আলাভ্যু, মধুর নাম আই লাভ ইউঃ বিজয় দে
আলাভ্যু ... মধু’র নাম আই লাভ ইউ
বিজয় দে
১
এতদিনে নিশ্চয় অনেকেই জেনে গেছেন, মধুবালা রিজার্ভ ফরেস্ট’এর অবস্থানটি ঠিক কোথায়।যারা ওই ফরেস্টে গিয়েছেন, তারা তো সব জানেনই,কিন্তু যারা যাননি বা যাওয়ার ইচ্ছে আছে ষোলআনা,তাদের জন্যেই এই বার্তা।
হ্যাঁ, দুগ্গা দুগ্গা করে বাড়ি থেকে তো বেরোলেন। বেরিয়ে সো-জা নাক-বরাবর ডাজোলগোবার মোড়,সেখান থেকে বাম দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলে ঠাকামবাড়ি হেরিটেজ আউটপোস্ট, সেখান থেকে উত্তরদিকে আবার সো-জা অনেকটা পথ গেলে লাওদবাড়ি পার্ক, সেখান থেকে আবার একবার ডানদিকে, আরেকবার বামদিকে কিছুটা গেলে বিখ্যাত বরুগাথান ভ্যালী, না অদ্দূর যেতে হবেনা, ভ্যালী’র আগেই দেখবেন ডানদিকে রাস্তার পাশে শালগাছে একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে ,সেখানে লেখা “মধুবালা রিজার্ভ ফরেস্ট”। ব্যাস,চলে এলেন। সকাল সকাল যাবেন আবার রাতে রাতেই ফিরবেন। অবশ্য সেখানে রাত কাটানোর ব্যবস্থা আছে। ইচ্ছে করলে থাকতেও পারেন।
এমনিতে এটা খুব ‘পীসফুল এরিয়া’, কোনও ঝুট-ঝামেলা নেই। কিন্তু অনেকদিন ধরেই একটা কানাঘুষো চলছিলো, অন্ধকার হলেই নাকি, মধুবালা রিজার্ভ ফরেস্টে,গভীর জঙ্গলের ভেতরে,গাছে গাছে,পাতায় পাতায়, ডালে ডালে, রহস্যজনকভাবে অসংখ্য টুনিবাল্ব জ্বলে ওঠে। আলোগুলো জ্বলছে আলোগুলো নিভছে, আলোগুলো নিভছে আলোগুলো জ্বলছে,এরকম। ফলত, গোটা জঙ্গল জুড়ে তখন নাকি অদ্ভূত অদৃষ্টপূর্ব রঙিন আলো ... গোটা জঙ্গল আলোয় ভরে ওঠে। কাছাকাছি কোনও পাহাড়ের ওপর থেকে যদি “মধুবালা রিজার্ভ ফরেস্ট”এর দিকে তাক করে এক ঝলক তাকানো যায় কিম্বা ছবি তোলা যায়, তখন মনে হবে, মনে হবেই, অন্ধকারে যেন এক টুকরো স্বর্গ ফুটে আছে।স্বর্গ সম্পর্কে আমরা, সাধারণ মানুষেরা যেরকম ভাবি, কল্পনায় স্বর্গের চেহারা তো এমনই হবে, নয় কি?
এছাড়া আরও একটি অদ্ভূত ব্যাপার, এই অভয়ারণ্যে সারাদিন অসংখ্য পাখির কিচির-মিচির, লক্ষ লক্ষ ঝিঁঝিসহ অন্যান্য পোকার হৃদয়-বিবশ-করা ডাক, সারাদিন সাপ-বেজি-বানরের অবাধ চলাচল, কিন্তু সন্ধেবেলা টুনিবাল্ব জ্বলে উঠলেই সব শান্ত সব চুপ। অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গলে সন্ধে থেকে ভোর পর্যন্ত তো চিরাচরিত নিস্তদ্ধতারই সময়, কিন্তু এই নিস্তদ্ধতা যেন জো্র করে সকলকে চুপ-করানো। যেন এক প্রচ্ছন্ন হুকুমদারি চালু আছে … যেমন
‘যেখানে যাই থাক, সব কিছু রসাতলে যাক এখানে আমাদের কথাই শেষ কথা।
আমরা বলবো আপনারা শুনবেন। কেউ টুঁ শব্দটি করবেনা ।
‘দুয়ারে টুনিবাল্ব’ আমাদের ঘোষিত কর্মসূচি’!
এদিকে জঙ্গলের পশু-পাখি-পোকাদের ভাষা যদি অনুবাদ করা যায়, তবে অনেকটা এরকম দাঁড়াতঃ
‘শালা,এই হয়েছে এক নতুন উপদ্রব, কয়েক বছর ধরেই দেখতে পাচ্ছি, সন্ধে হলেই যখন-তখন টুনিবাল্ব জ্বালানো হচ্ছে, নেভান হচ্ছে, তোদের কা’র যে বাপের বিয়ে লাগলো কে জানে, আমাদের কি কোনও গোপনীয়তা থাকতে নেইরে … ‘প্রাইভেসি’ ‘প্রাইভেসি’, হতভাগারা ‘প্রাইভেসি’র মানে বুঝিস? তোরা কি জঙ্গল থেকে আমাদের উচ্ছেদ করতে চাস্?’
