চালিত টারবাইনের বেলায় শক্তির রূপান্তরের ব্যাপারটা। ওপরের জলাধারে যে জল সঞ্চিত আছে সেখানে জলের সঙ্গে স্থিতিশক্তিও সঞ্চিত আছে, এই জল যখন ওপর থেকে নীচে পড়তে থাকবে তখন তার এই স্থিতিশক্তি রূপান্তরিত হবে গতিশক্তিতে। বায়ুর বাধা ইত্যাদি ছোটখাটো জিনিস যদি উপেক্ষা করা যায় তবে গোটা স্থিতিশক্তি পুরোপুরি গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে ধরে নেওয়া যায়। এই গতিশক্তি যখন টারবাইনে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয় তখনও ছোটখাটো ‘নষ্ট’ হওয়া শক্তি উপেক্ষা করলে গতিশক্তির রুপান্তর সম্পূর্ণ বলে ধরে নেওয়া যায়। এখানে স্থিতিশক্তির সম্পূর্ণভাবে যান্ত্রিকশক্তিতে রূপান্তরিত হবার পথে যেটুকু বাধা সেটা ব্যবহারিক কারনে, তত্বগত কোন কারণ নেই।
এবার দেখি তাপ ইঞ্জিনের বেলায় কি হচ্ছে। এখানে তাপশক্তির রূপান্তর ঘটছে যান্ত্রিক শক্তিতে। এই ধরনের বিষয় পদার্থবিদ্যার যে শাখার আওতায় পড়ে তাকে বলে তাপগতিবিদ্যা। এই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটির খুবই নাম ডাক, যদিও দ্বিতীয় ছাড়াও প্রথম, তৃতীয় এমনকি শূন্যতম সূত্রও এখানে আছে! এই দ্বিতীয় সুত্র থেকেই এনট্রপির ধারনার উদ্ভব। এই বিখ্যাত দ্বিতীয় সুত্র ইঞ্জিনের বেলায় কি বলছে? বলছে যে এমন ইঞ্জিন বানানো অসম্ভব যা কিনা একটি মাত্র তাপ আধারের সঙ্গে কাজ করে ক্রমাগত যান্ত্রিক শক্তি উৎপন্ন করতে থাকবে। অর্থাৎ শুধু উচ্চ তাপমাত্রার আধার থেকে তাপ শক্তি নিয়ে সবটাই যান্ত্রিক শক্তিতে রুপান্তর ঘটাবে, কিছুই নীচের আধারে বর্জন করবে না – এমনধারা ইঞ্জিন কিছুতেই বানানো যাবে না। কিছু তাপশক্তি তাকে বর্জন করতেই হবে- এ যেন প্রকৃতির বসানো তাপ-কর (Heat tax)!এমনিতেই জ্বালানীর দামের উপর সরকার হাজারগণ্ডা কর বসিয়েছেন, এর উপর আবার প্রকৃতির কর- এতো ভারী অন্যায়! কই, অন্যান্য শক্তির রূপান্তরের বেলায় তো এমন নেই! ঠিকই, স্থিতিশক্তির বেলায় যে কোন তত্বগত বাধা নেই সে তো আমরা একটু আগে দেখতেই পেলাম। কিন্তু তাপশক্তিকে যান্ত্রিকশক্তিতে পুরোপুরি রূপান্তরিত করার বাধা শুধু ব্যবহারিক নয়, তাত্বিক।
তাপ ইঞ্জিন নিয়ে তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের সত্যতা কিন্তু আমাদের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে না। কিন্তু যুক্তির সোপান বেয়ে কয়েক ধাপ উঠলেই আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতাই বলে দেবে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক। যেমন, খুব অসন্তুষ্ট হয়ে আমরা একদিন বললাম যে আমরা এসব মানিনা, আমাদের ইঞ্জিন একটিমাত্র তাপ-আধার থেকে তাপ নিয়েই চলবে। তাহলে আমাদের এই ইঞ্জিনের শক্তি প্রবাহের রেখাচিত্র যেমন হবে সেটা নীচে দেখানো হোলো।
