সম্পূর্ণ উপন্যাসঃ জানালাঃ রানা সরকার
সম্পূর্ণ উপন্যাস
জানালা
রানা সরকার
১
জা না লা
‘শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য অবশ্যই ব্যাক্তিগত বিকাশ। কিন্তু শুধু ব্যাক্তিগত বিষয়ের ওপর জোর দিলে মানুষ স্বার্থপর হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে পারে, এতে সমাজ এবং সংস্কৃতি এছাড়াও অক্ষর পরিচয়হীন মানুষেরা পিছিয়ে পড়তে পারে। শেষে এটাই বলতে চাই যে, শিক্ষায় ব্যক্তি মনের অর্থাৎ চেতনার সুস্থ ও সুসংহত বিকাশই মুল লক্ষ্য…’
শিক্ষার লক্ষ্য কী? এই বিষয়ে প্রফেসর ক্লাস নিচ্ছে। কিন্তু অভ্যাসবশত বা বলা চলে উদাসীন মনোভাবের জন্যেই রাজদীপের মন প্রতিদিনের ন্যায় আজকেও ক্লাসে নেই।
পশ্চিম জানালার দিকে তাকিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় রাজদীপ। সারি সারি চা-পাতা বাগান। চা-গাছের টিয়া-রঙের শিসের পাশে দুটি সদ্য শিশু পাতা বিশ্বের সমস্ত মাধুর্য নিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়ায় দুলছে। আর এই মাধুর্যের ষোলআনা ভোগ করছে ঘাস ফড়িং। একবার এদিক আরেকবার ওদিক ছুটছে দলছুট হরিণের মতো। পাশের মাঠে সাদা বকেরা নেমে এসেছে শেষবেলায় অন্তিম দানার খোঁজে। গরুগুলো বাড়ি ফেরার জন্য তীব্র অপেক্ষা করছে আর দড়ি ছিঁড়ে বাড়ি যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। মাঠের ধারে সারি সারি সুপুরি গাছগুলো থেকে সুপুরি পাতা শিল্পীর ন্যায় ঠোঁট দিয়ে চিরে চিরে নিয়ে যাচ্ছে বাবুই। আর সূর্য ধীরে ধীরে গোধূলি বেলার দিকে ঢলে পড়ছে। হলুদ আলো টিয়া-রঙের শিষে এসে যেন নক্ষত্র হয়ে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত দৃশ্য, কি অনুপম দৃশ্য, মনোরম দৃশ্যে রাজদীপ বারবার হারিয়ে যায় এই গোধূলি বেলাতে এসে, এই পৃথিবীর কাছে।
হঠাৎ বন্ধু কৌশিক তাকে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলো, ‘কিরে কী দেখিস জানালা দিয়ে? সেইতো চা-পাতা তোলানিরা পাতা তুলে বাড়ি ফিরছে। সবসময়ে ওভাবে কী দেখিস বলতো? নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে?’
প্রোফেসার বলে উঠলেন, ‘কী হল, তোমরা চিৎকার করছ কেন? আজকে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। কাল এসো কিন্তু সবাই কাল প্রোজেক্ট সম্পর্কে তোমাদেরকে বলবো। এখন যাও বিকেল পেরিয়ে যাচ্ছে।’
রাজদীপ আর কৌশিক গল্প করতে করতে বেরিয়ে আসে রাস্তার দিকে। তখনই জিনিয়া তার বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে রাজদীপের সামনে দাঁড়ায়।
‘কিরে, তোর কী হয়েছে রে আজকাল? ক্লাসে আসিস চুপচাপ থাকিস, বেশি কথা বলিস না; আগে তো সারাক্ষণ নানা বাহানা খুঁজতিস কথা বলার জন্য। কী অত জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকিস রে? আজকে ক্লাসে স্যার কী বলল কিছু মাথায় ঢুকেছে? এইভাবেই তো দুটো ইয়ার কাটিয়ে দিলি। আর ফাইনাল ইয়ারে এসেও কোনও পরিবর্তন নেই।’
‘ধুর, চুপ কর, তখন থেকে বকবক করে যাচ্ছে। ভাল্লাগেনা। তুই কী বলছিলি? আজকে প্রোজেক্ট দিবে। কোথায় দিলো? আবার কাল আসতে হবে।’
কৌশিক বলে ওঠে, ‘রাজ তুই কিন্তু বেশি কথা বলিস না, এবছর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করবি কিনা তাই বল। জিনি তো কিছু ভুল বলেনি!’
জিনিয়াকে তারা আদর করে জিনি বলে ডাকে।
‘তুইও শুরু করলি। একটা সিগারেট দে তো।’
সিগারেট ধরিয়ে কৌশিক রাজদীপের হাতে দিলো। সিগারেটের ধোঁয়া রিং করে ছাড়তে থাকে। এরপর মৌন মিছিল শুরু হল তিনজনের। আজ অনেকটা দেরি হয়ে গেলেও প্রতিদিন তারা যেভাবে হেঁটে বাস ধরতে আসে ঠিক সেভাবেই আজকেও হাঁটতে শুরু করলো। মনের মধ্যে অনেক কথা ঘুরপাক করে যাচ্ছে তবে একটাও টুঁ শব্দ বের হচ্ছে না কারোর মুখ থেকেই। দেখতে দেখতে ব্যাপ্টিস্ট চার্চ পেরিয়ে গেলো। সিগারেট প্রায় শেষ, শিবমন্দির পেরিয়ে কদম বাগান মাঠের কাছাকাছি এসে আরেকটা সিগারেট ধরালো। এরপর নক্সালবাড়ি মার্কেট কমপ্লেক্স মোড়ে এসে বাস ধরে। নক্সালবাড়ি কলেজে তারা তিনজন এডুকেশন অনার্স পড়ে। এরপর বাস হাতিঘিষা, অটল, দেওমনি পেরিয়ে আপার বাগডোগরায় নেমে পড়ে জিনিয়া। রাজদীপ জানালার ধারে বসে চা-পাতা বাগান দেখতে দেখতে নক্সালবাড়ির গোধূলি বেলা দেখতে দেখতে কী সব যেন ভাবতে থাকে। কৌশিকের ধাক্কাতে গোঁসাইপুর চলে এসেছে তা বুঝতে বিন্দুমাত্র দেরি হয় না রাজদীপের। দুজনের বাড়ি একই গ্রামে। ছোটো থেকে বড় হওয়া একইসঙ্গে তাদের। কখন কী ভাবে তাকালে কী বলতে চায় তা অনায়েসেই বুঝতে পারে।
‘চল রাজদীপ। কালকে একটু তাড়াতাড়ি রেডি হোস।’
‘নারে দেরিতেই যাবো। শুধু প্রোজেক্টের ক্লাসের জন্যেই।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।
২
ম নো বি লা প
‘মা আমি এখুনি আসছি।’
রাজদীপ চলে যায় বুড়ি বালাসন নদীর ঘাটে। যেখানে তার কেটে গেছে সমস্ত শৈশব। আসলে নদী ভীষণ প্রিয় রাজদীপের। নদীর কাছে আসলে মন শান্ত হয়ে আসে। এই নদী সবার কথা চুপটি করে শোনে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই নদীর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে পৃথিবীর সমস্ত সংসার। তবে এই বুড়ি বালাসন নদীও রাজদীপের কাছে নিজের কথা মৌন ভাবে জানিয়ে দেয়। তাদের মধ্যে কথোপকথন চলে এক কলকল নদী-ভাষায়। বাঁধের উপর বসে থাকে রাজদীপ ঠিক বটগাছের ছায়ায়।
‘কাকিমা রাজ কোথায়?’
‘কি জানি বাবা ও তো সকালে বেড়িয়ে গেলো।’
কৌশিক ঠিক জানে এই সকালে রাজকে ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে। সেও হাসতে খেলতে নদীর ঘাটের ধারে বাঁধের উপর রাজের পাশে গিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরালো।
‘শোন জিনি ফোন করেছিলো আজকে নাকি স্যার আমাদের ক্লাসটা ফার্স্ট হাফে শেষ আওয়ারে নিবে। তুই তো মোবাইলটা বাড়িতে ফেলে এসে বসে আছিস। জিনি কিন্তু রাগ করে বসে আছে। আমি যতটা পেরেছি সামলে দিয়ে এসেছি।’
‘আসলে চার্জ ছিলো না। চার্জে দিয়ে বেরিয়েছি।’
‘আচ্ছা আমি চললাম বারোটার মধ্যে তৈরি হয়ে নিস।’
রাজ যখন বাড়ি ফিরে তখন বাড়িতে ভানু পাগলি এসে হাজির। অবশ্য রাজ জানে যে ভানুকে পাগলির তকমাটা সমাজের দেওয়া। আসলে সে পাগল নয়। একটু বেশি কথা বলে ওই আর কি আর কখনও কখনও ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলে, আর মাঝে মাঝে নিজেই হাসতে থাকে। সবচেয়ে প্রয়োজন যেটা বলার সেটা হল ভানু একটু বেশি আত্মকেন্দ্রিক।
‘কি মাসিমা কখন এলে?’
‘এই তো বাবা কিছুক্ষণ হল।’
‘আচ্ছা বসো।’
‘কি রে, তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি রে? কৌশিক এসে ঘুরে গেলো। বেলা দশটা বাজে কোনও খেয়াল আছে।’
‘এই তো এখানেই। আচ্ছা মা আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরবো। আজকে কলেজ যেতেই হবে।’
রাজদীপ গা থেকে গেঞ্জিটা খুলে গামছা পড়ে কুয়োর পারে যায়। তার বাদামী রঙের শরীর, বুকে চকচকে কালো লোম, লম্বা লম্বা চুল , মাথায় এক বালতি জল ঢালতে ভানু পাগলি কেমন হা করে তাকিয়ে থাকে। মাথা থেকে পিঠ দিয়ে পা পর্যন্ত টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়-অরণ্য হয়ে বয়ে জল। ভানু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কোন এক অতৃপ্তি চোখ-মন-দেহ নিয়ে। রাজ অনুভব করতে পারে যে ভানু পাগলি তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অসহ্য লাগছে তার। তাই তাড়াতাড়ি স্নান সেরে তৈরি হয়ে খেতে বসে পড়ে। এই ভানু পাগলিও বাড়িতে রান্নাবান্না না করে সাতসকালে বেড়িয়ে পড়ে টো টো করতে।
‘কি মাসি বলো কেমন আছো? ভাত খাবে নাকি? এসো বসো।’
ভানু পাগলির মনটা চায় পাশে গিয়ে বসুক। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনা, ‘না তুমি খাও, আমি পরে খাবো।’
‘মেসো কি বাড়িতে? নাকি মেসোর আজ উপোস!’
‘ওহো ঠিক বলছো...’
