ছোটবেলার লেখালিখিঃ সোমঋতা রায়

 

ছোটবেলার লেখালেখি

 সোমঋতা রায়

 

আমার বোন ছোটবেলায় বেশ ভালো লিখত। সেটা অনেকে না জানলেও আমি জানতাম। কারণ ও আমায় মাঝে মাঝে পড়তে দিত। আর মাঝে মাঝে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে ফেলতাম। ছোটবেলায় আমরা বেশিরভাগই চার লাইনের ছড়া কিম্বা পাঁচ লাইনের গল্প লিখেই ক্ষান্ত থাকতাম কিন্তু আমার বোন সেই দলের মানুষই ছিল না। ও লেখা শেখার কয়েক বছরের মধ্যেই  লিখে ফেলেছিল একখানা আস্ত উপন্যাস। তেরো পাতার। যার মধ্যে এক পাতা জুড়ে বর্ণনা ছিল জাপানে এক্সপিডিশনে যাওয়ার সময় ব্যাগে কী কী নিতে হবে। সেই লিস্টে জায়গা করে নিয়েছিল ওয়াটার বোতল, ভাঙা দূর্বীন, দড়ি, আরও কতো  কী! জাপানে গিয়ে বোন এবং তার বন্ধুরা বাওবাব গাছও দেখেছিল (তার আগেই আসলে সে 'চাঁদের পাহাড়ের' গল্প শুনেছিল দিদানের কাছে।)। তো সেই বাওবাব গাছের গুঁড়িতেই লুকিয়েছিল যত রহস্য। রহস্য রোমাঞ্চ ও ম্যাজিকে ভরপুর তেরো পৃষ্ঠার এই উপন্যাস অবশ্য প্যারাগ্রাফের ধার ধারেনি। দাঁড়ি, কমাও খুব একটা জায়গা করতে পারেনি লেখায়। 

আমরা ওর এই কাজ সম্পুর্ণ করার ক্ষমতা দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলাম। আজও ও সব কাজ গুছিয়ে শেষ করে। আর আমার কোনো লেখাই সম্পূর্ণ হয় না। বইগুলোও আধ খাওয়া হয়ে পড়ে থাকে। 

যদিও ওর শিক্ষা দিক্ষা এবং উন্নতির  পিছনে আমার বিশাল অবদান আছে বলেই আমি বিশ্বাস করতে পছন্দ করি। যখন আমার সবে সবে অক্ষর জ্ঞান হচ্ছে, মানে ‘জবা ফুল লাল’, ‘মালা ফুল তোলে’, ‘কলা গাছে কলা’ ইত্যাদি লিখতে পারছি তখন বোন নেহাতই খুদে। তার তখনো স্কুলে যাওয়ার বরাত হয়নি। সেই সময় ঝগড়া হলে আমি ওকে ‘অশিক্ষিত বলে ভৎসনা করতাম। ওর জীবনের উদ্দেশ্যই হয়ে উঠেছিল এই অপবাদ ঘোচানো। তাই যেদিন ও আনন্দ পাঠশালায় গিয়ে লিখতে পড়তে শিখল সেদিন আমায় বলেছিল, ‘দিদি এখন তুই কিন্তু আর আমায় অশিক্ষিত বলতে পারবি না!’

তারপর থেকে অবশ্য আমি আর বলি নি। তবে তখন ঝগড়া হলে ‘চার ফুটিয়া’ বলে গাল দিতাম। সেই পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরের কাছে ও অনেক প্রার্থনা করেছিল। পরে উনি যদিও ওকে গ্রেস মার্ক্সে পাশ করিয়ে দেন, তবে এটা তো অস্বীকার করে লাভ নেই আমার হিংস্রতার কল্যাণেই ও বুঝে গেছিল কোনটা মানুষের হাতে থাকে আর কোনটা ভগবানের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু যেটা নিজেদের হাতে থাকে সেটা কোনো মতেই ছাড়া উচিত নয়।

 

হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল, ছোটবেলার কথা, স্কুলের কথা। আমার মনে হয় আমরা যারা কমবেশি লিখতাম বা লিখতাম না তারা সবাই বাড়িতে নিজস্ব খাতায় প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে গল্প লিখতাম। সেই সব লেখা দু-মলাটেই বন্দী থাকত কিম্বা কখনো সখনো বিশ্বস্ত বন্ধুদের পড়তে দেওয়া হত। মনে আছে এক বান্ধবী 'কহোনা প্যার হ্যা' দেখে এমন মুগ্ধ হয়েছিল যে এক খাতা গল্প লিখে ফেলেছিল সোনিয়া আর রোহণ নামক দুটি চরিত্র নিয়ে। তারা অবশ্য মুম্বাইতে থাকত না বরং থাকত শান্তিনিকেতনেই, ঘুরত সাইকেলে, ফুচকা খেত, প্রেম করত। সে যুগে বুঝিনি আসলে সে আস্ত একখানা Fanfiction  লিখে ফেলেছিল।

যাই হোক, প্রেম ভালোবাসা নিয়ে গোপনে লেখালেখি হলেও তারা কেউই সাহিত্য সভার মঞ্চে পৌঁছত না। স্কুল পড়ুয়া প্রেমের কথা লিখছে! তাও আবার সর্ব সমক্ষে পড়ছে! ভাবাই যেত না! যদিও আমরা গুরুদেবের প্রেম পর্যায়ের গান দিব্বি গাইতাম, কবিতাও পাঠ হত। একদিন অকস্মাৎ সাহিত্যসভায় কে একজন একটা প্রেমের লেখা পড়ে ফেলল। সগর্বে, সদর্পে পড়ল। শুনে তো সবাই থ! শেষ হতে সাধুবাদ জোরে দেবে না আস্তে সেই নিয়ে দর্শক ভেবে আকুল! পরে যদিও এই ‘বৈপ্লবিক ঘটনা’/ ‘ডেঁপোমি’ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল বিস্তর। তবে সেই দিন কিন্তু হেব্বি মজা হয়েছিল!

 

ছোটবেলায় আমি নিয়মিত ডাইরি লিখতাম। মানে প্রতিদিন কী খেলাম, কী পড়লাম এসব নয় কিন্তু। আমার ডাইরি পড়ে যাতে কেউ কিছু না বুঝতে পারে তাই পুরোটাই লেখা হত গল্পের আকারে। অর্থাৎ সেই গল্পে আমি নায়িকা হলেও নাম ছিল ধরা যাক শ্রাবণী। বন্ধুদেরও আলাদা আলাদা নাম দিয়েছিলাম। সমস্যা হল, মাঝে মাঝে নিজেই ভুলে যেতাম কার কী নাম দিয়েছি। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ডাইরির পিছনের পাতায় আসল ব্যক্তি এবং পাশে তার নকল নাম লিখে রেখেছিলাম। মা ডাইরি খুলে পড়লে তো আর পিছনের পাতা খুলে দেখবে না! আর বুঝতেও পারবে না আসলে এটা গল্প নয়, ঘোর বাস্তব! তখন বড়রা একটা ডায়লগ খুব বলত, ‘তোমরা চলো ডালে ডালে, আমরা চলি পাতায়, পাতায়।’

তখন ভাবতাম এরা নিজেদের বেশি চালাক মনে করে! এখন বুঝি আসলে নিজেকে চালাক কোন গাধার দল মনে করত! 

ডাইরি লেখা নিয়ে আমি বিস্তর কেস খেয়েছি। মা ডাইরি পড়ে আমার যাবতীয় কুকীর্তি বা কুমতলব জেনে যেত। এবং ডাইরি পড়েছে বলে তার কোনো লজ্জাবোধও দেখিনি কখনো। আসলে ছেলে মেয়েরা তো মা বাবার সম্পত্তি। তাদের আবার পার্সোনাল স্পেস কী! আমার তো মনে হয় এখনো পারলে মা আমার ডাইরি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে নেবে।

