মাতাল সঙ্গঃ সত্যম ভট্টাচার্য
মাতালসঙ্গ
সত্যম ভট্টাচার্য
সে সব আমাদের আকাশে বাতাসে ডানা মেলে ওড়বার দিন ছিলো। বাড়ির সুবোধ বালক স্টেশন থেকে ট্রেনে তুলে দেবার পরই যেন হাতে পেয়ে যেত নিজের জগত। তখন যার তার সাথে বন্ধুত্ব করা যায়। গোটা রাত কাটিয়ে দেওয়া যায় অচেনা লোকের সাথে আড্ডা দিয়ে। কেউ তো আর দেখতে আসছে না, কেউ বলতে আসছে না এ ভালো লোক নয়, এর সাথে মিশিস না বা ওর সাথে কথা বলিস না।
কারণ তখন তো বড় হচ্ছি। নিজের মতো করে লোকের সাথে আলাপ পরিচয় বা বন্ধুত্ব করবার এই তো মোক্ষম সময়। পৃথিবীটাকে জানতে হবে। লোককে চিনতে হবে। বাড়ি থেকে কখোনো জানতে পারলেই এসব বড় বড় সাম্যবাদী বুকনি ঝাড়ছি। যা বলছি তার প্রায় বেশীর ভাগটাই ইউনিভার্সিটি ক্যান্টিনে বামপন্থী নেতা দাদাদের কাছ থেকে শোনা। দরকারে নিজের মতো করে ঝেড়ে দিই। নিজেকে বেশ একটা কেউকেটা ভাবা শুরু করে দিয়েছি। বাড়ির বড়রা কিন্তু সব বোঝেন আর শুধু মুচকি মুচকি হাসেন।
এরকমই একবার, খুব সম্ভবত পুজোর পরই হবে, বাড়ি থেকে ট্রেনে তুলে দিলো। ইউনিভার্সিটি খুলে গিয়েছে। একমাস বাড়ি ছিলাম। চলে যাচ্ছি, সকলের মন খারাপ। সত্যি কথা বলতে আমার কিন্তু কোন মনখারাপ টারাপ নেই। এতদিন বাড়িতে থেকে যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। কোথায় মেস ইউনিভার্সিটির সেই মুক্ত পরিবেশ, দিগন্ত বিস্তৃত মহানগরের জীবন। আর কোথায় উত্তরবঙ্গের এক মফস্বলের বাড়ির বাঁধাধরা গন্ডি। সত্যি বলছি তখন বাড়িতে বেশীদিন থাকতে ভালো লাগতো না। শুধু বুকের ভেতরে আওয়াজ উঠতো পালাই পালাই।
যাই হোক বিশাল ট্রেন এসে গেলো মফস্বলের স্টেশনে। উত্তরের শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতিকে বিদায় জানিয়ে চললাম যেন মা বাবার স্বপ্ন সার্থক করতে। আসলে যে কি হচ্ছিল তা তো এখন বুঝি। বাস্তবিক তাদেরকে হাত দেখিয়ে নিজের জগত খোঁজার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পড়ে থাকলো দুই ধারের সোনালী ধানক্ষেত।
তবে এবারে আর বেশী খোঁজাখুজি করতে হল না। আমার কুপেই এক ভদ্রলোকের সাথে দারুণ জমে গেলো। আসলে বেশীরভাগ লোকজনই পরিবার পরিজন নিয়ে থাকাতে একা থাকা ছেলেদের সাথে মিশতে চাইতেন না। আবার আমরাও তাদের সাথে সহজ হতে পারতাম না। ফলতঃ আড্ডা জমতো না। যেটা ট্রেনের জেনারেল কামরায় জমে যায়। কিন্তু রিজার্ভেশন ছেড়ে জেনারেলে গেলে প্রচুর কষ্টও আছে। তাই এমন লোক খুঁজতে হবে যিনি রিজার্ভেশনে একা আছেন এবং একই সাথে আড্ডাবাজও। এই ভদ্রলোক সেরকমই একজন। অতএব আমাদের জমে গেলো। শুধু একটা বিষয়েই সামান্য খটকা লাগলো। দেখলাম মাঝেমাঝেই তিনি কোথায় উধাও হয়ে যাচ্ছেন। পাঁচ দশ মিনিট পরই আবার ফিরে আসছেন।
এরকমই একবার তাকে দেখতে পাচ্ছি না। কুপেরই পরিবার নিয়ে থাকা এক ভদ্রলোক আমাকে ফিসফিস করে বললেন - ভাই তুমি কি একে আগে থেকে চেনো? অবাক হয়ে বললাম- না তো, এই তো খানিকক্ষণ ট্রেনেই আলাপ। এবারে উনি বললেন -সাবধানে থেকো, উনি কিন্তু চরম। তারপর হাত দিয়ে একটা ঈশারা করলেন। ততদিনে আমি এই সব ঈশারা বুঝতে শিখেছি। মনে মনে আনন্দিত হয়ে উঠলাম।