কিছু একটা বলছিলও একা একাই । রাজ আর মন দিয়ে শোনে না।
কলেজ যেতে তারা নক্সালবাড়ি বি.ডি.ও. অফিসে নেমে রায়পাড়া শর্টকার্ট রাস্তা নেয়।
‘হুম তোমাদর আজকে প্রোজেক্ট সম্পর্কে বলবো বলেছিলাম। তো তোমরা হলে ত্রিশ জন, আর রয়েছে পাঁচটি বিষয়। ছয় জন করে ভাগ করে দেবো এক একটি দলে। বিষয় পাঁচটি হল, স্কুল সার্ভে, সাত দিনের টিচার ট্রেনিং, শান্তিনিকেতন ভ্রমণ স্মৃতি প্রবন্ধ, বয়স্ক শিক্ষা এবং পুষ্টি।’
এবারে প্রফেসর সমস্ত বিষয় নিয়ে বোঝাতে শুরু করেছে। ক্লাসে কৌশিক থাকাতে রাজের চিন্তা একটু কম। কৌশিক সমস্ত বিষয়গুলো ভালো করে বুঝে স্কুল সার্ভের প্রজেক্ট নিলো সেখানে নিশ্চিত ভাবেই দলে রেখেছে রাজকেও। আর জিনি চলে যায় টিচার ট্রেনিং প্রজেক্টে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু সাঁওতাল মেয়ে খুব চকচকে পেন্সিলের রঙ চেহারা, বুকে শিশু, পিঠের ঝোলাতে সেই টিয়ে-রঙের শিষ-পাতা তুলে তুলে রাখছে। আহা এও এক লীলা খেলা ইশ্বরের। এক সুন্দর আরেক সুন্দরে মিলেমিশে একাকার।
জিনি বেশ জোরে ধাক্কা দেয় রাজকে। জিনি বেশ স্পষ্ট দেখতে পায় রাজের নজর সেই সাঁওতাল মেয়ে আর মহিলাগুলোর বুকের দিকে। জিনি কিছু একটা বলতে গিয়েও আর বলে উঠতে পারলো না। কৌশিক রাজকে বলতে লাগলো, ‘রাজ আজকে তো আর ক্লাস হবে না, মাত্র আড়াইটা বাজে; আমি বলি কি জিনির মনটাও খারাপ, তো তোরা দুজন জানা কোথাও থেকে একটু ঘুরে আয়।’
‘তুই বেশি বুঝিস!’
জিনি বেশ স্পষ্ট শুনতে পেলো। রাজও জিনির মুখের দিকে একটু তাকালো। শাদা-দুধ মুখে যেন কালো মেঘ নেমে এসেছে। রাজ-জিনি-কৌশিক সেই একই পথে রাস্তায় হেঁটে এসে শিলিগুড়ি বাসে উঠলো। রাস্তাতেই জিনিকে মানিয়ে নিয়েছে রাজ। তারা দুজন যাবে শিলিগুড়ি সূর্য সেন পার্ক। কৌশিক গোঁসাইপুর নেমে যায়।
দশ টাকা টিকিট পার্কের। জিনি এবং রাজ দুজনে পার্কের ভিতরে টালির ছাদ দেওয়া ছাউনি ঘরে এসে বেঞ্চিতে বসলো। রাজ হঠাৎই জিনির কোলের উপর শুয়ে পড়লো। জিনি চুলের উপর দিয়ে হাত বোলাতে বোলাতে, ‘কী হয়েছে একটু মন খুলে বলবি?’
‘না রে কিছু না।’
‘বল না এমন করিস কেন?’
‘তোকে বলবো না তো আর কাকে বলবো বল। মনটা যেন কেমন করছে খুব কদিন থেকেই।’
জিনি চুপ করে সব কথা শুনতে লাগলো। রাজ বলতে থাকে একে একেঃ ‘তুই ভুল বুঝিস না আমাকে, আসলে ব্যাপারটা কি জানিস; কিছুদিন থেকে রাতে ঘুমোনর আগে খুব পর্ন দেখছিলাম মোবাইলে। প্রথম প্রথম বেশ ভালোই লাগছিলো। তারপর কবে থেকে যেন অভ্যেস হয়ে দাঁড়াল। সত্যি বলছি একদম ভালো লাগে না এখন দেখতে, তবে কেন যেন ছাড়তেই পারছি না। চোখ শুকিয়ে আসে, মাথা ঝিম ধরে যায় আর সেই গন্ধ আমাকে খুব টানে। শেষ পর্যন্ত মুখ চোখ বন্ধ করে মাথা গুঁজে দিই দুটো বালিশের মাঝে। একটা বিষয় খুব ভাবাচ্ছে। এই যে তারা অনায়সেই পর্নগ্রাফি করে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে কি কোন ভালবাসা নেই, নাকি দেহ শুধুই দেহ আর দেহ! জানিস তো আমি কতদিন থেকে ঘুমুতে পারছি না। ঘুরে ফিরে শুধু চোখে দেহ ভাসছে; ব্যাঙ যেভাবে ওঁত পেতে বসে থাকে ফড়িঙের জন্য আর সাপ ব্যাঙের জন্য তেমনই রাত ওঁত পেতে বসে থাকে আমার জন্য! একদম পারছি না রে!’
কৃষ্ণচূড়ার পাতাগুলো হলুদ বিষাদের মতন ঝরে পড়ল হঠাৎ দমকা হাওয়ায়। একটা চড়ুই একবার এডাল ওডাল ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ে উড়ে বসছে।
‘তুই বেশি ভাবিস না রে, আমি তো আছি, ওসব দেখা ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিস। যখনই মন খারাপ করবে আমাকে ফোন করিস। আর সব কথা মন খুলে বলবি।’
‘বিষয়টা শুধু পর্ন পর্যন্ত নয় রে। বিষয়টা আরেক জায়গায়। খুব অস্বস্তি হচ্ছে। বুঝতেই পারছি না কী করবো। আমাদের পাড়ায় ভানু পাগলীর কথা তুই তো জানিস। আজকাল ওর চোখ দেখে ভীষণ ভয় লাগছে। আমি বেশ স্পষ্ট দেখতে পাই ওর চোখে কোন এক অতৃপ্তি, আর সেই অতৃপ্তি প্রতিদিন এসে আমাকে দেখে পুষিয়ে নিচ্ছে। যেন আমাকে শুষে নিচ্ছে। কী কামার্ত দৃষ্টি!’
‘কী সব বলছিস বাজে কথা। কিছুদিন আগেই তো বললি ভানু পাগলী তোকে সন্তানের মতো দেখে এবং স্নেহ করে।’
‘হুম সত্যি বলছি আমি, তুই না দেখলে বিশ্বাস করবি না। ওর চোখে পরিষ্কার দেখতে পাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখ দিয়ে গিলে ফেলছে আমাকে। আগে বেশ চোখের দিকে তাকাতে পারতাম, এখন একদমই পারি না। অসম্ভব অসহ্য লাগে পাশে ঘেঁষতেই!’
‘আচ্ছা শোন তাহলে এখন আর বেশি পাশে যাস না। যতটা পারিস ইগনোর কর। আর এই ক-দিন তো স্কুল সার্ভে করবি। তো, সবই অভ্যেস। সব পাল্টে যাবে। মন খারাপ করে থাকিস না। মন খারাপ করলে আমাকে ফোন করিস।’
৩
দৈ ন ন্দি ন
‘কিগো রান্না হল। সময় তো পেরিয়ে গেলো।’
‘এখন তুমি সেদ্ধ ভাতই খেয়ে যাও। দুপুরে হোটেল থেকে খেয়ে নিও। আর সন্ধ্যা বেলাতে মাছ নিয়ে এসো। রাতে মাছের ঝোল আর একটা সবজি করবো।’
‘রাজ আজকের পেপারটা ব্যাগে দিয়ে দিস তো, দেখাই হল না আজকের খবরটা। কলেজ যাবি না ?’
‘না বাবা। ওই প্রোজেক্টের জন্য স্কুল সার্ভেতে বেরবো। আমি কৌশিক আর বাকি বন্ধুরা মিলে।’
রাজের বাবা সেদ্ধ ভাত খেয়ে কাজে বেরিয়ে গেলো। আর রাজ চা খেয়ে বুড়ি বালাসনের ধারে। কত না গল্প হয় বুড়ি বালাসনের সঙ্গে রাজের। সমস্ত দুঃখ–কষ্ট, মনোমালিন্য সব ধুয়ে মুছে যায় এই নদীর কাছে। কৌশিকও এসে হাজির, একটা সিগারেট ধরালো।
‘জানিস মধুমিতার ছেলে হয়েছে, আরে আমাদের রনির বউ। কি দুর্ভাগ্য , ছেলেটা অন্ধ জন্মালো। ডাক্তারে বলেছে যে, ছেলেটা অন্ধের কারণ নাকি তার মা’ই। না খেয়ে খেয়ে পাট কাঠির মতো চেহারা বানিয়েছিল আর বেশি পরিমাণে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ খেয়েছিল। ব্যাস সাইড এফেক্ট আর অপুষ্টির কারণে ছেলেটা গেলো। সারাজীবন এখন একটা ট্যাগ নিয়ে থাকবে রনির বউ “অন্ধের মা”।’
রাজ অন্য কথা ভাবে, আহা ছেলেটা এতো সুন্দর পৃথিবীটা দেখতে পাবে না। এই আকাশ-সূর্য-পাহাড়- গাছ-নদী আর এই বুড়ি বালাসন। আহা এভাবে জন্মানোও পাপ। ঈশ্বর কেন এত দয়ামায়াহীন কেন এত নিষ্ঠুর। আবার পরক্ষণেই ভাবে অন্ধ জন্মেছে যাক ভালোই হয়েছে। এই ঘৃণ্য-কদর্য চোখ গুলোতো দেখতে পাবেনা। এই যে আমরা দেহ দেহ করে মরছি এ থেকে তো নিশ্চিন্তে থাকবে।
‘চল রে আমার দার্শনিক! খালি ভাববি নাকি কিছু থিসিস লিখবি তোর ফিলোসফি সাবজেক্টের উপর।’ বলেই একটা উচ্চ হাসি দিলো কৌশিক। ‘সার্ভেতে বেরতে হবে তাড়াতাড়ি রেডি হোস।’
‘রাজের মা … ও রাজের মা!’
‘আরে দাদা যে। বসেন, চা করি।’
‘আরে না না আমার সর্বনাশ হয়েছে । একটু আপনি গেলে ভালো হয়।’
‘কি হল আবার?’