এবার প্রথম ছবি- যেখানে দুটো তাপ-আধার দেখানো হয়েছিল- তার সঙ্গে এই ছবির তুলনা করে দেখা যাক। প্রথম ছবিতে দুটো তাপ আধার আছে, একটি উচ্চ তাপমাত্রার আর একটি নিম্ন তাপমাত্রার। এই উচ্চ আর নিম্ন বলতে একে অন্যের সাপেক্ষে উচ্চ আর নিম্ন বোঝানো হয়েছে। এখন যে কোন একটি সরিয়ে নিলে অন্যটির আর কোন অর্থ থাকে না। ভালো-মন্দ, আলো-অন্ধকার, মিষ্টি-তেতো – এই জোড়া শব্দ থেকে কোনো একটি শব্দকে ভাষা থেকে সম্পূর্ণ মুছে দিলে জোড়ার অন্য একটি শব্দ সম্পূর্ণ নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায়। তাই দ্বিতীয় ছবিতে যেখানে একটি মাত্র তাপ আধার দেখানো হয়েছে সেটা তার ‘উচ্চ’ তকমা হারিয়ে ফেলেছে, কারণ তুলনা করার ‘নিম্ন’ কেউ নেই। দুটো তাপ আধার তৈরি করতে উচ্চ তাপমাত্রা তৈরি করতে জ্বালানীর দহন করতে হতো, নিম্ন তাপমাত্রা হিসেবে উপস্থিত বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাকে ধরা হতো। এখন একটি মাত্র তাপ আধার হিসেবে আমরা উপস্থিত বায়ুমণ্ডলকেই ধরতে পারি। অর্থাৎ এই ইঞ্জিনে জ্বালানীর প্রয়োজন নেই কারণ দহন ঘটিয়ে উচ্চ তাপমাত্রা সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র বায়ুমণ্ডল থেকে হাওয়া ঢুকবে, হাওয়া থেকে তাপশক্তি নিয়ে ইঞ্জিন চলবে আর নির্গমন নল দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া বেরিয়ে যাবে। প্রয়োজনে এই ঠাণ্ডা হাওয়া ঘ্ররের বা গাড়ির শীতাতপ নিয়ন্ত্রক হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। মনে রাখতে হবে এই সবই হবে একদম বিনে পয়সায়- বায়ুমণ্ডলের বাতাস ব্যবহার করতে এখনও কোনো পয়সা লাগে না ! একই ভাবে জাহাজ চালাবার ইঞ্জিন শুধু সমুদ্রের জলের জোগানেই চলবে, একদিক থেকে সমুদ্রের জল ঢুকবে, তার তাপশক্তিতে ইঞ্জিন চলবে, তারপর বরফে পরিণত হওয়া সে জল সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিলেই কেল্লা ফতে! একদম বিনে পয়াসায় জাহাজ চলবে!
অর্থাৎ আমাদের মূল যে প্রতিপাদ্য ছিল যে একটিমাত্র তাপ আধারে কোন ইঞ্জিন চলবে না- সেটা না মানলে এমন উদ্ভট সব কাণ্ডকারখানা মেনে নিতে হবে। এমনকি সেক্ষেত্রে এমনও দেখানো যায় যে তাপশক্তি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিম্ন তাপমত্রা থেকে উচ্চ তাপমাত্রায় প্রবাহিত হবে, এক গ্লাস জল টেবিলে রেখে দিলে এমনি এমনি বরফে পরিণত হবে! অতএব মানতেই হচ্ছে তাপ ইঞ্জিন চলতে গেলে দুটো তাপ আধার লাগবেই, কিছু তাপশক্তি ইঞ্জিন নিম্ন তাপমাত্রায় বর্জন করবেই।
বোঝা গেলো একদম বিনে পয়সায় গাড়ি চালানো যাবে না। সে না হয় হোলো- ইঞ্জিনের দক্ষতা ১০০% হবেনা সেটা না হয় মেনেই নিলাম- কিন্তু দক্ষতা বাড়িয়ে ১০০%-এর কাছাকাছি তো নিতে পারি! দ্বিতীয় সুত্র মেনে নিয়েও সবচেয়ে বেশি দক্ষতা কতটা করতে পারি? সেই ১৮২৪ সালে এক ফরাসী ইঞ্জিনিয়ার সাডি কার্নো এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবিত ছিলেন, অনেক ভেবে চিন্তে তিনি এক কাল্পনিক ইঞ্জিনের নক্সা দিলেন- পরবর্তী সময়ে যা কার্নোর ইঞ্জিন নামে পরিচিতি লাভ করে। সমস্ত রকম নষ্ট হওয়া শক্তি উপেক্ষা করে এক আদর্শ ইঞ্জিন তিনি কল্পনা করলেন, দেখা গেলো সেই ইঞ্জিনের দক্ষতা প্রকাশ করা