এসব কথা তো জঙ্গলের চারপাশের লোকজন নিশ্চয় কেউ কেউ জানে বা জানত। আমাদের কাছেও বিভিন্ন সূত্রে নানা খবর এসেছে, তা’ নইলে এতটুকুই বা লিখলাম কী করে! কিন্তু গোটা সরকারী অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কেউ নাকি এসবের বিন্দু-বিসর্গ জানত না, এবং বলা বাহুল্য, এটা জনগণের বেশির ভাগ অংশই বিশ্বাসও করছেন না। ‘আরে আরে, এরা সব জানতো, সবই এদের নজরে আছে। জেনেও চোখ বুজে ছিল।’
তো যাই হোক,এখন আমাদের জানার প্রবল ইচ্ছা,এই কান্ড ঘটানো কি সত্যিই সম্ভব? এবং যদি হয়েও থাকে, তাহলে কীভাবে সেটা সম্ভব?
অবশেষে আসরে নামলেন সরকারী দন্ডমুন্ডের কর্তা নিচন্দ্রঝুম সাহেব, যিনি সর্বত্র ঝুমসাহেব নামেই পরিচিত (এবং আমরাও এখন থেকে তাকে ঝুমসাহেব নামেই ডাকব), সবার সামনে দাঁড়িয়ে যা বললেন, তিনিও নাকি এটা জানতেন না। তার কথায় ‘আরে ভাই, এতদিন ধরে এসব কান্ড চলছে,আমি এটা আমি জানতামই না। জানলে পরে নিশ্চই একটা ব্যবস্থা নিতে পারতাম! এই জঙ্গল তো আমাদের সরকারেরই অংশ! কিম্বা এই সরকারটাই আমাদের মধুবালা জঙ্গল!’
তাই তিনি যেন গোয়েন্দাদপ্তরের কাছ থেকে গোপন-বার্তা পেয়েছেন, এরকম একটা ভাব আর তাই বার্তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিকেলবেলা, গাড়ি-ঘোড়া-সিপাহীসলার নিয়ে ঝুমসাহেব পৌঁছে গিয়েছেন। পৌঁছে গেলেন অকুস্থলে, অর্থাৎ জঙ্গলে। তারপর একটু অপেক্ষার পর, অন্ধকার হতেই, লক্ষ্য করলেন, আশ্চর্য, যা শুনেছেন তা’এক্কেবারে ঠিক, কোত্থাও কোনও ভুল নেই। দেখতে অবশ্য, ভিস্যুয়ালি খুবই ভালোই লাগছে কিন্তু আসল কথা এটাই, এবং নাটকীয় ভাবে বললেন ‘জঙ্গলে উইদাউট মাই পারমিশন, টুনিবাল্ব লাগিয়ে আলো জ্বালাচ্ছে কে?’
ফলে তিনি জঙ্গলে ঢুকেই হুঙ্কার দিলেন ‘না না,এসব আমি একেবারেই বরদাস্ত করব না।এতদিন ধরে আমার রাজ্যে আমার জঙ্গলে টুনিবাল্ব জ্বলছে,আলো জ্বলছে, অথচ আমিই জানি না! আমি পরিষ্কারভাবে বলছি, যেহেতু আমার অজান্তেই এটা হয়েছে, সুতরাং আমি এর দায়িত্ব কিছুতেই নেব না, তাতে যা হওয়ার হবে … মনে হচ্ছে একটি ষড়যন্ত্র, গভীর চক্রান্ত, আমাদের দপ্তর তথা দল তথা সরকারকে হেয় করার একটা সাজিস চলছে…। তাই এখানে উপস্থিত প্রত্যেকের কাছ থেকে আমি এখন কৈফিয়ৎ চাইছি … আমি কাউকে ছাড়বোনা … এক এক করে বলুন …।’
এতক্ষণ সবাই চুপ্চাপই ছিলো, ঝুমসাহেব ক্ষিপ্ত হতেই একে একে সবাই মুখ খুলতে শুরু করলেন … তাদের বক্তব্য পরপর’ সাজালে এরকমঃ
সৌ’বাবুঃ আমি স্যার আগে অন্য ডিপার্টমেন্টে ছিলাম, এখানে অল্প কিছুদিন আগে ডেপুটেশনে এসেছি। তবে এখানে এসেই বুঝেছি, সামথিং ইজ রটন্ ইন দ্য ডেনমার্ক, কোথার থেকে যেন পচা গন্ধ বেরোচ্ছে! পরিষ্কার বলছি, কিছুদিন এখানে থেকেই বুঝতে পারছি, এখানে নানা রকম ঘুঘু আছে, নানারকম ঘুঘুর নানারকম বাসা আছে … ন্যাচারেলি, এই বাসা ভাঙা’র কাজ আমার একার দ্বারা সম্ভবই নয়।তাই কাজ করি, দেখি-শুনি আর চুপ্চাপ থাকি …।
অ’বাবুঃ খুবই গুরুতর পরিস্থিতি, একথা বলা বাহুল্য, স্যার, এটা ইলেক্ট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের লোকেরাই এর সঠিক জবাব দিতে পারবে। আমি তো স্যার পার্চেজের লোক, এই ব্যাপারে কেউ আমাকে এখনও ইনফর্ম করে নি, অর্ডার করে নি, সাপ্লাই দিতেও বলে নি! হাও স্ট্রেঞ্জ … এতে তো আল্টিমেটলি প্রশাসনেরই ক্ষতি হবে … টুনিবাল্বগুলো নিশ্চয় বিদেশী, এবং চাইনিজই হবে … তবে কি এর সাথে একটা গ্লোবাল চক্রান্ত জড়িত আছে? বা নাকি কোনও আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা জড়িয়ে আছে?