‘আরে ভানুকে খুব মারছে আশেপাশের লোকজন। ভানু দরজা বন্ধ করে বসে আছে খুলছেই না। সুইসাইড করবে বলছে।’
‘আরে হয়েছেটা কি আবার? আর খালি বাড়ি ফেলে কী করে যাই বলুন? ছেলেটা এইমাত্র সার্ভেতে বেড়িয়ে গেলো।’
‘আপনাকে যেতেই হবে। ভানু বারবার আপনার কথাই বলছে। আপনাকে যেতেই হবে। আসলে পাশের বাড়ির গোরুটা ভানুর লাগানো বেড়ার ধারের লাউ গাছটা খেতে আসছিলো তা দেখে ভানু কাঠের বাটাম দিয়ে গরুর পায়ে মেরেছে। ব্যাস পা ভাঙছে তো ভাঙছে আবার পিঠেও কাঠের চ্যালা ছুঁড়ে মেরেছে। আর তাতেই পাড়ার লোক তো ছেড়ে কথা বলবে না … সুযোগ পেলেই হল। এমনিতেই আমার বউটা পাগল, কী করতে না কী করে বসে। আপনাকে এখন যেতেই হবে।’
‘আচ্ছা আচ্ছা চলুন।’ রাজের মায়ের সাড়া পেয়ে ভানু আবার দরজার ওপার থেকেই পাড়া শাসানি শুরু করে দেয়। চিৎকার করতে করতে দরজাটা খুলে দেয়। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে। রাজের মা তাকে আশ্বাস দেয় পাড়ার লোক আর তার সাথে খারাপ ব্যাবহার করবে না। সেই সঙ্গে ভানুকেও বুঝিয়ে বলে বেশি তর্কে যেতে না এবং সবার সাথে সভ্য ব্যাবহার করতে। তবুও রাজের মায়ের মনে সন্দেহ থেকে যায় কারণ সে জানে ভানু এক কান দিয়ে কথাগুলো ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দেবে, তাছাড়াও ওর মানসিক অবস্থা ভালো নেই।
‘চল আমার সঙ্গে আমাদের বাড়ি । আজ দুপুরে ওখানেই থাকবি।’
এক পায়ে রাজি হয়ে যায়। একটু অপেক্ষা করতে বলে রাজের মা’কে। আসলে ভানু মানসিক ভাবে অসুস্থ হলেও সাজগোজ করতে খুব ভালোবাসে। সবসময়ে পরিষ্কার থাকে, শাড়ির কুচি গুছিয়ে পড়ে, লাল টিপটা ঠিক কপালের মাঝখানে, চুলগুলোতে নারকেল তেল দিয়ে জপজপ করে ছেড়ে রাখতে ভালোবাসে। পায়ে যেমন সবসময়ে আলতা পড়তে ভালোবাসে তেমন ভাবেই চোখে কাজল পড়তে ভালোবাসে। কেউ বলতেই পারবেনা যে ভানুর বয়স রাজের মায়ের থেকে বেশি, বরং তাকে অনেকটা ছোটই মনে হয়।
‘কি রে, হল তোর? এবারে কিন্তু আমি একাই ফিরে যাবো।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ চলো চলো।’
বাড়ি ফিরে এসে রাজের মা ঘরদোর মুছতে শুরু করে দেয়, স্নান সেরে পুজো দিতে হবে।
‘হ্যাঁরে রাজ কই রে? দেখতে পাচ্ছিনা যে?’
‘ও তো কলেজের প্রোজেক্টের সার্ভেতে গ্যাছে।’
‘কী, কী বললি? কিসের সার্ভে?’
‘ও ছাড়, তুই বুঝবি না। তুই বোস, আমি স্নান সেরে আসি।’ স্নানে চলে যায় রাজের মা।
আর বারান্দায় বসে একাই একাই বলে যায় ভানু।
‘আমার যদি ঠিক বয়েসে বিয়ে হত না তাহলে তোর মত একটা ছেলে থাকত। আমার দাদাগুলাই এক একটা বদমায়েশ। শালা বিয়া দিলি তো দিলি ওমন একটা বুড়ার কাছে। শালা আমি বাঙালি আর ও নেপালি বুড়া । ওই নেপালি বুড়ার জন্যই আমার ছেলেপিলে নাই। নেপালি-বাঙালি কোনোদিন বাচ্চা হয়? আর রান্না করুম না আমি আর রান্না করুম না। এই বুড়া না খেয়ে মরুক। শালা ওই বুড়া আমার কাজের না। কাজেও যায় না। তুই শোননা আমার বুড়া অনেক কাজ জানে, তোর গাছ কাটার থাকলে আমার বুড়াকে বলিস ঠিক আছে? কিরে, শুনছিস তো?’
মাথা নাড়তে থাকে সেই সঙ্গে শরীরও দোলাতে থাকে ভানু, আর এভাবেই একা একা কথা বলতে থাকে। সবাই সবটা শোনে না। কিন্তু ইশ্বর নীরবে সবটা দেখেন, শোনেন, হাসেন, কাঁদেন।
সন্ধ্যা বেলাতে রাজ বাড়ি ফিরে।
‘কি মাসিমা কেমন আছ?’
‘হ্যাঁ বাবা ভালো আছি। রাজ শোন না তুই এমন একটা ফুটফুটে বউ আনবি যে এই মাসির সব কথা শুনবে ঠিক আছে।’ আরও অনেক কিছু বলতে থাকে।
রাজ আজ অনায়েসে ভানুর চোখের দিকে তাকাতে পারে সেখানে আজ সন্তান-স্নেহদৃষ্টি ছাড়া কিছু নেই।
‘হ্যাঁ আচ্ছা আচ্ছা, মাসি বসো। আজ রাতে এখানেই খেয়ে যেও কেমন ঠিক আছে।’
‘না বাবা আমি এখন যাই, তুমি অনেকটা খাটাখাটনি করে এসেছো, একটু রেস্ট করো। আমারতো একটা বুড়া আছে বাড়িতে। বুড়া মনে হয় কিছু খায় নি এখনো। তুমি খেয়ে নিও রাতে ঠিক আছে। আর শরীরে যত্ন নিও...।’
যখনই কথা বলে অর্ধেক কথায় কেউ পাত্তা দেয়না । তবে রাজ আজ এটুকু মনোযোগ দিয়ে শুনতে পেল।
চার
হ্যা লু সি নে শ ন
আজ ঘুম থেকে ওঠার কোন তাড়া নেই। রবিবার দেখে মা’ও ডাকে না রাজকে । বাবা বাড়িতে খাসির মাংস কিনে দিয়ে কাজে চলে যায়।
‘বেলা দশটা বাজে এবারে তো উঠ।’
মোবাইলটা বেজে উঠে কৌশিকের কল এসেছে। ‘হ্যালো রাজ, জিনি ফোন করেছিল, ও আসছে। তুই তো ফোনই তুলিস না।’
‘ওহো, ঘুমিয়েছিলাম রে! সাইলেন্ট মোডে ছিলো। ওকে বুড়ি বালাসনে আসতে বল। আমি আসছি।’
বিছানা থেকে উঠে চা খেয়ে বেড়িয়ে পড়লো। সেই বাঁধের উপর একা বসে থাকে। জিনি এখনও পৌছায়নি। এই নদীর সাথে তার রক্তের সম্পর্ক। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনেক স্মৃতি তার মনে পড়ে যায়। এই নদীতে কত বন্ধু মিলে স্নান করে, মাছ ধরে হেসে খেলে কাটিয়ে দিয়েছে। বন্ধুরা সবাই যেন হারিয়ে গেলো। কেউ পড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে ঢুকে গেলো, কেউ বাইরে পড়তে চলে গেলো, কেউ বিয়ে করে নিলো, আর মনোতোষটার যদি অ্যাকসিডেন্ট না হতো। শুধু রয়ে গেলো এই বুড়ি বালাসন আর রাজ-কৌশিক। বুড়ি বালাসনও যেন ধীরে ধীরে রাজকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আসলে নদীর চরগুলোও অজান্তেই দালালের হাত ধরে প্লট হিসেবে কন্সট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির হস্তান্তর হয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় রাজের বুক ভর্তি জল থাকত, এই নদীর এখন কান্না পায়। কিন্তু চোখের জল সব কোন এক অপদেবতা শুষে নিয়েছে ঠিক সেভাবেই যেভাবে রাতের বেলায় রাজের চোখের জল শুষে নিয়েছিলো অশ্লীল অসভ্য কদর্য মন। তবুও একবার মন খুলে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে রাজের। কিন্তু কিছুতেই যেন আসেনা।
গোঙানির আওয়াজ শুনে জিনি ভীত হয়ে রাজের পাশে গিয়ে হাত ধরে কী সব যেন বলতে চায়। আর তাতেই জিনিকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপটি করে থাকে।
‘কাকে বেশি ভালোবাসিস? এই বুড়ি বালাসন নাকি আমাকে?’
‘তোকে।’
জিনিয়া মুচকি হেসে রাজের সঙ্গে নদীর বাঁধেই বসে গল্প শুরু করে দিলো।
‘কেমন হল সার্ভে এই কদিন?’
‘হুম ভালোই, তোর স্কুল কেমন? ক্লাস কেমন নিচ্ছিস?’
‘জানিস স্কুলের বাচ্চাগুলো সব একেকটা পাকা। ক্লাস এইটের ক্লাস নিচ্ছি আমি। আমাকে জিজ্ঞেস করে ম্যাম --- গুপ্ত যুগের নারীরা কি পড়াশোনা করত? ওরা জানেনা যে আমার প্রিয় সাবজেক্ট ছিল ইতিহাস। ব্যাস আমিও একেবারেই গুপ্ত যুগের ইতিহাস খুলে বসলাম। গুপ্তযুগের মহিলাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহন করার সুযোগ ছিলো। ‘অমরকোষ’ নামক একটি গ্রন্থ আছে, সেখানে শিক্ষিকাদের ‘উপধ্যায়’ ও ‘আচার্য’ বলা হয়েছে। সেই সময়ে নারীরা অনায়সে বেদপাঠ করতে পারতো, তাদের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা ছিলোনা । সেই সঙ্গে সঙ্গীত, সাহিত্য, কলাচর্চা করতো। ‘হর্ষচরিত’, ‘রত্নাবলী’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে রাজ্যশ্রী, কামন্দকী, কাদম্বরী, অনুসূয়া প্রমুখ নাম পাওয়া যায় যারা কিনা নৃত্য-গীত উচ্চশিক্ষা সঙ্গীত চর্চা করতেন। আর এতেই ছাত্ররা আমাকে খুব ভালোবেসে ফেলে। আমি তো খুব খুশি স্কুল ট্রেনিংটা নিয়ে। তুই যে কেন নিলি না।’
অনেক কথাই রাজ মন দিয়ে শুনে না। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে আর কী যেন শুধু শুধু ভাবে। এবারে রাজ জিনিকে বলে, ‘তুই কি আজ ফাঁকা আছিস?’