যায় এক সহজ সমীকরণের মাধ্যমে - (T1-T2)/T1 যেখানে T1 হোলো উচ্চ তাপমাত্রা আর T2 হোলো নিম্ন তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রা প্রকাশ করা হচ্ছে কেলভিন স্কেলে, যেখানে শূন্য ডিগ্রি কেলভিনের অর্থ -২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছে একমাত্র T2 যদি শূন্য ডিগ্রি কেলভিন হয় তবেই ইঞ্জিনের ১০০% দক্ষতা হবে। এখানে আবার বাগড়া দিচ্ছে তাপগতিবিদ্যার তৃতীয় সুত্র, যে সুত্র বলছে চরম শূন্য তাপমাত্রা অর্থাৎ শূন্য কেলভিন তাপমাত্রা বাস্তবে অর্জন করা অসম্ভব। এছাড়া T2-কে কৃত্রিম উপায়ে উপস্থিত বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রার নীচে নামাতে চাইলে আখেরে দক্ষতা আরও কমবে সেকথা একটু পরেই বলা হয়েছে। অতএব এমনকি এক আদর্শ কাল্পনিক ইঞ্জিনেও দক্ষতা ১০০% হবে না, সেখানেও তাপশক্তি কিছুটা বর্জন করতেই হবে। আবার এও প্রমান করা যায় যে যে কোনো বাস্তবের ইঞ্জিনের দক্ষতা কার্নোর ইঞ্জিনের চাইতে কম হবে, কাজেই সত্যিকারের ইঞ্জিনের দক্ষতা আরও কমলো । তবে কার্নোর বের করা দক্ষতার এই সমীকরণ থেকে বাস্তব-ইঞ্জিনের দক্ষতা বাড়াবার কিছু বুদ্ধি পাওয়া যায়, যেমন উচ্চ আর নিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য(T1-T2) যতো বেশি হবে ততোই দক্ষতা বাড়বে। বাস্তব প্রয়োজনে T2 কে আমরা কমাতে পারিনা, সেটা আমাদের হাতে নেই – কারণ সেটা সেই সময়ের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা। কেন আমরা T2-কে ইচ্ছে মতো কমাতে পারি না? কারণ আমরা যদি নিম্ন তাপমাত্রার আধার হিসেবে বায়ুমণ্ডলকে ধরি তবে সেই তাপ আধার আমদের তৈরি করতে হচ্ছে না – প্রকৃতি বিনামুল্যেই আমদের এই তাপ আধার যোগান দিচ্ছে; কিন্তু এর চাইতে কম তাপমাত্রার আধার তৈরি করতে আমদের কোনো কৃত্রিম যন্ত্রের সাহায্য নিতে হবে (যেমন- রেফ্রিজারেটর) এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানীর হিসেবও আমাদের গণনার মধ্যে আনতে হবে! সবমিলিয়ে দক্ষতা যে আরও কমবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অতএব আমরা একমাত্র চেষ্টা করতে পারি T1-কে যতোটা সম্ভব বাড়ানোর। সাধারণত ইঞ্জিন যে ধাতুর তৈরি তার সহনক্ষমতা এই তাপমাত্রার ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে।
সত্যি সত্যি বাজারচলতি গাড়ির ইঞ্জিনগুলির দক্ষতা কেমন? দেখা যাচ্ছে পেট্রোল ইঞ্জিনের দক্ষতা ৩৫% এর আশেপাশে আর ডিজেল ইঞ্জিনের দক্ষতা ৫০%এর কাছাকাছি। এর অর্থ, এক লিটার পেট্রোল পুড়িয়ে যে তাপশক্তি পাওয়া যাচ্ছে তার ৬৫% কোনো কাজেই আসছে না- স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে! ভাবুন একবার, গাড়ি চালাবার সময় কতো টাকা স্রেফ বাতাসে উড়িয়ে দিতে হচ্ছে! তাই গাড়ি চড়ার আনন্দের সঙ্গে যদি আসে বিষাদ, হাসির সঙ্গে যদি আসে কান্না – মনে রাখবেন এমনটাই বলে গেছেন রামশর্মা, থুড়ি তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সুত্র।
Comments
Post a Comment