গিরগিটিঃ রাজা
গিরগিটি
রাজা
১
‘...কিন্তু, কাকু তুমিই তো বলেছিলে আজ বিকেলে যাবে! আমি সুবীরদাকে না করে দিলাম তোমার জন্য।’ ওপার থেকে কিছু কথা ভেসে আসে। ফোন কেটে দেয় শঙ্কু। ‘শালা সকাল সকাল দিল যাত্রা খারাপ করে।’ প্রচণ্ড রাগে খিস্তি বেরিয়ে আসতে চায় মুখ থেকে, কিন্তু, নিজেকে সামলে নেয়। এসব দু-তিন জন বাঁধা কাস্টমারই 'লক্ষ্মী', শিরদাঁড়া ভরসা। তা না হলে শহরের হাজার খানিক টোটোওয়ালাদের সঙ্গে কম্পিটিশান করে কত রোজগার হয় ভালই জানা আছে ওর।
স্নান সেরে সারাদিনের একটা ছক তৈরি করে নেয় শঙ্কু। সকাল সাড়ে দশটায় শ্যামলী দিদিমণির মেয়েকে পৌঁছে দিতে হবে শ্রীগুরু বিদ্যামন্দিরে, আর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফের আনতে যেতে হবে। এছাড়া আজ আর কোনো বাঁধা কাস্টমারের ডাক নেই। তবু, সন্ধ্যার আগে হিলকার্ট রোডের দিকে যাওয়া যাবে না। আজ পাড়ার আসে পাশেই থাকতে হবে। দুপুরে নেমন্তন্ন আছে, সৌরভদার বাবার শ্রাদ্ধের নেমন্তন্ন। শ্মশান যাত্রীদের মধ্যে ওর নাম আছে।
একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়া সৌরভ ব্যানার্জীকে দাদা বলেই ডাকে ও। না, কেউ বলে নি, বাধ্যও করে নি। সবাই সম্মান দিয়ে দাদা বলে ডাকে তাই...!
স্কুলে জীবন থেকেই সৌরভ ব্যানার্জীর মধ্যে লিডারশিপ দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, তা সে খেলার মাঠে হোক, বা স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখায়। শঙ্কু ছিল তার বিশ্বস্ত সাগরেদদের মধ্যে একজন, মানে ওই স্কুলের গন্ডি অব্দি। কলেজ থেকেই প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতিতে যোগদান সৌরভের, জি এস নির্বাচনে ব্যাপক মার্জিনে জয়, ব্যাস, আর ঘুরে তাকাতে হয় নি। তারপর দু -দুটো দল বদলে এখন তৃতীয় দলের ডাকসাইটে যুবনেতা সৌরভদাকে উপরতলা থেকে নীচতলা সবাই এক ডাকে চেনে। ভোটের সময় শঙ্কুর টোটো এক মাস আগে থেকে বুক করে নেওয়া হয় সৌরভদার নির্দেশে, প্রচার এবং অন্যান্য কাজের জন্য। এছাড়াও সারা বছর কিছু না কিছু কাজের ডাক আসতেই থাকে যুবনেতার কল্যাণে। স্কুলের সহপাঠী, সাগরেদকে ভুলে যায় নি তুখোড় যুবনেতা। সেই কারণেই সৌরভদার প্রতি শঙ্কুর এক লোকদেখান আনুগত্য আছে।