‘কেন? মাকে বলেই এসেছি যে তোদের বাড়ি যাবো।’
‘হুম চল না, চারটা-সাতটার শো মাটিগাড়া সিটি সেন্টার আইনক্সে; ‘জোকার’ মুভিটা দেখে আসি। ফিলমটা ভালো হয়েছে শুনলাম।’
‘উরি বাবা! না রে আমি অত আর্ট ফিল্ম বুঝি না।’
‘তুই কি দ্যা ডার্ক নাইট মুভিটা দেখেছিস? তাহলে আর বলতি না এসব কথা। ব্যাটম্যান চরিত্রে ক্রিশ্চিয়ান বেল-এর অভিনয় ছাড়িয়ে গ্যাছে জোকার হেথ লেজার। নায়কের থেকে ভিলেন সবার মনে জায়গা করে নিয়েছে। আর হ্যাঁ ব্যাটম্যান জানতই না যে নায়িকা রচেল ডয়েস মানে ম্যাগি গিলেনহাল ব্যাটম্যানকে শুধু বন্ধু হিসেবেই ভাবত। আসলে এবারে জোকার মুভিতে দেখানো হয়েছে জোকার কিসের জন্য জোকার হয়েছে। তার পেছনে কারণ কী? তবে হিরোটা পালটে গেছে। জোকারের রোল এবারে অভিনয় করেছে জোয়াকিন্স ফোনিক্স। শুনেছি রেটিং স্টার এইট পয়েন্ট নাইন।’
‘আচ্ছা বাবা, আচ্ছা আর বলতে হবে না। যাব যাব খালি একটু ফোন করে জানাতে হবে বাড়িতে।’
‘এখন চল বাড়িতে গিয়ে বসি।’
‘মাসিমা কেমন আছো?’
‘আরে জিনি যে! কখন এলে? বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?’
‘এই তো সবে মাত্র, সবাই ভালো আছে।’
‘আচ্ছা বসো।’
‘মা, আমরা একটু বেরবো, সিটি সেন্টার যাবো। খেয়েই বেড়িয়ে পড়ব।’
রাজ স্নানে চলে যায়।
‘আচ্ছা মাসিমা এই ভানু পাগলিটা কে গো? ও নাকি খুব কথা বলে?’
‘হ্যাঁ। ওইতো পাশের গ্রামে নদীর পাড়ে একটা ছোট্ট বাড়িতে থাকে। রাজকে ছেলের মতো দেখে। আসলে ওর সন্তান নেই তো তাই।’
‘রাজ বলেছিল ওর নাকি অনেক কীর্তি আছে। আমি কিন্তু একদম বিশ্বাস করি নি।’
‘না না সত্যি, রাজ ঠিকই বলেছে। তাহলে তোমাকে একটা কীর্তি বলি শোনো। এই তো ধরো দুই বছর আগে হবে, শীতের সময় বেশ কুয়াশা ছিল সকালের দিকে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। তখন ও মুখার্জী বাড়ির শিশুটির কান্নার আওয়াজ পায়। অত সকালে কেউ ঘুম থেকে উঠে না। ভানু করলো কি সঙ্গে সঙ্গে দরজা থাপড়িয়ে থাপড়িয়ে চিৎকার শুরু করে দিলো। আর পাড়ার লোক সব এসে হাজির। ও নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে বাচ্চাটির মা দুধ না দিয়ে শিশুটিকে মারছে। ব্যাস একা একাই চিৎকার করে যাচ্ছে। শুধু এইটুকুই নয়, শেষে সুযোগ বুঝে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে দৌড়। সে কি যেমন তেমন দৌড়! সমস্ত পাড়া ওর পিছনে পনেরো মিনিট দৌড়েছে। আসলে ফাঁকা মাঠে ঢুকে পরেছিলো আর কেউ তাকে ধরতেই পারছিলো না। বাচ্চাটা কেঁদেই যাচ্ছে আর ও কিনা একটা শিমুল গাছের পিছনে গিয়ে বসে নিজের বুকের ব্লাউসের হুক খুলে দুধ দিতে যাচ্ছিলো --- অমনি পাড়ার লোক ধরে কি বেদম মারটাই না দিলো।’
‘কী বলছ মাসিমা!’
‘শুধু এইটুকুই নয় এরপর আরও শোনো। এরপরে তো আসল কান্ড।’
‘আরও বাকি আছে!’ অবাক হয়ে জিনি বলে।
‘হুম শোনো। এরপরে কিছুক্ষণ পরে বাড়ি ফিরে ওর স্বামীর সঙ্গে তুমুল ঝগড়া। স্বামী গুরুত্ব না দেওয়াতে পুকুরে ডুবে মরে যাওয়ার হুমকি দিয়ে বেড়িয়ে যায়। ওর স্বামী তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটা নিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর আর যখন ভানুকে দেখা যায় না তখন ওর স্বামী চলে যায় পুকুরের ধারে। দেখতে পায় ভানুই পুকুরের জলে খাবি খাচ্ছে আসলে সে সাঁতার জানে না। পিঠটা জলের উপরে মাথাটা জলের নীচে হাত পা নাড়তেই পারছে না। সঙ্গে সঙ্গে দুজন ঝাপ দিয়ে তুলে এনে পেটের মধ্যে চাপ দিতেই মুখ দিয়ে জল বেড়িয়ে হুঁশ ফিরে আসে ভানুর --- আর ও বলতে লাগলো, লাল-নীল-সবুজ-হলুদ-কমলা আমি হেঁটেই যাচ্ছি হেঁটেই যাচ্ছি ওপার হয়ে যাব চিংড়ি মাছ অনেক চিংড়ি মাছ, শ্যাওলা, সামনে একটা বড় পাথর। আরও কিসব যেন বলে ইয়া বড় বড় চোখ করে।’
জিনিয়া হাসতে শুরু করলো গল্পটা শুনে।
‘তুমি হাসছো । অবশ্য সেদিন সম্পূর্ণ পাড়াটাই হেসেছিলো ওর কীর্তি দেখে। শুধু সেই বাচ্চার মা আর আমি হাসতে পারলাম না কেন যেন। আসলে আমি ওকে ছোটো থেকেই চিনি তো। ওর উপর দিয়ে কি গেলো শুধুইতো ও জানলো বলো। আর কেউ কি কিছু বুঝতে চেষ্টা করলো? আসলে আমরা কেউই অন্যের মানসিক অবস্থাকে গুরুত্ব দিই না। কী, ঠিক বল্লাম তো জিনি?’
এবারে জিনির মুখটা শুকিয়ে আসে। কিছু বলে না মাথা নিচু করে চোখগুলো এদিক ওদিক করছে । মাসিমার চোখে চোখ দিতে পারছেনা।
‘মা ভাত বাড়ো তো।’
‘যাও জিনি তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও । আমি খেতে দিই তোমাদের দুজনকে।’
জোকার মুভি সুপারহিট হলেও আইনক্সে তেমন ভিড় নেই। রাজের কাঁধে মাথা রেখে মুভি দেখতে দেখতে কি সব একা একাই ভেবে চলেছে জিনিয়া। প্রথমে তো বেশ হাসি পাচ্ছিলো জিনিয়ার তবে এখন কেন পাচ্ছে না বিষয়টা ভেবে। কোথাও কি কিছু একটা হয়েছে? না তেমন কিছু তো নয়। আবার ভাবে ভানু ওই রকম করে বাচ্চা নিয়ে দৌড়ে পালালো কেন? কেন পুকুরে ডুব দিলো? ও কি সত্যি মরতে চেয়েছিলো! তাহলে স্বামীকে বলে কেন বেরোল? না আর ভাল্লাগছে না। মুভির ইন্টারভ্যালেই জিনিয়া বলে উঠলো ধুর ভাল্লাগছে না রে, কি বোরিং মুভি। আমি বাড়ি যাবো।
রাজ কোনদিনই জিনির খেলাপ হয় নি । অতএব মুভিকে মাঝপথে বিদায় জানিয়ে সরলপথে বেড়িয়ে পড়লো কংক্রিটের পথে।
‘আচ্ছা রাজ তুই কি জানিস ভানু মাসির কেন কোন সন্তান নেই? ও কি স্টেরাইল?’ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দুজনের কথোপকথন ।
‘না তো, জানিনা তো, এভাবে তো কোনোদিন ভাবি নি।’
এবারে পথে হাঁটতে হাঁটতে নীরব হয়ে আসে জিনিয়া, তার মাথায় চলতে থাকে শিশু-স্বামী-পাড়া; হলুদ-নীল-সবুজ-কমলা আর দেহ, শুধু দেহ নাকি স্টেরাইল? স্টেরাইল হয়ে গেলে কি মেয়ে জন্ম নিষ্ফল? মেয়ে হয়ে জন্মানো পাপ! আমি কি সুইসাইড করতে পারব। পুকুরে ঝাপ দিতে পারব। এই জগত কি মিথ্যা? এই আকাশ-গাছ-নদী-সমুদ্র? আর আমার জানালার ধারে বসে থাকা সব মিথ্যা? আমি কি জানালা খুলে দিতে পারবো? নাকি সবসময়ে জানালা বন্ধ করে রাখবো, আমার জানালা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে না তো? নাকি জানালার ফুটো দিয়ে দেখবো এই রাস্তা, রাস্তার পাশে মাঠ, মাঠের শেষে অনেক গাছ, শিমুল গাছ, শিমুল গাছের নীচে বসে আছে অনেক মা তাদের বুকের স্তন থেকে দুধ পান করছে শিশু? আহা সূর্য পশ্চিমে নেমে যাচ্ছে … কী মধুর গোধুলী! শিশুরা মায়ের কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।
সোজা একটা রিক্সা এসে গায়ে ধাক্কা মেরে চাকা তুলে দিলো জিনিয়ার পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে সম্বিৎ ফিরে পেলো জিনিয়া। পায়ের অনেকটা কেটে গেছে রক্ত ঝরতে লাগছে। তা দেখে রাজ রিক্সাওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করতে শুরু করলেও জিনির অবস্থা দেখে আর দেরি না করে একটি মেডিকেল ষ্টোরে নিয়ে গেলো। পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে পেইন কিলার, অয়াসিলক, ন্যানোফাইন জেল ধরিয়ে দিলো। আর বলে দিলো পরের দিন যেন হাসপাতালে গিয়ে অবশ্যই দেখিয়ে আসে।
‘কী সব ভাবছিলি রে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে?’
‘কিছু নারে।’
‘বুঝেছি ওই ভানুর কথা তো? আজকেই বাড়িতে গিয়ে বলতে হবে … এই ভানুর সঙ্গে আদিখ্যেতা কমাতে হবে। আর পারি না।’
‘না, তুই একদম ঝামেলা করবি না মায়ের সঙ্গে বাড়িতে ফিরে, আমাকে ছুঁয়ে বল।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
‘চল তোকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসি।’
‘না আমি পারবো, তুই গোঁসাইপুর নেমে যাস। আমি পারবো।’
‘বেশি বলিস না পৌঁছে দিয়ে আসবো।’
‘না বল্লাম তো।’ মোবাইলটা বের করে সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে ফোন করলো। ‘বাবা সন্ধ্যা হয়ে গেছে তুমি আধ ঘন্টা পরে এসে আমাকে স্ট্যান্ড থেকে নিয়ে যেও তো। আমি আসছি।’
রাজ আর কোন কথা বলে না, জিনিও ওষুধগুলো গুছিয়ে নিয়ে দুজনেই বাসে উঠে পড়ল।
পাঁচ
শি ক্ষা
‘কী দেখছ সকাল থেকে মন দিয়ে সংবাদপত্রে মুখ গুঁজে?’