ত’বাবুঃ এস্টিমেট্, স্যার, এস্টিমেট … এত বড় জঙ্গলে টুনিবাল্ব লাগানোর কাজ হচ্ছে, হয়েছে, এবং কোনও এস্টিমেট ছাড়াই পারফর্ম হয়ে যাচ্ছে, তাহলে, স্যার আমার এই ‘এস্টিমেটর’ পোস্টটাই তুলে দিতে হয়! বাড়িতে একটা লক্ষ্মীপুজো করলেও তো এস্টিমেট করতে হয়। মনে হচ্ছে এর ভেতরে কোনও ঘাপ্লা আছে, আপনি স্যার জোরদার তদন্ত করুন! সবাইকে ইনভল্ভ্ করুন।দরকার পড়লে আপনার তদন্ত-অভিযানে আমিও সামিল হবো …।
ঝুমসাহেব এই তিনজনের জবাব শুনে বললেন, ‘দাঁড়ান,দাঁড়ান,আপনারা তো সব নিজেদেরই সাফাই গাচ্ছেন, কামের কাম কিছুই বলছেননা, না না ,এটা চলবেনা। তবে একটা কথা আপনাদের জানিয়ে রাখি, প্রেস আর মিডিয়ার লোকদেরও বলছি, কোথাও ভুল হতে পারে, আর ভুল করাটা তো মানুষেরই অধিকার, সেই হিসেবেই ঘটনাটা মেনে নিতে হবে, নেক্সট!’
শু’বাবুঃ হ্যাঁ স্যার, বাংলার বর্তমান ‘পার্থসামাজিক’ পটভূমিকায়, স্যরি স্যার, স্লীপ অফ টাং, আমি বলতে চাইছি, বর্তমান রাজ্যের আর্থসামাজিক পটভূমিকায়, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে, হিমালয় থেকে কোনও মুনিঋষিরা এসে এই মধুবালা জঙ্গলে টুনিবাল্ব লাগায় নি। আমি স্যার এই মিনিস্ট্রিতে অনেকদিন হলো আছি এবং থাকাকালীন যে-টুকু পড়াশোনা করেছি বা করতে পেরেছি ,তা’তে এটা বলতে পারি ‘যদিও মহাভারত’য়ে খান্ডবদাহনের মতো চূড়ান্ত অগ্নিকান্ডের ঘটনার যথেষ্ট উল্লেখ আছে, যেটা আপনারা সকলেই জানেন, কিন্তু গভীর জঙ্গলে ঢুকে পান্ডব-কৌরব-বংশের কেউ গাছে উঠে টুনিবাল্ব লাগিয়েছে এবং অতঃপর জ্বালিয়েছে, এরকম কেস কিন্তু একটাও পাই নি। শুনেছি, আপনিও তো স্যার যথেষ্ট লেখালিখি, পড়াশোনা করেছেন, তো সেই হিসেবে বলা যায়, আপনি কি স্যার পুরাণ কিম্বা কথাসরিৎসাগরের কোথাও টুনিবাল্ব লাগানোর কোনও কেস পেয়েছেন?
শু’বাবুর কথা শুনতে শুনতে ঝুমসাহেবের চোখ বুজে আসছিল, মানে ঘুম পাচ্ছিলো আর কি। তাই কথা থামিয়ে দিয়ে শু’বাবুকে বললেন ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, খুবই ইন্টারেস্টিং, খুবই ইন্টারেস্টিং, খুবই হেলদি, জ্ঞান-দায়ক আলোচনা, তবে শু’বাবু,আপনার সাথে এই ব্যাপারে আমি পরে কথা বলবো, নেক্সট কে আছেন …।
স’বাবুঃ সবই মায়া, বুঝলেন স্যার, সবই মায়া! এই যে আমরা এতক্ষণ ধরে জঙ্গলের ভেতরে টুনিবাল্ব লাগানো নিয়ে এত হুজ্জোতি করছি, অপরাধ নেবেন না স্যার, এগুলো তো টুনিবাল্ব নাও হতে পারে। খুব কাছে গেলে দ্যাখা যাবে, এগুলো আসলে হয়তো ‘হাইব্রিড’ জোনাকি, সীজনের বিশেষ সময়ে এসে, বিশেষ আবহাওয়ায়, এত ভাইব্রান্ট রূপ ধারণ করে, যাদের অন্ধকারে টুনিবাল্ব বলেই ভ্রম হতেই পারে! খুব বোরিং লাগতে পারে, তবুও বলছি, বিজ্ঞানের কথা, স্যার্ যেমন আগে থেকে কিচ্ছু বলা যায় না, প্রাণীজগতের কথা যেমন আগে থেকে কিছু বলা যায় না, যেমন ক্রিকেটের কথা আগে থেকে কিছু বলা যায় না, যেমন গভর্নমেন্টের কথাও যেমন আগে থেকে কিচ্ছু বলা যায় না! তেমনই টুনি বাল্ব্’য়ের আলোর কথাও আগে থেকে কিছুই বলা যায় না … ।
স’বাবু আরও হয়তো বাড়তি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ঝুমসাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘থামুন মশাই, থামুন, আপনি এখানে আমাকে ‘হাইব্রীড জোনাকি’ দ্যাখাচ্ছেন, ‘মায়াবাদ’ শোনাচ্ছেন, আমি কিন্তু গাড়ল নই, গান্ডুও নই, এত দূর থেকেও আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, গাছে গাছে, ডালে ডালে ইলেক্ট্রিকের তার ঝুলছে, ইলেক্ট্রিকের তার এক গাছ পেরিয়ে আরেক গাছের দিকে চলে যাচ্ছে, সেটা স্বচক্ষে দেখে আমি অস্বীকার করবো কী করে? আচ্ছা আপনিই বলুন, জোনাকির পেছনে কি ইলেক্ট্রিকের তার ঢোকাতে হয়? এরকম কথা তো কোনওদিন শুনিনি … না না, এসব আজগুবি কথা আপনার আড্ডায় গিয়ে বলবেন, আচ্ছা, স্যরি, এরপর কে বলবে, নেক্সট?