এমনিতে শ্রাদ্ধ বাড়ির নেমন্তন্ন এড়িয়ে চলে শঙ্কু। বিয়ে কিংবা অন্নপ্রাশণে তাও কিছু কথা আদান-প্রদান করা যায়। নিদেন পক্ষে হাসি বিনিময়। কিন্তু এই শ্রাদ্ধবাড়িতে ঠিক কী করতে হয়, হাসতে হয় না মুখ গোমড়া করে থাকতে হয় বেচারা বুঝে উঠতে পারে না, খুব ঘাবড়ে যায়। কিন্তু সৌরভদা কে এসব কথা বলা যায় না। এত বড় মানুষ যে ওর মতো অতি-সাধারণ এক টোটোওয়ালাকে নিজের বাড়িতে ডেকেছেন, এ কি আর চারটিখানি কথা! ডানদিকে অনেকটা মাথা ঝুঁকিয়ে পার্টির ছেলেদের শঙ্কু জানিয়েছিল, তিনটের মধ্যে পৌঁছে যাবে।
২
মানুষের শোকের রঙ সাদাই কেন? আর যদি তাই হয় তাহলে হাসপাতাল, নার্স, ডাক্তার সবই বা সাদা কেন? তবে কি মৃত্যুর কাছে মানুষের অসহায়তা বার বার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই সাদা রঙ কে এভাবে ব্যবহার করা হয়! সৌরভদার বাড়ি যেতে যেতে এসবই ভাবছিল শঙ্কু। হঠাৎ খেয়াল হল, বড়লোকদের বাড়ির ব্যাপার স্যাপার। এক থোকা রজনীগন্ধা নিয়ে যাওয়া উচিত।
সাদা প্যান্ডেল, সাদা পাঞ্জাবি ভিড়, শঙ্কুর পরনে ক্যাটক্যাটে নীল শার্ট। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল প্রথমে কিন্তু আসার পর থেকে এত কাজ করতে হয়েছে যে সেসব ভাবনা এখন হাপিস। সাড়ে চারটেতে স্কুলের সামনে পৌঁছাতেই হবে, তার আগে যেভাবেই হোক খাওয়ার টেবিলে একটা জায়গা দখল করা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত সৌরভদার সঙ্গে কথা হয় নি। অতিথি আপ্যায়নে খুব ব্যস্ত। শঙ্কু ভেবেছিল আজ কোন রকম খাওয়া সেরে কেটে পরবে, পরে দেখা করে নেওয়া যাবে। কিন্তু গেটের সামনে সৌরভদার সঙ্গে দেখা হয়েই গেল। সম্ভবত বিশেষ অতিথিরা সবাই চলে গেছে, সৌরভদা এখন রীতিমতো আড্ডার মুডে। ছোটখাটো এক জটলা, স্বভাবতই যুবনেতা মধ্যমণি, কোনো একটা ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছিল। শঙ্কুর দিকে চোখ পড়তেই ওকে ডেকে নেয় ভিড়ের কোনো একজন। সামনে যেতেই কাঁধে হাত রেখে সৌরভদা বলে ‘আড়াই প্যাঁচের মাংস খাচ্ছিস না তো? ওসব কিন্তু আমাদের জন্য মহাপাপ।’ এমন অদ্ভূতুড়ে এবং আকস্মিক প্রশ্নে ঘাবড়ে যায় শঙ্কু। সেটা আন্দাজ করতে পেরে সৌরভদা আবার বলেন, ‘শোন, একতিয়াসাল বাজারে আমাদের দুই ভাই বলি দিয়ে কাটা পাঁঠার মাংস বিক্রি করে, ওখান থেকেই কিনবি, কেমন ...?’ মৃদু হাসে শঙ্কু, তারপর কী সব যেনো কথা চলতে থাকে, ও শুনতে পায় না।পেট গুলিয়ে উঠে ...। নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে কোনোরকমে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়েসি ছেলেটাকে প্রশ্ন করে ‘আচ্ছা খাসির মাংস এখন কতটাকা কিলো যাচ্ছে?’