দিদানের আলমারির মাথায় একটা পেপার স্ম্যাসের বাটিতে খুচরো পয়সা রাখা থাকত। বাড়ির যাবতীয় খুচরো পয়সা ওখানে রাখা হত এবং বড়দের ধারণা ছিল যে উচ্চতার কারনণই ওটা আমাদের নাগালের বাইরে। কিন্তু বাড়িতে মোড়া, চেয়ার এসব থাকতে উচ্চতা আবার সমস্যা নাকি! ফলে আমি আর বোন মাঝে মাঝেই কিছু খুচরো পয়সা আপন করে নিতাম। সে ভালো কথা। লজেন্স, চপ, ফুচকা চুরির পয়সায় খেতে অনেক ভালোলাগে সে সবাই জানে। এখন সমস্যা হল, এই ঘটনা আমার ডাইরিতে শ্রাবণীর ঘটানোর তো কোনো মানে ছিল না! ফলে যা হবার তাই হল। মা একদিন খুব জ্ঞান দিল কেন চুরি করা মহা পাপ। তারপর শোনালো নামি দামি মানুষের ছোটবেলার গল্প। তারা কত সৎ ছিল এই আর কী! আমি যত বোঝাতে চাই পুরোটাই ফিকশন, আমার কোনো দোষ নেই, কে শোনে কার কথা! অবশ্য মাঝে মাঝে শ্রাবণী সত্যি এমন কিছু করত যা আমি করিনি। যেমন মায়ের বোঝানোর পর শ্রাবণী কতটা অনুতপ্ত সেটা সে ডাইরিতে লিখল। এটা বুঝেই লিখল যে তার অনুতাপের উষ্ণতা কিছুক্ষণ বাদেই নেওয়া হবে। মা ভাবল, যাক নিজে বুঝেছে! কিন্তু মা তো আসলে বোঝেনি যে ওটা শ্রাবণী বুঝেছে, মেয়ে নয়। মা-কে বোঝানোর জন্য এমন অনেক গল্পই বানিয়ে লিখতে হয়েছে ছোটবেলায়। 

কালক্রমে আমার প্রায় সাত আট খানা ডাইরি হয়েছিল ওই হাবিজাবি বানানো গল্প লিখে। নিজের বোঝার সুবিধার্থে সেই ডাইরিগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ১ম ডাইরি, ২য় ডাইরি, ৩য় ডাইরি … এই ভাবে লিখে রেখেছিলাম। বড় সুন্দর ছিল ডাইরিগুলো। কোনোটা ছিল রঙিন কাপড় দিয়ে মোড়া, কোনোটার উপরে আটকানো ছিল শুকনো ফুল-পাতা, কোনোটার গা জুড়ে আবার ছিল হাতে আঁকা ছবি। বেশির ভাগ ডাইরিই যদিও মা দিয়েছিল। তবে আমি ছাড়া আর কেউ অবশ্য এই ডাইরি গুলোকে উন্নত মানের কিছু মনে করত না। বরং বেশ লজ্জাই পেত। একবার বাড়িতে লোকজন আসার কথা। অর্থাৎ গেস্ট। খুব ঘরদোর গোছানো হল। লোক আসার আগে যেমন সব বাঙালি বাড়িতেই হয় আর কি! তারপর থেকেই আমার ডাইরিগুলো হারিয়ে গেল। অত্যন্ত লজ্জাজনক বিষয় যেমন লুকিয়ে ফেলা হয় সেই ভাবেই হাফিস করে দেওয়া হল তাদের। সব ছেলেমানুষি নিয়ে তারা ভ্যানিশ হয়ে গেল। অবশ্য কেউ স্বীকার করল না ওদের গুম করার পিছনে কার হাত ছিল আসলে। 

যদিও এতেও আমাকে দমানো যায়নি। খারাপ লেখা আমি আজও নির্লজ্জের মতোই লিখি। এখন পাত্র-পাত্রীরা আর ছদ্মনামের আড়ালে থাকে না শুধু। ডাইরীও খাটের পাশেই ফেলে রাখি। শ্বশুরবাড়িতে অবশ্য কেউই আমার ডাইরি খুলে পড়ে না। মাঝে মাঝে মনে হয় পড়লেও মন্দ হত না। কী গিফ্ট চাই, কী কারণে অভিমান হয়েছে এগুলো আর মুখ ফুটে বলতে হত না তাহলে! অবশ্য এটা হয় না বলেই আমি সুখে আছি। সব মানুষই এক টুকরো নিজের জগৎ চায়। একটু জায়গা যেখানে থাকবে না আর কারো অধিকার। সবার ভাগ্যে কিন্তু এইটুকু ছাড় থাকে না। অনেকেই কিন্তু আপাত ভাবে স্বাধীন অথচ তারা সারাক্ষণ বাস করে চলেছে প্যানপটিকনের নজরদারিতে। এমন মানুষ কিন্তু আসলে বড্ড কষ্টে থাকে। এমন মানুষরা আস্তে আস্তে লিখতে ভুলে যায়। তারা তোতা পাখি হয়ে যায়। সেই পেটে বিদ্যে ভরা তোতাটা! 



 মূল পাতায় যান

Comments

Popular posts from this blog

সূচীপত্রঃ শারদ সান্ধ্য জলপাইগুড়ি

বাজারি গপ্পোঃ নিঝুম ঠাকুর