‘রাজের মা, কী বলি বলো তো? সংবাদপত্রে তো আর ভালো কিছু নেই।’ একটি ডাস্টবিনের নিচে নোংরার মধ্যে একটি মৃত সদ্যোজাতের ছবি দেখিয়ে রাজের বাবা বলতে লাগলেন, ‘শরীরের খিদে মিটলেই হলো। আজকাল যে কী হচ্ছে সব! সমাজ একেবারে দিনদিন তলানিতে ঠেকছে। দু-দিনের পরিচয় তারপর শুধু দেহ-দেহ খেলা। এই যে বাচ্চাটাকে পৃথিবীর মুখ দেখতে দিল না, এগুলো কি ঠিক? যখন যথাযথ মর্যাদাই দিতে পারবি না তো এতদিন বাচ্চাটাকে পেটে পুষেই রাখলি বা কেন? যার কোন অস্তিত্বই থাকলো না সেও এখন পুলিশের ডায়েরিতে শুধু একটা ইতিহাস হয়ে থেকে গেলো।’
দীর্ঘ শ্বাস ফেললো রাজের বাবা।
রাজের মা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মুখ থেকে একটাও কথা বের হলো না, কিন্তু কতকিছু যেন বলতে চাচ্ছিল। কী করে যেন কোথাও কিছু একটা হয়ে গেছে যে কথা বের হচ্ছে না। পাখির ছানা কিচির মিচির করতে লাগল বাড়ির জাম গাছটায়। কুকুরছানা কিছুক্ষণ পরপর কোঁ কোঁ করে উঠছে। সেই ভয়ে বিড়ালছানা চৌকির নিচে ঢুকে গেল। ইঁদুরের বাচ্চাগুলো সারিসারি করে লাইন ধরে সিলিঙের উপরে উঠে গেল। হঠাৎ রাজ মায়ের কাছে এসে গলা জড়িয়ে ধরলে সম্বিৎ ফিরে আসে মায়ের।
মা রাজকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন, ‘রাজ তোকে কবে থেকে বলছি ভোটার কার্ড আধার কার্ড লিঙ্ক করে আনিস। আর ভানু মাসি প্রতিদিন এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে। আমার মাথা খারাপ হয়ে যায় বাংলাদেশ পাঠিয়ে দিবে, বাংলাদেশ পাঠিয়ে দিবে গল্প শুনতে শুনতে। পাড়ার লোকগুলোও পারে --- খালি ওকে ভড়কে দেয়।’
‘মা এটা তো ভোটার কার্ড ভেরিফিকেশন। আর ভানু মাসিরটা কেন রেখেছ আমাদের বাড়িতে? ভাল্লাগেনা কিন্তু! দুই দিন তো ক্যাফেতে গিয়ে ঘুরে এলাম। লিঙ্ক থাকেনা কখনও, কখনও ওয়েবসাইট স্লো। সময় আছে আমি করে দিবো।’
‘অতশত বুঝি না বাবা! তাড়াতাড়ি করে আনিস।’
‘মা খেতে দাও তো! আমি সার্ভেতে বেরবো।’
রাজদীপ, কৌশিক, অনন্যা, দ্বীপ, সন্দীপ, উত্তম এই হচ্ছে তাদের ছয় জনের সার্ভে গ্রুপ। আজকের লক্ষ্য বাগডোগরা সিস্টার নিবেদিতা প্রাইমারি স্কুল।
বেশ সুন্দর স্কুল। চারিদিকে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা দেওয়া দিয়ে ফুলের বাগান। হলুদ রঙের দু-তলা বিল্ডিং নিচের তলায় দেয়ালে বেশ কিছু কার্টুনের ছবি, উপরের তলার দেয়ালে মণীষিদের ছবি পেইন্ট করা। দশটা রুম রয়েছে। পূর্ব দিকে খেলার মাঠ, এই খেলার মাঠ দিয়েই স্কুলে প্রবেশ করতে হয়। স্কুলের প্রিন্সিপালের নাম অহনা দাশগুপ্ত। স্কুল কর্তৃপক্ষকে আগেই জানিয়ে দিয়েছে অনন্যা ফোন করে যে তারা আজ সার্ভেতে আসছে। তাই হয়তো আজ একটু বেশি ডিসিপ্লিন লাগছে বা হয়তো ভুল ভাবছে রাজ; প্রতিদিনই এমন সুন্দর করে গোছানো থাকে।
মিস অহনা দাশগুপ্ত চোখগুলো বেশ বড় বড় মুখটা গোল। দুধ-গোলাপের মতো গায়ের রঙ, বড় করে সবুজ টিপ কপালের মাঝখানে। সাদা রঙের সবুজ পাড় দেওয়া শাড়ি পরনে। একটি বাচ্চাকে চেয়ারে বসিয়ে শার্টের কলারের উপরে টাই বেঁধে দিচ্ছে। দেখে মনে হয় না তিনি যে মধ্যবয়স্কা। সেই সময়ে তারা প্রিন্সিপাল রুমে এসে বসলো।
প্রথমেই তারা কফি খাবে কিনা জিজ্ঞেস করল। কেউ স্বীকার করলো না। তারপর স্কুলের মাসিকে ডেকে সবাইকে জল দিলো। আর সঙ্গে ডেকে নিলেন একজন সহ শিক্ষিকাকে। উত্তম একে একে সব প্রশ্ন করবে এবং বন্ধুরা তা লিখে নিবেন। এইভাবেই করে এসেছে আগের সার্ভেগুলো।
প্রথমেই সবাই স্কুলের নাম, ঠিকানা, স্থাপিত সাল লিখে নিলো। এরপর ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ বাবস্থাপনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, এতে মিস অহনা দাশগুপ্ত সাবলীল ভাবেই তাদের ট্রাস্ট সম্পর্কে বলে গেলেন। পরিকাঠামো, ফার্নিচার, পানীয় জল ও শৌচাগারের ব্যাবস্থা, স্কুলের সময়সীমা, বৃত্তিমূলক বিষয়, স্কুলের রেজাল্ট এই সবের উপর জিজ্ঞেস করে উত্তম। মিস অহনা দাশগুপ্তকে যথাসাধ্য সাহায্য করে সহশিক্ষিকারা উত্তরগুলো দিতে। সবাই খুব স্বচ্ছ ভাবেই সব উত্তর লিখতে থাকে, উত্তমের প্রশ্ন শেষ অর্থাৎ সার্ভের প্রশ্নপত্র শেষ হলে রাজ পূর্বদিকের মাঠটি নিয়ে জিজ্ঞেস করে। ‘বাচ্চারা এই মাঠে খেলে? কতক্ষণ সময় দেন? আমার কেন যেন মনে হয় ওই ক্লাস রুম থেকে মাঠকেই বেশি ভালবাসবে --- ঠিক বল্লাম তো?’
‘হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছো। আমার শিশুদের সম্পূর্ণ বিকাশের দিকেই বেশি জোর দিই। শুধু ওই বন্দি ঘরে আটকে রাখি না। চল বাইরে, দেখবে।’
বাইরে যখন আসে তখন অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। তারা যে দু- ঘন্টা এক রুমে কাটিয়ে দিয়েছে সেটা বুঝতেই পারেনি। বাইরে এসে দেখতে পায় বেশ কিছু বাচ্চা গোল করে মাঠে বসে এসে অপরকে কোন বিষয়ের উপরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে আম্পায়েরের ভুমিকায় একজন শিক্ষক। ভারি অদ্ভুত খেলা!
‘আমারা প্রতিদিন একটা করে ক্লাস সব ক্লাসেরই আলাদা আলাদা আওয়ারে মাঠে নিয়ে থাকি। আর কম্পালসারি হাফ আওয়ারের ব্রেক টাইম তো রয়েছেই। তখন এই মাঠে তারা স্বাধীন ভাবে পাখির মতো ছোটাছুটি করে।’
এই রকম ব্যবস্থা কোন স্কুলেই তারা দেখেনি সার্ভে করতে গিয়ে। সবাই আবার প্রিন্সিপাল রুমে আসে, তাদের সার্ভে কমপ্লিট। ব্যাগ পত্তর গোছাতে লাগলো। তখনই রাজ একটি রংতুলির লালের উপরে সবুজ নীল কিসব হিজিবিজি আঁকাবাঁকা পেইন্টের উপরে তাকিয়ে থাকে যা কিনা প্রিন্সিপাল চেয়ারের বিপরীতমুখী দেয়ালে ঝোলান ফ্রেম সহ।
‘কী দেখছ ওখানে?’
‘এটা কিসের পেইন্ট?’ রাজ খুব মনোযোগ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে’
‘বসো সবাই তোমাদের বলছি। আমাদের স্কুল যে আজ কুড়ি বছর হতে চলল --- এই ছবিটা রোজ আমাকে মনে করিয়ে দেয়। আজ থেকে উনিশ বছর আগে মানে প্রথম বছর খুব একটা ছাত্র সংখ্যা ছিলো না এখানে। অনেক এদিক ওদিক বলে বন্ধুদের বলে মাত্র কুড়ি জন বাচ্চা পেয়েছিলাম। তার মধ্যে একটি বাচ্চার নাম ছিল রাজ বিশ্বাস। ও কি দুষ্টু! খুব দুষ্টু ছিল ও। পড়াশোনা একেবারেই করতো না। খালি চিৎকার আর চ্যাঁচামেচি। এই মাঠটা তখন ছিলো আরেকটু বড়। খালি দৌড়ে দৌড়ে মাঠে পালাত আর একা একাই একবার এপ্রান্ত আরেকবার ওপ্রান্ত করে জালাতো। আর হ্যাঁ হাতে রঙ-পেন্সিল পেলে দেয়ালে, কাগজে ব্ল্যাকবোর্ডে খালি আঁকিবুঁকি আঁকত। একদিন করলো কি আমাকে ওয়াটার বোতলের জল দিয়ে আমার শাড়ি দিলো ভিজিয়ে। তখন আমার বয়সও কম ছাব্বিশ হবে, রক্ত গরম, ধরে বেত দিয়ে হাতে পিঠে পায়ে চপাচপ মারতে লাগলাম রেগে গিয়ে। তারপরই হঠাৎ কেমন যেন শান্ত হয়ে আসে। ছেলেটা কথা বলে না একা একাই থাকত। তারপর হঠাৎ একদিন শুনলাম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে হার্টে নাকি ফুটো ছিলো। শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়। তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম । দেখেই কান্না করে ফেলি সেদিন। ভগবানের কাছে হাজারবার ক্ষমা চাইছিলাম আর মনে মনে বলছিলাম ঠাকুর ওকে সুস্থ করে দাও ওকে আগের মতো করে দাও। তারপর একদিন আমি রঙ-তুলি নিয়ে যাই রাজের জন্য। খুব খুশি হয়। কিন্তু ভগবান আমাকে ক্ষমা করলো না, রাজ যাওয়ার আগে আমার জন্য এই ছবিটা এঁকে দিয়ে গেলো।’ বলতে বলতে মিস অহনা দাশগুপ্তের চোখে জল চলে আসে। ‘তোমরা জানো কুড়ি বছর ধরে এখনও এই রঙ-তুলির আঁকিবুঁকির কাছে এসে একবার ক্ষমা চেয়ে নিই।’ এক গ্লাস জল ছিল সামনে তা এক চুমুকেই শেষ করে দিলেন তিনি। সবাই নিরব হয়ে বসে আছে। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। ‘শোনো তোমরা তাহলে আজ এসো, পরে কিন্তু অবশ্যই সবাই মিলে আসবে। তোমরা জীবনে সফল হও এই আশীর্বাদ করি।’
একে একে সবাই বেরিয়ে পড়লো। রাস্তাতে এসে অনন্যা বলতে লাগল, ‘জানিস এই প্রিন্সিপালের কিন্তু ডিভোর্স হয়েছে।’ সবাই অবাক হয়ে বলে ওঠে, কী বলিস!