র’বাবুঃ হ্যাঁ, আমিই নেক্সট, আমি স্যার এই ডিপার্ট্মেন্টে একেবারেই নতুন, সদ্য জয়েন করেছি, এখনও পার্মানেন্ট হই নি, কবে যে পার্মানেন্ট স্টাফ হবো জানি না। সুতরাং, এই ব্যাপারে আমি আর নতুন করে কী বলবো, সীনিয়ররা যা বলেন, সেটাই একমনে শুনে যাচ্ছি … তবে ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে, যদি আমার সামান্য অভিজ্ঞতা থেকে আমি যদি বলি, অনেক দিন আগেই স্যার, এই কেসটা আপনার টেক-আপ করার দরকার ছিল। ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে, মনে হয়, পুরো কেসটাই ঝোলাগুড় হয়ে গেছে। আর যে-টুকু বুঝেছি, এই রহস্য সমাধানে, এখন স্যার আপনাকে অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে … তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন, এই ব্যাপারে আমি আপনার সাথে আছি…।
র’বাবুর কথা শেষ না হতেই ঝুমসাহেব লক্ষ্য করলেন সমবেত এই ভিড়ের পেছনে একজন সাদামাটা লোক ভাবলেশহী্ন মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।ঝুমসাহেব তাকে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন ‘এই লোকটা কে? হু ইজ দিস গাঈ? না না, আমি এখানে বাইরেরে কোনও লোককে সরকারী মীটিঙে এলাও করবোনা, আপনি জানেন না, বিনা কারণে বিনা অনুমতিতে জঙ্গলে ঢোকা আইনত নিষিদ্ধ, দন্ডনীয় অপরাধ, আর এভাবেই আপনারা আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন, আর এটাও কি জানেন না যে, আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ …।’
ঠিক সেই সময় ঝুমসাহেবের কানে ফিস্ফিস্ করে কেউ বললেন, ‘স্যার, ইনি হচ্ছেন আমাদের একমাত্র বোনাফাইড ঠিকাদার!’
‘ঠিকাদার’ শব্দটা শুনেই ঝুমসাহেবের মুখের রঙ মূহুর্তে পাল্টে গেল। তিনি তড়িঘড়ি গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘ওহ্ আই মীন ‘কন্ট্রাক্টর’! সেটা আগে বলবেন তো, জানেনই তো আমার ভীষণ চাপ, হাতে অনেক ‘পোর্টফোলিও’, আমি আর ক’টা দিক সামলাবো, কিছু মনে করবেন না, যান, আমার চেম্বারে গিয়ে অপেক্ষা করুন, একটু পরেই আপনার সঙ্গে মিট করছি।’
২
চেম্বার না দেওয়ানি খাস? কোথায় জঙ্গল আর কোথায় টুনিবালব্! সিকিউরিটির পর সিকিউরিটি পেরিয়ে ওই ‘ঠিকাদার’, মানে ‘কন্ট্রাক্টর’, মানে ধরুন, দ’বাবু ভিজিটর্স রুমে ঢুকতেই কেউ একজন, মানে বুকে সরকারী ব্যাজ-লাগানো একজন পরিপাটি তরুণী, একটা ফুলের বোকে তার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘ওয়েলকাম, স্যার এক্ষুনি আসছেন।’
পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই চেম্বারে ডাক পড়লো। ঝুমসাহেব চেম্বারে আগে থেকেই ছিলেন। তিনি কথা বলার আগেই দ’বাবু বললেন, ‘আপনি তো মশাই কামাল করে দিলেন। স্বীকার করতেই হয়, আপনি একজন গ্রেট আক্টর! যে-ভাবে ওদের সাথে বিহেভ করছিলেন, আমি তো তাজ্জব বনে গেলাম।এমন ভাব দ্যাখালেন, যেন কিছুই জানেন না, আমাকেও চেনেন না, ভাজা মাছ উলটে খেতে কোনওদিন শেখেননি ... ।ওরা অবশ্য জানে না, এই গোটা ব্লু-প্রিন্টটা যে আপনারই করা... আমি ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার অ্যাক্টিভিটি শুধু লক্ষ্য করে যাচ্ছিলাম। মার্ভেলাস! আমি সেজন্যে কোনও কথা বলার চেষ্টা করি নি।
ঠিক এখানেই ঝুমসাহেব দ’বাবুর কথা থামিয়ে বলবেন, ‘না না,এত প্রশংসা করবেন না, এটা তো আমার রেগুলার কাজ। জানেনই তো, দপ্তর টিকিয়ে রাখতে গেলে অনেকরকম অভিনয় করতেই হয়। এটাও তেমনি। এতে সাপও মরে অথচ লাঠিও ভাঙে না। আমি সবই জানি। জঙ্গলে টুনিবালব্ জ্বললে যে জঙ্গল তথা দপ্তরের মুখ উজ্জল হয়, আর ডিপার্টমেন্টের মুখ উজ্জ্বল হলে যে হেড-অফিসের মুখ উজ্জ্বল হয় সেটা আমি ভালোমতই জানি। এ বিষয়ে কোনও সরকারী ঘোষণা হয়নি ঠিকই, মনে করুন এটা একটা এক্সপেরিন্টাল টেস্ট-কেস, পাবলিক রিয়াকশন কী হয় দ্যাখা হচ্ছে, কিন্তু পাবলিক এত হারামি আর খচ্চর, স্যরি ফর মাই ল্যাঙ্গোয়েজ, গোটাটা না-শুনে, না-বুঝে কট্টর সমালোচনা শুরু করে দিয়েছে। আর এটাও জানি, মিডিয়াও চিরকাল যা করে থাকে, তেমনি তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে, কিম্বা উল্টোভাবে জনগণও মিডিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে দিন গুজরান করবে এবং এই সবগুলোই আমাদের ট্যাক্ল করতে হবে।