৩
রাজ্যের শাসক দল বদলতেই রাতারাতি নতুন ক্ষমতাশীল দলে নাম লিখিয়েছিলো সৌরভ ব্যানার্জী। এ ঘটনা ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু ৬-৭ বছর যেতে না যেতেই যখন সৌরভ শাসক দল ত্যাগ করে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা দলে ঢুকে পরে, সেটা ছিলো বড় খবর। রাজ্যের ছোট বড় সব খবরের কাগজে উঠে এসেছিল সৌরভ এর নাম। এতে বেশ ভাল মাইলেজ পেয়ে যায় যুবনেতা, তার সঙ্গে জুঠে যায় হাই কমান্ডের নেক নজর। লোকাল চ্যানেলে একটি সাক্ষাৎকারে সৌরভদা বলেছিল ‘আমি মানুষে সেবা করতে এসেছি, মানুষের সেবাই করতে চাই, রাজ্যে ক্ষমতাশীল দল আমাকে হাত খুলে কাজ করতে দিচ্ছিলো না, তাই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।’ বিনোদদা-র চায়ের দোকানে বসে সে সাক্ষাৎকারে শুনেছিল শঙ্কু। নিজের অজান্তেই ‘বোকাচোদা’ শব্দ বেরিয়ে গেছিল মুখ দিয়ে। শ্রীগুরু স্কুলের দিকে যেতে যেতে কত সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মাংসের আলোচনা থেকে কোনো ভাবে পালিয়ে এসেছে ও। আর খেতে ইচ্ছে করে নি। আজ শঙ্কুর টোটো আগে না গিয়ে যেন পেছনের দিকে, অনেক পেছনের দিকে যাচ্ছে।
রাজ্যের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেনি তখন। পালাবদল যে হতে পারে স্বপ্নেও ভাবছে না কেউ। সৌরভ তখন উঠতি নেতা। গোটা পাঁচেক চামচা নিয়ে পাড়ায় বুক ফুলিয়ে ঘোরে। উচ্চমাধ্যমিকের পরে আর পড়াশোনা করে নি শঙ্কু। বাবার অসুখ সবে ধরা পড়েছে। অবশ্য মা চলে যাওয়ার পর থেকেই বাবা একটু একটু করে ফুরোতে শুরু করেছিল। অসুখটা তার পরিণতি মাত্র। কলেজের গেট দেখা হয়নি শঙ্কুর। ও রতনদার গ্যারেজে ঢুকে গেলো। সেদিন বাবার শরীর ভালো ছিল না। সন্ধে ছটা নাগাদ বাড়ি ফিরছিলো। ভীমদার মাঠ পার হতে যাবে এমন সময় সৌরভদার সাঙ্গপাঙ্গ ধরে ফেলে ওকে। জোর করে নিয়ে যায় অন্ধকারে বসে থাকা সৌরভদার কাছে। গলা অবধি রাম খেয়ে উঠতি নেতা তখন মহারাজাধিরাজের ভূমিকায়। একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে "গিলে ফেল"। শঙ্কু বলে বাবা আছে বাড়িতে। সৌরভ বলে ‘বেশ, তাহলে এটা খা’। ‘কী ওটা’, জানতে চায় শঙ্কু। সবাই হেসে উঠে, চামচাদের একজন বলে, ‘বড় মসজিদের পেছন থেকে এনেছি, ইস্পেশাল শিক কাবাব, খা।’ বুঝতে অসুবিধে হয়না শঙ্কুর, আপত্তি করে বলে, ‘আমি এসব খাই না।’ তারপর টের পায়, অন্ধকারে কেমন বদলে যাচ্ছে সৌরভ এর মুখ। খুব শান্ত গলায় সে বলে, ধর্ম সমাজের ড্রাগস, ধর্মের মামদোবাজি না রুখতে পারলে সমাজের উন্নতি সম্ভব না, তোর উন্নতিও সম্ভব না, খেয়ে ফেল, আমরা এক নতুন সমাজ তৈরি করব। খুব ভয় হয় শঙ্কুর, তবু শরীরের সব শক্তি এক করে ও আর একবার ‘না’ বলে। এবার চিৎকার করে উঠে সৌরভ ব্যানার্জী। ‘বাঞ্চোৎ! এর হাত ধর তো।’ দু-তিন জন হাত ধরে ফেলে ওর, আর সঙ্গে সঙ্গে ওর গাল চিপে ধরে একজন। মুখটা একটু খুলতেই, তার ভেতরে কয়েকটা মাংসের টুকরা পুরে দিয়ে নাক আর মুখ চেপে ধরেছিল সৌরভ। ভীষণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল ওর। নিজেকে বাঁচাতে শেষমেশ টুকরোগুলো গিলে ফেলে শঙ্কু। কোনো ভাবে পালিয়ে আসে সেখান থেকে। বাড়ি ফিরে আজন্ম ঈশ্বর ভীরু, গলায় কন্ঠির মালা পরা বাবাকে দেখে কান্না পায় খুব। বাথরুমে ঢুকে স্নান করে, বমি করার চেষ্টা করে, কিন্তু হয় না। নিজের অসহায়তার উপর ভীষণ রাগ হয় শঙ্কুর, সজোরে চিৎকার করতে গিয়ে অদ্ভুত ভাবে ডুকরে উঠে।