‘আমি বাবার কাছে শুনেছি। আসলে ওনার বাড়ি আমাদের ওখানেই তো। যখন ওনার বয়স উনিশ-কুড়ি হয়েছিলো তখন নাকি ওনার বাবা ওনাকে খুব বড়লোক ঘরের চাকরীওয়ালা পাত্র দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন। তিন বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও কোনও সন্তান হয়নি। শ্বাশুরির চাপে তখন হাসপাতালে গিয়ে চেকাপ করান। ইনফারটিলিটি ধরা পড়ে। অতএব আর চিকিৎসা না করে সোজা পাঠিয়ে দেয় বাপের বাড়ি। কিছুদিন পরেই ডিভোর্স! ব্যাস, তারপরেই এই স্কুল, আর বিয়ে করেন নি। শুনেছি এই স্কুল খোলার পর নাকি আরো কিছু সম্বন্ধ এসেছিল বিয়ের জন্য। কিন্তু তিনি আর রাজি হলেন না।’
এই গল্পটি শুনে রাজের ভানু পাগলির কথা মনে পরে যায়। তাহলে ভানু পাগলিরও এমন কিছু না তো?
‘চল, টা টা। আর হ্যাঁ এই শনিবার
আমাদের বাড়িতে বারের পুজো সেই সঙ্গে নারায়ণ পূজাও হবে সবাই চলে আসিস কিন্তু।’ বলেই
কৌশিক, রাজ এবং অনন্যা জিনিয়াদের বাড়িতে চলে আসে তাকে দেখতে। আসলে তিনদিন হলো জিনির
কোন খবর পায়নি রাজ। কী হলো, কেমন আছে! সুস্থ আছে কি না! নানা সব প্রশ্ন মাথার মধ্যে।
অনন্যা সবটা জানত কিন্তু জিনির কথা রাখার জন্যে রাজকে কিছু বলে নি। জিনিয়া অ্যাকসিডেন্টের পরের দিন হাসপাতালে চেকাপ করাতে গিয়ে এক্সরে করতে হয় পা। না, ভাঙ্গেনি তবে মচকে গিয়েছে, ক্র্যাপ ব্যান্ডেজ করে বসে আছে। তিনদিন হলো এই পায়ের জন্যে স্কুলে যেতে পারে নি জিনিয়া। আর তা দেখে খুব রাগ হয় রাজের ভানু পাগলীর ওপরে।
‘বস বস সবাই বস। কেমন হলো আজকে তোদের সার্ভে?’
‘এই তো নিবেদিতা স্কুলে গিয়েছিলাম। অনেক গল্প হলো মিস অহনা দাশগুপ্তের সঙ্গে। অনেককিছু জানা এবং শেখা হলো আজকে।’ বলে উঠলো অনন্যা।
রাজ জিনির কাছে এসে পা’টা ধরতে চেষ্টা করে। জিনি রাগ করেনা। জিনি যেন মনে মনে রাজকেই আগলে জড়িয়ে ধরতে চায়। রাজ তো কোন দোষ করে নি, কেন শুধু মিছে মিছে রাগ করে তিনদিন ওর সঙ্গে কথা বল্লো না। ছি! এ কী রকম আচরণ করল সে!
‘তোমরা সবাই বসো। এখানেই খেয়ে যাবে।’ জিনির মা এসে বলে।
‘না মাসিমা আজ না আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। সবাই বাড়ি ফিরবে। অন্য একদিন।’ বলে কৌশিক।
‘মাসিমা শনিবার কিন্তু আমাদের বাড়িতে আসতে হবে সেদিন বারের পুজো এবং নারায়ণ পুজো। অবশ্য বাবা আসবেন নেমন্তন্ন করতে। আমি আগের থেকেই বলে রাখলাম।’
‘আচ্ছা।’ বলে চলে গেলেন অন্য ঘরে জিনির মা।
কৌশিক অনন্যাও বাইরে বেরিয়ে গেলো রাজও বেরবে। রাজ জিনির কাছে এসে বসে এবং বলে, ‘তোকেও আসতে হবে।’ জিনির চোখ ছলছল করে ওঠে। জিনি রাজের হাতটা ধরে টান দেয় অমনি হঠাৎ পা পিছলে জিনির উপরেই পড়ে যায়। মাথাটা সোজা বুকের কাঁচা আপেল স্তনের উপরে। রাজের দেহটা গরম হইয়ে আসে। জিনি কোন প্রাতিবাদ করে না। রাজ আরেকটু চেষ্টা করে মাথাটা গুঁজে ঠোঁট দিয়ে দুটি লাল আপেলের মধ্যবর্তী সমতল পাদদেশ স্পর্শ করার। নাভি থেকে মাথা পর্যন্ত রক্তস্রোত বইতে শুরু করে দেয় জিনিয়ার। জিনি হাত দিয়ে রাজের মাথার চুল ঝাপটে চেপে ধরলে, নিশ্বাস গরম হয়ে সুতির কাপড় পেরিয়ে ত্বকের মধ্যে দিয়ে রক্তে প্রবেশ করে; প্রশ্বাস আটকে যায় উপত্যকার পাদদেশে। বিছানার উপরে রাখা বইটা উলটে গিয়ে নিচে পড়ে যায়। টিকটিকি শিকার ছেড়ে টিউবলাইটের নিচে চলে যায়। প্রজাপতিটা জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। যতটা দ্রুত সম্ভব রাজ নিজের চেতন ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
রাজ মাথা নিচু করে মুখ ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। জিনিও লজ্জায় লাল মুখটা বিছানার দিকে ফিরিয়ে রাখে।
‘আসি রে, শনিবার আসিস।’ রাজ বেরিয়ে পড়ে।
ছয়
দৃ ষ্টি
সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা করে রয়েছে। সূর্যের কোন খোঁজ খবর নেই। হাওয়াও বইছে না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ হয়েছে। ইতিমধ্যে বাড়িতে ত্রিপাল না টাঙালে ভেস্তে যাবে মায়ের হাতে লেপা শনি ঠাকুরের স্থানটি। সঙ্গে সঙ্গে রাজের বাবা রাজকে নিয়ে ত্রিপাল টাঙাতে টাঙাতে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে গেলো। সে কি বৃষ্টি! গাছের পাতাগুলো যেন শো শো আওয়াজ করছে তেমনি বাড়ির কদম গাছদুটি হেলে পড়ছে। ভিজে ভিজেই মাথার উপর ঝড় নিয়ে ত্রিপাল কোনরকমে টাঙ্গানো হলো। উঠোনকে বাঁচানো গেলো উঠোন বন্যা থেকে। সকাল সকাল স্নান সেরে পুজোর ফলমুল কাটতে শুরু করে দিয়েছে রাজের মা। তুমুল বৃষ্টিতেই পাড়ার দুজন কাকিমা সঙ্গে ভানু পাগলী এসে হাজির পুজোর অর্ঘ্য সাজিয়ে দেওয়ার জন্য এবং রাজের মায়ের সহায়তার জন্য তারাও উপোস রয়েছে। অন্যান্যদের থেকে নিয়মমাফিক ভানু পাগলী একটু বেশীই সেজেগুজে এসেছে। আর তাই দেখে রাজ বলে উঠলো, ‘মাসিমা আজ আমার বিয়ে না তো।’ বলে যেমন রাজ হো হো করে হেসে উঠলো তেমনি তিনচার গুণ বেশি হাসতে শুরু করলো ভানু পাগলী। হয় তো এই হাসির কারণেই বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্রদেব ভয়ে পালিয়ে যাবার উপক্রম করলেন। আধঘন্টার মধ্যেই আকাশ পরিষ্কার। গুমোট গরম আগের থেকেই ছিল।
ঘরে এবং বাইরে দুই স্থানেই সমান পাঁচ ফল সোয়া কেজি সিন্নি দিয়ে পুজো করবে এবারে। সবকিছু গোছাতে গোছাতে উঠনের বার ঠাকুরের স্থান এবং ঘরে নারায়ণ দেবতার স্থান সাজাতে সাজাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। আজ পুরোহিতের খুব তাড়া। শেষ শনিবার পাড়ায় পাড়ায় মোড়ে মোড়ে অনেক পুজো। পুরোহিতের মুখে বেশ বিরক্তির চিহ্ন দেখা যায়। অবশ্য এই বাড়ির পুজো দাক্ষিণ্য বেশ মিলবেই এই আশায় বিরক্তিটা মনে মনে পুষিয়ে নিতে লাগলেন। খুব বেশি বসে থাকতে হয়নি, তবে দিন হিসেবে বলাই যায় পনেরো মিনিট অনেকটা সময়। আর সময় নষ্ট না করে ঘরের নারায়ণ পুজায় বসলেন। শঙ্খ, উলুধ্বনি, প্রদীপ, ধুপ-ধুনোতে, ফল-সিন্নিতে ঘরের পুজো শেষ করে বাইরের উঠোনে যাচ্ছেন পুরোহিত। অমনি পুরোহিতের ধুতির কুচি খুলে যাওয়ার উপক্রম হতেই তা ঠিক করতে লাগলেন সেই দৃশ্য দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পরলেন ভানু আর তাতেই যারা বসেছিলেন তারাও হাসতে শুরু করলেন। ব্যাস তাতেই ক্ষেপে বসলেন সূর্য দেবতা। যার সকালের দিকে পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছিলো না সে এখন নিজের চাঁদপানা মুখখানা নিয়ে হাজির। আর কি তেজ সবার শরীর দিয়ে ঘাম বের করে দিলেন। যথারীতি উঠোনে বারের পুজো শেষ করলেন। আসলে পুরোহিতও এই ভানু পাগলীকে বেশি গুরুত্ব দেন না। নয় তো অন্য কেউ হলে, এই পুরোহিত আজকের ব্যাস্ততার দিনেও অভিশাপে ভস্মীভূত করে দেওয়ার প্রয়াস করতেন। সবাই প্রথমে ঘরের দেবতা নারায়ণ দেবের প্রসাদ খেয়ে উপোস ভঙ্গ করলেন, তারপর বার ঠাকুরের। বার ঠাকুরের প্রসাদ খেয়ে সোজা ঘরে ঢুকতে নেই এতে পরিবারের অমঙ্গল আর ঠিক তাই করতে যাচ্ছিলো ভানু। তাকে ধমক দিয়ে সবাই মিলে কুয়োর পাড়ে গিয়ে জল খেয়ে সারা শরীরে জল ছিটিয়ে নিলো।
বিকেল-সন্ধ্যায় সবাই প্রসাদ নিতে আসবে। খিচুড়ি আগেই বসিয়ে দিয়েছে রান্নার ঠাকুর। আলাদা করে সবজি তরকারী হবে না। সবজি দিয়েই খিচুড়ি হবে। আর এই ভার সম্পূর্ণ ন্যস্ত ছিল রাজের উপরে। নুন থেকে তেল, চাল থেকে ডাল, সবজি সবটাই বাজার রাজ আর কৌশিক মিলে করেছে।
সন্ধ্যা না হতেই পাড়ার লোক উপস্থিত হতে শুরু করেছে। রাজের মা ফল সিন্নি দিচ্ছে, রাজ আর কৌশিক খিচুড়ি। এরমধ্যে রাজের সব বন্ধু হাজির হলে, রাজের জিনির কথা মনে পড়ে। অমনি জিনিয়ার মা বাবা এবং জিনি এসে হাজির। জিনির এখনো পুরো সুস্থ হয়নি, ক্রেপ ব্যান্ডেজ করা পায়ে।
জিনিয়া আর রাজের বন্ধুরা রাজের ঘরে গিয়ে বসল। একদৃষ্টিতে জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ভানু। সে কী সব যেন একাই বিড়বিড় করে বলতে থাকে। রাজের মা ভানুর পাশে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কী সব বলছিস রে?’