তেমন দরকার হলে সব বুদ্ধিজীবী ,সো-কলড্ বিদ্দজ্জন ইন্টেলেকচুয়াল-সহ সবাইকে একত্রিত করতে হবে। এই ব্যাপারে অবশ্য আমাদের নেট-ওয়ার্ক খুব গোপনে কাজ করে চলেছে।’
টেবিলের ওপরে জল–ভরা একটি গেলাস ছিল। ঝুমসাহেব একটু থেমে,গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে, আবার শুরু করলেন, ‘ব্যাটারা তো জানেইনা কোত্থেকে টাকা আসে, কে অর্ডার দেয়, কে বিল পাশ করে, কয়েক হাত ঘুরে ঘুরে টাকা আল্টিমেট কোথায় যায়, এরা কেউ জানেই না।ওদের শুধু বাকতাল্লা। আচ্ছা, তুমি” ঠিক মতো পেমেন্ট পাচ্ছ তো?’
আশ্চর্য, ঝুমসাহেব এক লাফে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এলেন। দ’বাবুর মুখ খানিকটা লাল হয়ে উঠলো। লজ্জা পেয়েছেন, বলা বাহুল। কিন্তু দ’বাবু খুবই বুদ্ধিমান। তিনি বুঝলেন, এই ঝুমসাহেব তার সাথে সম্পর্কটা সহজ করতে চাইছেন। কিম্বা আমার লয়ালিটি বাজিয়ে নিতে চাইছেন। অবশ্য,তা’তে তো কোনও অসুবিধা নেই বরং, সুবিধাই বেশি। তাই দ’বাবু আবেগ চেপে রেখে বললেন, ‘হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার, সব ঠিক মতোই হচ্ছে, সব ঠিক মতোই পাচ্ছি, আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। আর এটা তো আপনাদের সাথে দীর্ঘ দিনের গভীর যোগাযোগের’ই ফল। প্র্যাক্টিক্যালি,আমাকেও এখন এই প্রজেক্টের একজন পার্টনার বলা যায়! তবে টের পাচ্ছি বিরোধী লবি’র কয়েকজন টার্গেট করেছে আমাকে। তবে আমিও স্যার এসবে কোনও ভয় পাই না। আরে, আপনারা থাকতে আমার আর চিন্তা কিসের! দু’য়ে দু’য়ে চার করব গরু পাচার … এটা জাস্ট একটা কথার কথা …।’ এটুকু বলে নিজের রসিকতায় হা হা করে হাসতে লাগলেন।
ঝুমসাহেব মনে হয় একটু খুশিই হলেন। অন্তত মুখ দেখে তো সেটাই মনে হোলো। আরেকটা জিনিস তিনি বুঝলেন, দ’বাবু সত্যিই খুব ঘোড়েল লোক! তিনি এবার গলার স্বরটা একটু নামিয়ে, ঘরের চারদিকে একবার তাকিয়ে, প্রায়-ফিস্ফিস্ করে বললেন, ‘শোনো ভাই, একটা জব্বর খবর আছে। খুব গোপন। বাইরে প্রকাশ করা যাবেনা। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে, আমরা শুধু জঙ্গল নয়, এবার গোটা রাজ্যটিকেই টুনিবালব্ দিয়ে সাজাব। টুনিবালব্'য়ের একটা বেশ ছা-রা-রা-রা-রা ভাব আসবে।সন্ধে নামলেই পাহাড় থেকে সাগর, গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র রঙ-বেরঙের টুনি বালব্ জ্বলবে। কেমন ইউনিক হবে ব্যাপারটা বলো! এর মধ্যেই সরকারী ঘোষণা হয়ে যাবে। আর সব ঠিকঠাক থাকলে গোটা কাজটা তো তুমিই পাবে, একথা তোমাকে বলতে পারি! আগাম জানিয়ে দিলাম, এখন থেকেই তুমি প্রস্তুতি নাও।
এই কথাবার্তা শেষ হতেই, তিনি প্রসঙ্গ পালটে দ’বাবুকে বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি কি আমাদের রিজার্ভ ফরেস্টের বিখ্যাত ‘আলাভ্যু’ মানে ‘আই লাভ ইউ’ মধু কোনওদিন খেয়েছ? নিশ্চয় খাওনি, দাঁড়াও অর্ডার দিচ্ছি, এখনই চলে আসবে। ভালো সংবাদ দিলাম, একটু মিষ্টিমুখ করে যাও।’ বলেই কলিং-বেল’য়ে হাত দিলেন। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার, এর মধ্যেই একজন আর্দালি-টাইপের লোক ঘরে ঢু্কে গেল। ঝুমসাহেব বললেন, ‘শোনো, এই যে ঠিকাদার-সাহেব বসে আছেন, এই সাহেবের খাওয়ার জন্যে বা টেস্ট করার জন্য এক্ষুনি আমাদের জঙ্গলের একটু মধু’র স্পেসিমেন আর আলাদা করে একটা মধু’র শিশি গিফট্-প্যাকে ভরে এখানে নিয়ে এসো। কুইক কুইক!’