এরপর বহু বছর সৌরভের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি । ততদিনে রাজ্য রাজনীতিতে নিজের শেকড় গেড়ে দিয়েছে সৌরভ ব্যানার্জী। দল বদল করে যোগ দিয়েছে নতুন শাসক দলে। এদিকে বাবা মারা যাওয়ার পর গ্যারেজের কাজ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে শঙ্কু। ও তখন একটা সেগেন্ড হ্যান্ড টোটো কেনার চেষ্ট চালাচ্ছে। একদিন রতনদাই ওকে জানায় পাথরকাটায় সৌরভের নতুন টোটো শোরুম এর কথা। অনেক বছর পর সৌরভ এর সঙ্গে দেখা করে ও। সৌরভ তখন অনেক পরিণত, ইনস্টলমেন্টে টোটো কেনার ব্যবস্থা করে দেয়। আর কথা দেয় সারাবছর এমন কাজ দেবে যে আর কোথাও ভাড়া মারতে হবে না। সাথে বলে খুব জলদি চাম্পাসারী এলাকায় যে পনের তলা হাউসিং কম্প্লেক্স তৈরি হবে, সেখানে সিন্ডিকেটে ওর নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। মাসে মাসে কোনো খাটনি ছাড়াই দু'তিন হাজার পেয়ে যাবে। সিন্ডিগেটে শঙ্কুর নাম থাকলেও, প্রথম দু'মাস একহাজার করে পাওয়ার পর আর কিছু পাইনি। সৌরভদাকে জানিয়েছিল, কোনো উত্তর পাওয়া যায় নি। শঙ্কু বুঝেছিল যা আসছে তাতেই খুশি থাকা মঙ্গল। বিপ্লব মারাতে গেলে আম ও ছালা দুটোই চলে যাবে। বছরভর পার্টির তরফ থেকে কিছু না কিছু কাজ যে পায়ে যাচ্ছে এ-ও তো অনেক।
কিছুদিন আগেই সৌরভদার জন্মদিন ছিল। কুটুশদার কাছ খবর পেয়ে, মোবাইলে এ হ্যাপি বার্থডে লিখে পাঠায় শঙ্কু। সকালে করা মেসেজের উত্তর আসে রাতে, যাতে লেখা ছিল, ‘বীর সেনানি, শত্রুদের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। আমাদের ধর্ম আজ সংকটে। তৈরি হও, শত্রু বিনাশের অঙ্গীকার নিয়ে অস্ত্রে শান দাও।’ জন্মদিনের শুভকামনার উত্তরে এমন একটা উত্তর অবাক করে শঙ্কুকে। ভীমদার মাঠের ধর্মবিদ্বেষী সৌরভদার সঙ্গে এই ধর্মরক্ষক সৌরভকে মেলাতে গিয়ে কেমন যেন হাসি পেয়েছিলো ওর। কিন্তু আজ সৌরভদার খাসির মাংসের গল্প শুনে পেট গুলিয়ে উঠে । জোর করে মুখে গুঁজে দেওয়া সেই শিক কাবাবের গন্ধ আর স্বাদ টের পায়। চাম্পাসারি মোড় পার করেই পেটে একটা মোচড় দিয়ে ওঠে। শঙ্কু সুজি মিলের সামনে কোনোভাবে টোটো দাঁড় করায়। তারপর রাস্তার পাশে ঝুঁকে পড়ে বমি করতে থাকে। শঙ্কু জানে হাজার চেষ্টা করেও সৌরভ ব্যানার্জীর একটি বালও ছিঁড়তে পারবে না ও। খুব কান্না পায়। কণ্ঠীর মালা পরা বাবার মুখ মনে পড়ে । বাবার চোখে চোখ না রাখতে পারার কষ্ট মনে পড়ে। শ্মশানে অপরাধীর মত বাবার দেহ ছুঁয়ে থাকার কথা মনে পড়ে। খালি পেট তবু বমি দিয়ে কীসব যেনো বেড়িয়ে আসছে অনবরত। চোখ কচলে শঙ্কু ভাল করে দেখার চেষ্টা করে । কী বেড়িয়ে আসছে এসব! বহুবছর আগে মুখে চেপে ধরা সে পোড়া মাংসের টুকরো কি নাকি একটা সময় ... ?
Comments
Post a Comment