‘ওই ছোকরিগুলান কারা? রাজের ঘরে ঢুকে গেলো।’
‘ও তো রাজের বন্ধু-বান্ধবী। তুই আমার সাথে এইদিকে আয়, ফলগুলো কেটে দিবি।’
ভানু ফল কাটতে গেলেও মনটা পড়ে রয়েছে রাজের ঘরে আর মস্তিস্কে চলছে ওই দুধ-গোলাপি রঙের মেয়েটা।
সন্ধ্যা অনেকটাই পার হয়ে যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া হয় না রাজের। এমনকি রাজের মাও বেশি কথা বলতে পারছেনা আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে। সব আত্মীয় পরিজন বন্ধু প্রতিবেশীদের প্রসাদ বিতরণ করছে এই চারজন। জিনিয়ার মা বাবাও প্রসাদ খেয়ে ওঠে। দুরের বন্ধুরা প্রসাদ খেয়ে সামান্য কথোপকথন করে চলে যায়। জিনি বাইরে এসে বসলে রাজ কাছে গিয়ে চেয়ার নিয়ে বসে। প্রসাদ বিতরণের দায়িত্ব নিয়ে নেয় পাড়ার বন্ধুরা।
এই বিষয়টি ভানু পাগলীর ভালো ঠেকছে না। আত্মায় কোথায় যেন যুদ্ধ চলছে। অধিকার বোধ যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ছল ছল হয়ে আসে ভানুর চোখ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একাই হঠাৎ চিৎকার শুরু করে দেয়, ‘আমি আর থাকবো না, আমি আর থাকবো না ... চললাম। তোদের বাড়ির পুজো --- আমি এখানে গা-গতরে খেটে মরি। কেন যে আমি এলাম ...।’
জিনিয়ার বুঝতে অসুবিধা হয় না ইনিই যে ভানু পাগলী।
‘কি মাসিমা বাড়ি যাবে তো যাও অমন চেঁচামেচি কেন করছ?’ বিরক্ত হয়ে রাজ বলে উঠলো। এমনিতেই জিনির এই অবস্থার জন্য ভানুকে দায়ী মনে করে রাজ।
‘কেন যাবো আমি? কেন যাবো! তোর বাড়ি আসছি নাকি? আমি আমার বোনের বাড়ি আসছি।’
পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আসলে অস্বাভাবিক কখনই হয়নি। ভানুর এই আচরণের সাথে সবাই পরিচিত। শুধু রাগ করে জিনি রাজের উপর ।
জিনিয়ার মা-বাবা রাজের বাবার সাথে এতক্ষণ ঘরে বসে গল্প করলেন, এখন তারা বাড়ি ফিরবেন।
‘চল মা। বাড়ি ফিরতে হবে। আমরা আসি বৌদি দাদাকে বলে বেরোলাম । রাজ আমরা আসি।’
‘আচ্ছা আবার আসবেন, আজকে একদম সময় দিতে পারলাম না দেখতেই তো পাচ্ছেন। মা জিনি আবার আসিস সময় করে।’
ভানু মনে মনে বলে উঠে, ‘মা জিনি না ছাই।’
রাজ রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে।
রাত অনেকটা হয়ে এলো বাড়ি প্রায় ফাঁকা এবারে শনি ঠাকুরের থানটি তুলে নিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে আসতে হবে। রাজ জামা কাপড় খুলে নতুন গামছা পড়ে তুলে নেয় শনি ঠাকুরের থান। রাজের সঙ্গে নদী পর্যন্ত যায় কৌশিক। রাজ বুড়ি-বালাসনকে সামনে পেয়ে মাথা পেতে শুয়ে পড়তে চায়। হাঁটু জলেই বারবার ডুব দিয়ে স্নান করতে লাগলো রাতের বেলাতেই। কৌশিকের বকাঝকাতে বুড়ি বালাসনকে ছেড়ে বাড়িতে ফিরে আসতে হলো। কুয়োর জলে আবার স্নান সেরে ঘরে ঢুকল। সবাই ক্লান্ত, কোনরকম গুছিয়ে গাছিয়ে অল্প অল্প খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
আজকে রাজের মা ভানুকে আর বাড়ি ফিরতে দেয়নি। আজ রাজদের বাড়িতেই থাকবে ভানু। প্রচুর গরম পড়েছে। তার মধ্যে সারাদিন খাটুনির পর ধকল যেমন রাজের মায়ের উপর দিয়ে গিয়েছে তেমনি রাজের উপর দিয়েও গিয়েছে। এমনিতে ভাদ্র মাসের গরম। তারপর গুমোট আবহাওয়া। রাজ জামা খুলে খালি গায়ে শুয়ে পড়েছে। ফ্যান চালিয়ে লাইট জ্বালানো দরজা খোলা, মা পড়ে বন্ধ করে দেবে।
‘যা তো ভানু ওই ঘরের দরজাটা আর লাইটটা বন্ধ করে দিয়ে আয়।’
ঘরের ফ্যান চলছে তবুও রাজের বাদামী রঙের পিঠ দিয়ে ঘাম বিন্দু বিন্দু করে বেরিয়ে আসছে। পাশ ফিরে শুয়ে রয়েছে, উল্টো দিকে ভানু বসে পড়লো রাজের পিঠের ঘামের বিন্দু দেখতে দেখতে। ঘাম তো যেন নয় যেন পিঠের মধ্যে সোনালী রঙের মুক্তো। আহা কি সুন্দর ! আহা কি লোভনীয়! মনে হয় পাশে গিয়ে একটু ঘুমোই, আর ওই সোনালী মুক্তোগুলো সর্বাঙ্গে মেখে নিই। পায়ের লোম, হাতের লোম, লম্বা লম্বা চুল শুধু আমার শুধুই আমার। মনে হয় পায়ের সামনে গিয়ে বসি, কি চওড়া বুক, বুকের লোম, পেট, নাভি, নাভির নিচে লোম এ যেন এক গভীর অরণ্য স্রোত। আহা শুকনো ঠোঁট কবে থেকে যেন তৃষ্ণায় পথিক হয়ে বেড়াচ্ছে এখন শুধু অমৃত পানের অপেক্ষায়। টিউব লাইটের নিচে থাকা টিকটিকিটি এবারে খপ করে ধরেই ফেলেছে ফড়িং; পাখনা দুটো ফেলে দিয়ে মাংস গিলছে শুধুই মাংস গিলছে। দাঁত কিটকিট করে উঠে ভানু। দাঁতের কিটকিট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় রাজের।
রাজ ভানুর দৃষ্টি দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারে এ দৃষ্টি সাধারণ দৃষ্টি নয়। এ যেন সেই আদিম কালের পিপাসার্ত শেয়ালের কামুক দৃষ্টি, সেই জোঁকের দৃষ্টি, সেই গিরগিটির দৃষ্টি, সেই কদর্য দৃষ্টি দূর থেকেই তার রক্ত শুষে নিচ্ছে, তার মাংস গিলে নিচ্ছে।
রাজ কিছুটা ভীত হয়ে কিংবা আগের মনের মধ্যে পুষে রাখা রাগ থেকেই হয়তো ধমকের সুরে চিৎকার করে উঠলো, ‘কি মাসি, তুমি এখানে বসে? এখান থেকে গেলে! তখন থেকে আমাকে চোখ দিয়ে শুষে যাচ্ছো! ছিঃ মাসি ছিঃ! তোমার লজ্জা করে না আমি তোমার ছেলের মতন!’
সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এলো রাজের ম। ‘বাবা কী হয়েছে, কী হয়েছে?’
ভানুর কানে সেই এক শব্দ বাজছে --- আমি তোমার ছেলের মতন। ছেলের মতন! ছেলে! সত্যি ছেলে?
আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা শুরু করে দিয়েছে। সে আর আজ এখানে থাকবে না। রাজের মা’র নিষেধ সত্যেও এই অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লো। কারোর কোন কথা কর্ণপাত করল বলে মনে হয় না। তবুও রাজের মাকে কথা দিতে বাধ্য হল যে সে আজ বাড়ি ফিরবে অন্য কোথাও যাবে না।
রাজ তার মাকে সমস্ত ব্যাপারটা বললে। রাজের মা সবটা শুনে ভালো করে রাজকে বোঝালো, আসলে ওর দোষ নয়। ওর খারাপ মানসিক অবস্থার জন্যই এই আচরণ। এইবারে রাজ মনে মনে ভাবতে লাগলো যে তার নিজের তরফ থেকেও বেশি খারাপ ব্যাবহার হয়ে গেল না। সে তো সুস্থ, সে তো ভালো করে কথা বলতে পারতই, তবে সুস্থ আচরণ কেন করলো না।
‘আচ্ছা মা তুমি তো ভানু মাসিকে ছোটো থেকেই চেনো জানো। ওর কী হয়েছিল যে এই রকম হয়ে হয়ে গেল?’