দ’বাবু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘না, না, টেস্ট করতে পারি কিন্তু স্যার গিফট্ প্যাক লাগবে না, তার কোনও দরকার নেই।’ ঝুমসাহেব উত্তরে বললেন, ‘সেটা তুমি বলতেই পারো। কিন্তু মনে রেখো, এই যে কথাটা বললাম, এটা গভর্নমেন্টের ডিসিসন হিসেবেই ধরতে হবে। অ্যান্ড দিস ইজ পলিটিকাল ডিসিসন। রিফিউজ করলে কিন্তু গভর্নমেন্টকেই অপমান করা হবে!’
দ’বাবু চুপ করে গেলেন। কেননা ‘পলিটিকাল’ শব্দটির যথেষ্ট ওজনদার। গুরুত্ব আছে। কোথা থেকে কখন কী হয়, কে জানে। সুতরাং চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়।
লোকটি অর্ডার নিয়ে চলে গেল। সে চলে যাওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই আরেকজন ঝুমসাহেবের পি-এ ঢুকে গেলেন চেম্বারে। এবং সে ঢুকেই সরাসরি ঝুমসাহেবের হাতে একটা চিরকুট তুলে দিলেন। নিশ্চয় ওই চিরকুটে কোনও জরুরী কিছু ,হয়তো নির্দেশ লেখা আছে। পি-এ বেরিয়ে যেতেই ঝুমসাহেব চিরকুটটি পড়তে শুরু করলেন। এবং সেটা পড়তে পড়তেই তার চোখ-মুখ ক্রমশ লাল হয়ে উঠলো। লাল থেকে বেগুনী। মুখটা অসম্ভব থমথমে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর আচম্কা টেবিলে একটা জোরালো ঘুষি মেরে বললেন ‘রাস্কেলদের এত বড় আস্পর্ধা, সুবিধা পেতে পেতে অনেক বাড় বেড়ে গেছে। যত পায় তত চায়। নাঃ, আজ একটা হেস্ত-নেস্ত করতেই হবে … ভাই, তুমি একটু বোসো, অনেক জরুরী কথা বলা বাকি রয়ে গেল। আমি এক্ষুনি ফিরে আসছি।’
কে ‘রাস্কেল’, কেন ‘আস্পর্ধা’, কিসের ‘সুবিধা’ কোথায় ‘হেস্ত-নেস্ত’ … এসবের অবশ্য কিছুই বোঝা গেল না। ঝুমসাহেব হন্তদন্ত হয়ে চেম্বারের বাইরে চলে গেলেন।
৩
মধু’র নাম ‘আলাভ্যু’ বা ‘আই লাভ ইউ’। দ’বাবু এই প্রথম এরকম নাম শুনলেন। মধু খাওয়া হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। একটা প্লেটে দু’তিন চামচের মতো দিয়েছিল। ভালোই স্বাদ। তবে কোন ফুলের মধু সেটা অবশ্য বোঝা গেল না। কেমন যেন একটা হার্বাল টাচ আছে। দ’বাবুর মনে পড়ল, ছোটবেলায় পথের ধারে ছোট ছোট মধুফুল গাছগুলির কথা। সেখান থেকে ফুল ছিঁড়ে নিয়ে মুখে চুষ লেই একটা মিষ্টি আস্বাদ। ওটাই কি প্রথম মধু খাওয়া? সন্দেহ আছে। আরেকটা কথা মনে পড়লো, সেটা অনেকদিন আগে কারও মুখ থেকে শোনা Honey is Money না Money is Honey… সেটা অবশ্য মনে নেই।
টেবিলে ওপরে গিফট্-প্যাকে রাখা শিশি’টা আছে। ঝুমসাহেব ঘরে ঢুকলেই শিশিটা নিয়ে দ’বাবু বেরিয়ে যাবেন। এদিকে সাহেবের তো কোনও পাত্তাই নেই। চেম্বারে কেউ ঢুকছে না। ঢুকলে না হয় কাউকে জিজ্ঞেস করা যেতো। চারিদিক চুপ্চাপ। মনে হচ্ছে যেন বিল্ডিঙে কেউ নেই। দ’বাবুর বুকটা হঠাৎ কোনও অনির্দিষ্ট কারণে ছ্যাঁৎ করে উঠল। সামনে কোনও অজানা বিপদ? দ’বাবু মনে মনে পূর্ব-অভিজ্ঞতা নিয়ে অচেনা অজানা বিপদ-মোকাবিলার ছক্ কষতে শুরু করলেন। কিছু হোক বা না-হোক সাবধানের তো মার নেই!