বাহ, এতদিনে একটা কাজের কাজ করতে পেরেছি। একজন মাতালের সাথে এতদিনে নিজে বন্ধুত্ব জমাতে পেরেছি। কারণ তখন এরকম মাতালদের তখন আমরা রীতিমতো সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার চোখে দেখি। মফস্বলে এই কারণে যারা সুপরিচিত বাড়ির ভয়ে তো তাদের ত্রিসীমানায় যেতে পারি না বটে। কিন্তু মনটা যেন সবসময় সেদিকেই টানে। বন্ধুরা আলোচনা করি কে কতটা খেতে পারে তা নিয়ে। তাদের বিভিন্ন দুঃসাহসিক কীর্তিকলাপ নিয়ে। সেরকমই একজনের সাথে আলাপ করতে পেরেছি ভেবে গর্বে বুক একেবারে ফুলে উঠলো।
তখন বিকেল। ট্রেন চলছে নিজের গতিতে আশপাশের মাঠঘাট ধানক্ষেত পেরিয়ে। আমার নতুন বন্ধু কাম দাদার কাছে আমি তখন খুব প্রিয় ভাই। সবাইকে ডেকে ডেকে আমাকে দেখিয়ে বলছেন এ আমার ভাই। উনার দেখলাম প্রচুর পরিচিতি। জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে হু হু করে। তার কেনা বাদাম চিবুতে চিবুতে আমরা তখন গল্পে মত্ত। হঠাত তিনি- আমি একটু আসছি, বলে আবার কোথায় উধাও হয়ে গেলেন সেই পাঁচ দশ মিনিটের জন্য। জানালা দিয়ে তখন তেরছা রোদ এসে পড়ছে ট্রেনের ভেতর। অক্টোবর মাস। শীত পড়ছে। আমি আসন্ন আনন্দের দিনগুলির কথা ভাবতে ভাবতে বাদাম চিবুতে লাগলাম। পরদিন থেকে আবার ইউনিভার্সিটি, কতদিন পর বান্ধবীদের সাথে দেখা হবে। আবার মেসের জীবন শুরু হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। হাত এবং মুখ চলার কিন্তু বিরাম নেই। তাই অচিরেই বাদামও শেষ হয়ে গেলো একসময়।
এবারে ভদ্রলোক ফিরে আমায় জিজ্ঞেস করলেন- বাদাম কোথায়? হেসে বললাম শেষ হয়ে গিয়েছে। তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। প্রায় রক্তচক্ষু দেখিয়ে আমায় বললেন - বাহ,তুমি তো দারুণ ছেলে। বাদাম কিনলাম আমি আর তুমি শেষ করে দিলে? এবারে আমি ভিরমি খেলাম। সেই ভদ্রলোকের সাবধান বাণীর কথা মনে পড়লো। কাঁচুমাচু হয়ে বললাম- ভুল হয়ে গিয়েছে দাদা। হঠাৎ তিনি আমাকে এবারে জড়িয়ে ধরলেন। আর বলতে লাগলেন- আরে ভাই একটু বাদাম খেয়েছো, তাতে কি হয়েছে? আরো কত বাদাম খাওয়া যাবে। আমার তো এইরকমের অসংলগ্ন আচার আচরণ দেখে চক্ষু ছানাবড়া। আবার বাদামওয়ালা ডেকে বাদাম নিলেন। জোর করে আমাকে খাওয়ালেন। আমি কিন্তু এবারে সাবধান। বেশী খেলাম না।
ট্রেন গড়াতে গড়াতে ধীরে ধীরে সন্ধ্যে নামলো। বিহার দিয়ে চলছি। আমার আপার বার্থ ছিলো। এতসব ভুলভাল কান্ডকারখানার পর হতাশ হয়ে চা খেয়ে সেখানে গিয়ে শুয়ে আছি। কোনো একটা স্টেশনে ট্রেনটা খানিকক্ষণ থেমে থেকে ছাড়লো। চোখ বুজেই বুঝতে পারলাম আমাদের কামরায় প্রচুর লোকজন রিজার্ভেশন ছাড়াই উঠে গিয়েছে। তাদের বৈধ টিকিটধারী লোকজনের সাথে কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গিয়েছে। এ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই একদমই মাথা লাগালাম না।
হঠাত একদম পাশেই একটা ধুপ আওয়াজ পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। আর উঠেই বুঝলাম যে আমার নতুন দাদা একখানা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন। তিনি লোয়ার বার্থে শুয়ে ছিলেন। আর সেই যে অপাংক্তেয় যাত্রীরা যারা রিজার্ভেশন কামরার টিকিট ছাড়াই উঠে পড়েছিলো তাদের মধ্যে এক যুবক আমার সেই নতুন দাদার পায়ের কাছে গিয়ে বসেছিলো। কথা নেই বাত্তা নেই, তিনি তাকে একটি মোক্ষম লাথি কষিয়ে দিয়েছেন। হয়তো ধুনকিতে ট্রেনটাকে মাঠ ভেবে নিয়েছিলান তখন। তাই ওমন একখানা বেকহ্যামসম চালাতে পেরেছেন। ফলতঃ সে যুবক ভূপতিত, না মাপ করবেন ট্রেনপতিত হয়েছে। এবং তারা এখন দলবল মিলে আমার নতুন দাদাকে মারবেই। আর দাদাও তেমনি, কিছুতেই ওদেরকে ভুল হয়েছে বলবেন না। কি যেন একটা বলছে আর আমার দিকে দেখাচ্ছে। লোকগুলো আমার দিকে রক্তচক্ষুতে তাকাতেই আমিও আর ওদের কোনোরকম সময় দিলাম না।