আরও একটু সময় পেরোতেই, সে ভাবলো ‘নাঃ আর অপেক্ষা করে লাভ হবে না।এবার বাইরে বেরোতেই হবে।’ দ’বাবু শিশিটা হাতে নিয়ে বাইরে এলেন। করিডোর ফাঁকা।পাশের অফিস-ঘরগুলোর দিকে একবার তাকালেন। সেখানেও কেউ নেই। হলোটা কী? এবং সেই মুহূর্তে নিশ্চিত হলেন, বিপদ একটা আসছেই। আজকাল দ’বাবুর মতো লোকজনের ভেতরে একটা বোধ সবসময় কাজ করে, কোথাও আগাম জানান না পেয়ে ফেঁসে যাবার ভয়। ঘটনার সাথে সরাসরি বা প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষভাবে সম্পর্ক থাক বা না থাক। অনেক কিছু আছে তার আওতার বাইরে, কিন্তু ঘটনাক্রমে জুড়ে যেতে বেশি সময় লাগে না।
ঠিক এই সময় তিনি একটা গুঞ্জন শুনতে পেলেন। তিনি করিডোর পেরিয়ে যত এগোচ্ছেন তত গুঞ্জন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তেতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তিনি এবার চিৎকার শুনতে পেলেন। তবে এই চিৎকার কারও একার নয়, একেবারে সমবেত।তড়িঘড়ি নিচে নেমে এসে বুঝতে পারলেন, চিৎকারগুলি নিছক আওয়াজ নয়, আসলে স্লোগান। আর এই ধরণের স্লোগান শোনার অভিজ্ঞতা তার আজকের নয়। সে কোনওদিন স্লোগান দেয়নি বা কোনও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে নি, একথা ঠিক। কিন্তু শোনার অভিজ্ঞতা তো আছে যথেষ্ট। আর সত্যি কথা বলতে কি সে ছোটবেলা থেকে কাজের পেছনে এত ছুটতে হয়েছে, যে এই সব দলবাজি স্লোগানবাজি করার সময়ই হয় নি। এবং সবসময় এসব তার কাছে বোগাস মনে হয়। আরে ভাই, এসব করে কিচ্ছু হবে না।
বারান্দার কাছাকাছি এসে বুঝলো, আর সাত-দশটা পলিটিকাল স্লোগান যেমন হয়, এটা প্রায় তেমনই। গেটের সামনে বেশ কিছু মানুষ,পুরুষ-মহিলা,বৃদ্ধ থেকে শিশু পর্যন্ত। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তাদের স্লোগান চলছে। যদিও তাদের হাতে কোনও পতাকা নেই। দ’বাবু এবার স্পষ্টভাবে দেখলেন ওই স্লোগান-দেয়া মানুষদের মুখোমুখি আমাদের ঝুমসাহেব তার সৈন্য-সামন্ত-সমেত অর্থাৎ দপ্তরের কর্মচারীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কখনও কখনও হাত নাড়িয়ে তাদের কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছেন। আর তিনি যতই বোঝাবার চেষ্টা করছেন ততই স্লোগানের আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছে।
দ’বাবু এবার একটু নিরাপদ দূরত্বে থেকে স্লোগানগুলো ভালো করে শোনার চেষ্টা করলেন।তিনি যা বুঝতে পারলেন সেটা এরকমঃ
জঙ্গলের ভেতরে টুনিবালব্ জ্বালানো চলবেনা চলবেনা
জঙ্গলের পশু-পাখিদের ডিস্টার্ব করা চলবেনা চলবেনা
টুনিবালব্-কান্ডে দোষীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে করতে হবে
আমাদের জঙ্গল যে-কথা কয়
টুনিবালব্‘য়ের আলো কক্ষণো নয়
ইত্যাদি ইত্যাদি। আর ঝুমসাহেব যা ওদের বোঝাবার চেষ্টা করছেন, সেটা প্রায় এরকমঃ
‘ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি কোনও অন্যায় করে থাকেন, তবে তার দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। এর সঙ্গে ডিপার্টমেন্টের কোনও যোগ নেই। আপনাদের জানিয়ে রাখছি, খবর পাওয়া মাত্র আমরা উচ্চ-পর্যায়ের তদন্ত শুরু করেছি। মধুবালা রিজার্ভ ফরেস্ট টুনি-বাল্ব্ জ্বালানোর জন্যে যারা দোষী, দোষ প্রমাণিত হলে তারা উপযুক্ত শাস্তি পাবে। আমাদের একটাই কথা ‘আইন আইনের পথে চলবে’। আপনারা অনুগ্রহ করে গেটে অবরোধ করবেন না। আপনারা অন্যদের নির্বিঘ্নে কাজ করতে দিন। এবং এর পরেও যদি আপনারা বিক্ষোভব অবরোধ চালিয়ে যেতে থাকেন, তবে প্রশাসন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
ঝুম সাহেবের বক্তব্যের দু’টো বক্তব্য শুনে দ’বাবুর বুক অনেকটা ধব্ধব্ করে উঠলো। ব্যাটা বলে কি! ‘মধুবালা রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতরে টুনি-বাল্ব্ জ্বালানোর জন্যে যারা দোষী, দোষ প্রমাণিত হলে তারা উপযুক্ত শাস্তি পাবে।’ এর মানে কী? দ’বাবু বুঝতে পারলেন সাধু সাজার জন্যে ঝুমসাহেব তাকে যখন-তখন ফাঁসিয়ে দিতে পারে! হয় তো এটাই তার গোপন পরিকল্পনা। দ’বাবুর ভেতর থেকে পরপর কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এলো ‘শালা। চুতিয়া। হারামী!’
কিন্তু এখন মাথা গরম করা চলবে না । স্লোগানগুলো কতটা পলিটিকাল, দ’বাবু জানে না। আর সে পলিটিক্স নিয়ে মাথা ঘামাতেও চায় না। সে শুধু চোখের সামনে দেখতে পেলো স্লোগান যত বাড়ছে বিক্ষোভে তত লোক এসে জড়ো হচ্ছে। গেটের কাছে লোক আর লোক। দ’বাবু যেন দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন, ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে, এদিকে পুলিশ-ভ্যান গেটের বাইরে, ধরপাকড় শুরু হয়েছে, লাঠিচার্জ চলছে, এরপর ‘জল-কামান; কাঁদানে-গ্যাস, তারপর নিশ্চিত গুলি … তিনি যেন চোখের সামনে দু-একটা গুলিবিদ্ধ লাশও দেখতে পেলেন … ।
দ’বাবুর পাশে সিকিউরিটির একজন লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে ভালোমুখ করে জিজ্ঞেশ করলেন ‘কেয়া হালচাল? আচ্ছা, এরা কা’রা? এটা কোন্ পার্টি?’ সিকিউরিটি দ’বাবুর কোনও কথার জবাব দিলেন না। বরং ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে তাকে চুপচাপ থাকার কথা বললেন। ঝুমসাহেব এখনও দ’বাবুকে দ্যাখেননি। চোখাচোখি হলে তিনি হয় তো, বলা যা না, দ’বাবুর দিকে আঙুল তুলে বলতেই পারেন ‘এই তো, এই সেই কালপ্রিট। অ্যারেস্ট হিম। ওর কাছ থেকে মধু’র শিশিটাও কেড়ে নাও।’
আশঙ্কার শেষ নেই। এখন যা-খুশি তাই হতে পারে। না এখান থেকে যেভাবেই হোক, কেটে পড়তেই হবে। তাই এবার মরিয়া হয়ে সিকিউরিটিকে জিগ্যেস করলেন, ‘আচ্ছা, পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাবার রাস্তাটা কোথায়? আমার খুব জরুরী দরকার।” সিকিউরিটি এবারও কথা না বলে আঙুল তুলে একটা দিক-নির্দেশ করলেন।
‘আরও গন্ডগোল হতে পারে। আমিও ফেঁসে যেতে পারি। সুতরাং চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ … দ’বাবু আর দেরি না করে সিকিউরিটির দ্যাখানো পথ দিয়ে যেতে যেতে বুঝলেন,এ টা আসলে টয়লেটে যাবার পথ। টয়লেটের পাশেই সেফটি-ট্যাঙ্ক, সেটা পেরোলে নোঙরা-জঞ্জালের ঢিবি। পচা-দুর্গন্ধময় ওই ঢিবিটা পেরোতেই দ্যাখা গেল একটা ছোট্ট মরচে-পড়া আদ্যিকালের লোহার গেট। সম্ভবত এখান দিয়েই সুইপাররা যাতায়াত করে।
গেটটা কিন্তু তালা-বন্ধ ছিল। তবে সেটা টপ্কে যাওয়া যেতেই পারে। দ’বাবু, মধুর শিশিটা ভালো করে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে, কোনও রকমে গেটের ওপরে উঠে একটা লাফ দিলেন। এবং কী সৌভাগ্য ধপাস্ করে জঙ্গলের ঘাসের ওপরে গিয়ে পড়লেন। না, শরীর অক্ষতই আছে। এবং মধু’র শিশিটাও ঠিকঠাক আছে। তিনি এবার হাঁটতে শুরু করলেন। এবার আর চিন্তা নেই। ঝুমসাহেবের মোকাবিলা পরে করা যাবে …।
ছোট রাস্তায় এসে দ’বাবু দেখতে পেলেন প্রচুর মানুষের মিছিল স্লোগান দিতে দিতে ঝুমসাহেবের দপ্তরের দিকে যাচ্ছে। আজ একটা কিছু হবেই। কেউ যাতে দ’বাবুকে চিনতে না পারে, তাই মুখটা হাত দিয়ে আড়াল করে ,মিছিলে ভিড় বাঁচিয়ে, বড় রাস্তার পথ ধরলেন।
ওদিকে গেটের সামনের বিক্ষোভ-কারীদের চিৎকার তখন বিল্ডিং ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় পৌঁছে গেছে।
Comments
Post a Comment