এক লাফেই নেমে পড়লাম সেই আপার বার্থ থেকে। কোনক্রমে হাত পা সব জড়ো করে ওদের কাছে থেকে দাদার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে মনে হল জীবনে বেশ একটা কিছু করলাম। দাদা কিন্তু বিশেষ পাত্তা দিলেন না। যেন এটা হবারই ছিলো এমন একটা ভাব করে জাস্ট একপাশ থেকে আরেকপাশ ফিরে তিনি শুয়ে পড়লেন। কিন্তু এবারে আর আমি চাপ নিতে পারলাম না। নতুনদাদাকে বলেই ফেললাম- আপনি তো মশাই খুব সমস্যার লোক। তিনি বিশেষ পাত্তা দিলেন না। আসলে তার তো তখন পারফর্ম করবার সময়। সূর্য ডুবে গিয়েছে। তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন। তাহলে কথায় কাজ কি? এখন তো করে দেখাতে হবে।
নটা নাগাদ মালদহ এলো। মায়ের করা বাড়ির খাবার খুলে খেতে বসলাম। আর দাদাও দেখি নিদ্রা থেকে উঠে বসলেন। তারপর আমার হাতে তার ব্যাগখানা ধরিয়ে বললেন- এটা দেখো, আমি একটু আসছি। বলেই তিনি এত দ্রুত চলে গেলেন যে কিছু আর বলারই সুযোগ পেলাম না। জানালা দিয়ে দেখলাম তিনি টলতে টলতে কোথায় চলে যাচ্ছেন। সে যুগে এত পুলিশের কড়াকড়ি ছিলো না। স্টেশনে প্রায় সর্বত্রই নেশার দ্রব্য আকছার মিলতো। এখন হলে ভাবি কোথাও ঐভাবে যাবার আগেই উনাকে শ্রীঘরে ঢুকতে হতো।
যাইহোক একসময় ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেলো। বাঁশি বাজলো। এবং দাদা ফিরলেন না। কামরা এবং কুপের সবাই দেখলাম উনি না আসাতে বেশ খুশীই। খুবই স্বাভাবিক। কেই আর এমন উৎপাতকে সাথে নিয়ে চলতে চায়। কিন্তু আমার মনের অনুরাগ তখোনো দাদার প্রতি অটুট। শুধু জনগণ আমার বিপক্ষে চলে যেতে পারে বলে চু্প করে থাকলাম। ট্রেন ছেড়ে দিলো।
তখন মধ্যরাত। দুটো তিনটে হবে। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেলো। বুঝলাম ট্রেনটা কোথাও দাঁড়িয়ে আছে। আর কে যেন খুব জোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। জানালা দিয়ে দেখি পুলিশ। ঠিক যেভাবে জামাকাপড় হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা হয় তারা ঠিক সেভাবেই হাতে করে আমার নতুন দাদাকে নিয়ে এসেছে। কে যেন দরজা খুলে দিলো। ধপাস করে পুলিশ তাকে তার বার্থে জাস্ট ছুড়ে দিয়ে চলে গেলো। ট্রেনও ছেড়ে দিলো। আর এবারে তিনি উঠে বসে সহযাত্রীদের দায়িত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে লাগলেন। চোখ বুজেই বুঝতে পারলাম তার সব থেকে বেশী রাগ আমার ওপরেই। পাশ থেকে ব্যাগটা তুলে নিলেন। কিন্তু বাকি সবার মতোই আমিও কোন কথা না বলে চুপ করে ঘাপটি মেরে একপাশ হয়ে পড়ে থাকলাম। শুনলাম তিনি বলে চলেছেন আমাকে কত খাইয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভোর ভোর যখন শিয়ালদায় ট্রেন ঢুকলো দেখলাম তিনি গভীর ঘুমে অচেতন। টুক করে ব্যাগটা নিয়ে নেমে পড়লাম। তারপর থেকে আমি আর কখোনো অচেনা মাতালের সাথে আলাপ করি না।
Comments
Post a Comment