‘ও অনেক বড় গল্প অনেক সময় লাগবে। বলতে গেলে একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। পরে শুনিস। পরে বলবো কোন একদিন।’
‘না মা এক্ষুনি বলতে হবে, আজই বলতে হবে। আমি সবটা শুনব।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা তাহলে বলছি মন দিয়ে সবটা শুনিস।’
‘আচ্ছা…’
সাত
পূ র্ব স্মৃ তি
প্রায় আটত্রিশ বছর আগে হবে। সেই বছর ফাঁসিদেওয়া মহানন্দা নদীর ধার দিয়ে প্রচুর ধান হয়েছিলো। বাড়ির মুরগিগুলো ধানক্ষেতে আর হাঁসগুলো ডোবাতে নেমে যেত সারি সারি। চড়ুই বুলবুলির খুব উৎপাত ছিলো। আমরা অনেকজন বন্ধু ছিলাম। বাবার সঙ্গে ক্ষেতে যেতাম আর বাকি সময় মাঠে কাটাতাম। সেই সময় একদিন রাতে বাবার কাছে শুনি আসামের দাঙ্গার কথা। অনেকের বাড়ি নাকি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। বাবার মুখেই শুনে ছিলাম নিশিকান্তদের বাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়েছিলো। বাসন-কোসন চুরি হয়েছিলো। কাগজপত্র কিছুই নেই। সেদিন তারা গোয়াল ঘরের পেছনে লুকিয়ে ছিলো। পরের দিন যা কিছু সম্বল বলতে ছিল শুধু পরিবার। গোটা পরিবার নিয়ে পালিয়ে এলেন আমাদের গ্রামে।
গল্পটা খুব বিস্ময়ের মুখে অবাক হয়ে হয়ে বড় বড় চোখ করে আবার কখন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে রাজের মা সম্পূর্ণটা শুনেছিল তার বাবার কাছে। নিশিকান্তের পরিবারে নিশিকান্তের স্ত্রী দুই ছেলে এবং একটি মেয়ে রয়েছে। মেয়েটির নাকি আট বছর বয়স ছিল। আর সারারাত ওই অসহায় পরিবারের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে কিছুই জানতে পারে না।
তার জানাই হয় নি এইরকম একটা পরিবার কোথায় এসে উঠেছে। পরের দিন সকালে উঠেই বাবাকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে তাদের যেখানে জমি শেষ বাঁশ বাগানটি শুরু হয়েছে রেল লাইন দেখা যায় ওখানে তারা রয়েছেন।
তাদেরকে স্থানীয় পঞ্চায়েত ভোটার কার্ড বানিয়ে দিবেন। তাতে কারুর কোন অসুবিধা নেই। থাকবারও কথা নয়। কারণ ফাঁকা গ্রামে একটি পরিবার বাড়লে যোগাযোগ এবং চাষবাসেও সুবিধা। তাছাড়া দুটো লোকও প্রয়োজন কথা বলার জন্যে। তাই সেইসময় কোন আপত্তির সৃষ্টি হয়নি।
ঘুম থেকে উঠেই জানতে পেরে দৌড়ে গিয়েছিলো সেই পরিবারকে দেখতে। বাচ্চা ফুটফুটে নোংরা ফ্রক পরনে খালি পায়ে মেয়েটিকে দেখে করুনা হয়েছিল রাজের মা’র। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে তোর নাম কী দিদি? ভানুমতী? চল আমাদের সঙ্গে খেলবি। মেয়েটি বাবার দিকে তাকালে চোখের ইশারাতেই সেই যে খেলতে বেরোল তখন থেকেই রাজের মা অনিমা-এর সঙ্গে ভানুমতীর তৈরি হলো খুব গাঢ় বন্ধুত্ব।
আর এদিকে নিশিকান্ত সপ্তাহে দু-তিনদিন মৌজাতে যেতে লাগলেন, স্থানীয় পঞ্চায়েতের বাড়িতে প্রায় প্রতিরাতে যেতে শুরু করলেন একটা সুব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্যে। তাতে গ্রামের পঞ্চায়েত অমল সিং, প্রধান সঞ্জয় সমাদ্দার, অনিমার বাবা, নিশিকান্ত সহ তার দুই ছেলে এবং সকলে মিলে মিটিং বসলো। সবটাই বিস্তারিত জানার পর প্রধান, পঞ্চায়েত গ্রামের লোকেদের সহমতে অঞ্চলেরই বাঁশবাগানের সামনেই বসবাস যোগ্য আট কাঠা জমি দিলেন। আর ভোটার কার্ড পরে তৈরি করে দিবেন বলেছেন। আর কাজের জন্যে ঠিক করে দিলেন অনিমার বাবার পাশের জমি সেখানে সে ভাগচাষী হিসেবে চাষ করবে। একটা নিশ্চিন্তের চোখ নিয়ে সেদিন নিশিকান্ত বাড়ি ফিরলেন।
অনিমা রোজ স্কুলে যেত না। বেশিরভাগ সময়েই মাঠে ঘাটে বনে ঘুরতো এবারে নতুন সঙ্গী ভানুমতী। সব বন্ধুরা তাকে ভানু বলেই ডাকতো। বাঁশবাগানের পেছনে ছিলো রেললাইন। তার সব বন্ধুরা মিলে বাঁশ বাগানের মধ্যে দিয়ে রেলগাড়ি দেখতে ছুটত। বিকেল হলেই মাঠে ডাং-গুলি, মার্বেল,দারিয়াবান্ধা এইসব খেলা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। ভানুমতী ধীরে ধীরে তাদের একজন এবং এই গ্রামের মেয়ে হয়ে উঠলো।
ভানুমতী ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে ধানক্ষেতের কুয়াশা মোড়া সরু আল পথ দিয়ে অনিমাকে ডেকে আনে ফুল তুলবে বলে। অনিমা গরম উলের সোয়েটার পড়ে বেরোলেও ভানু সেই পুরনো পাতলা ফ্রকটাই পড়ে বেড়িয়েছে। দুই বন্ধু মিলে গল্প করতে করতে মাঠের ধার দিয়ে রাস্তার পাশে থেকে অনেক সাদা ফুলের সঙ্গে সঙ্গে জবা, হিজল ফুল তুলে ফ্রকের মধ্যে রাখে। সূর্য যখন আলো দিতে শুরু করলেন ততক্ষণে দুজনে বাড়ি ফিরে আসে।
কথামতো সকাল সকাল খাওয়া দাওয়া করে ভানু ছুটে আসে অনিমাদের বাড়ির পেছনে গোয়ালঘরের পাশে যেখানে তারা রোজ রান্নাবাটি, মুদি, পুতুল বিয়ে খেলা খেলে। খেলতে খেলতে সূর্য একসময়ে পশ্চিমে হেলতে শুরু করে তারপর আর এই খেলা খুব একটা ভালো লাগে না। দুজনেই বেরিয়ে পড়ে জলাপাই কুড়োতে। পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারে জলপাই গাছে। তারপর কামরাঙা। ভানু অনায়সেই উঠে যায় কামরাঙা গাছে। একে একে কামরাঙা তুলে নিচে ফেলে ভানু আর অনিমা তা তুলে নিয়ে একস্থানে জড়ো করে। টক কামরাঙা মুখে দিতে দিতে দুজনের মুখ ভ্যাচকে যায় তবুও কামরাঙা ফেলে না। ওগুলোই দাঁত দিয়ে কাটতে কাটতে দুজনেই অনিমাদের বাড়ি ফিরে আসে। তারপর জলপাই বের করে মোটা গরুর লবণ আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মেখে খাওয়া শুরু করে। সন্ধ্যা হলেও ভানুর মন বাড়ি ফিরতে চায়না, তবুও তাকে অনিচ্ছাসত্বেও বাড়ি ফিরতে হয়।
বাড়িতেও তেমন বকা ঝকা করেনা ভানুকে। বরং ভানু বাড়িতে না থাকলেই যেন ভানুর মায়ের নিশ্চিন্ত যে, মেয়েটা অনিমাদের বাড়িতে আছে। সেই ফাঁকে বাড়ির সমস্ত কাজ করে স্বামীর খাওয়া তৈরি করে স্বামীর সঙ্গে মাঠে গিয়ে চাষের কাজে হাত লাগানো যায়। রাতে সবাই খেতে বসলে ভানুর আর খেতে ইচ্ছে করে না। তার দাঁত টক হয়ে রয়েছে। তাই সে খাবে না। দাদারা খেতে বসলে ভানু বলতে শুরু করে, ‘জানিস দাদা, অনিমাদের বাড়িতে কত খেলনা মাটির হাড়ি, কড়াই উনুন, পুতুল আরও কত কিছু, আরও অনেক অনেক ...।’ এক মনেই ভানু বলে চলে। রাতে মায়ের সঙ্গে ঘুমোতে গেলে ভানু মা’কে বলতে শুরু করে, ‘জনো মা আজকে আমি কামরাঙা খেয়েছি, জলপাই মেখে খেয়েছি। জানো তো মা অনিমার কী সুন্দর খেলার পুতুল রয়েছে। আমাকে এনে দিবে?’ মা কিছুই বলছে না দেখে বিরক্ত হলেও আবার জিজ্ঞেস করে, ‘মা এনে দেবে বলো না?’
‘আচ্ছা...।’ এবারে ঘুমিয়ে পড়ে ভানুমতী।
আবার সকালে বেরিয়ে পড়ে অনিমাদের বাড়িতে। অনিমাকে খুব আনন্দের সঙ্গে জানায় এবারে তাকে তার বাবা একটা পুতুল এনে দেবে। রান্নাবাটি খেলতে খেলতে প্রতিদিন তার বন্ধুদের বলে যে তার বাবা তাকে একটা পুতুল কিনে দেবে। প্রতিদিন বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে এক আবদার এবং সকালে বাবার সামনে মৌন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বিকেলে বন্ধুদের কাছে তাকে মিথ্যেবাদী সাজতে হয়। এই খেলা তার আর কিছুতেই ভালো লাগছিলো না। এই মিথ্যেবাদী সাজাটা তার কাছে ভীষণ রকমের অপমানকর।
একদিন রান্না বাটি খেলতে খেলতে চুপ করে একটি পুতুল বাড়িতে নিয়ে চলে আসে। রাতে সেই পুতুল নিয়ে একা একা খেলতে শুরু করলে বিষয়টি চোখে পড়ে ছোড়দা মহেনের। মহেন সঙ্গে সঙ্গে বোনকে শাসাতে শুরু করে এবং কৈফিয়ৎ চায় কেন পুতুল চুরি করেছে। বোন প্রতিবাদ করলে বরদা অতিন এসে চড় মারলো কষিয়ে দুটো। পরের দিন ফিরিয়ে দিতে বলল। বাবা বুঝিয়েছে ‘নয় তো সবাই তাকে চোর বলবে’। ভানু কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরেরদিন ভোর হতেই ভানু পুতুলটি নিয়ে বাঁশবাগানের পেছনে রেললাইনের উপরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বাড়ি ফিরে আসে ভানু। আজ অনিমাদের বাড়ি ভানু যায়না। যদি কেউ চোর বলে এই কথাই মনের মধ্যে খালি ঢেউ তুলে যাচ্ছে। একদিন যায় দুদিন যায় ভানু তবুও অনিমাদের বাড়িতে যায় না। এভাবে চারদিন পর অনিমা ভোরবেলা ভানুদের বাড়িতে আসে। ফুল তুলতে যাওয়ার জন্যে অনিমা ডাকে। প্রথমে ইচ্ছে করে কোন সাড়া দেয়নি ভানু। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ভানুর মা ভানুকে ডেকে দেয়। চোখ কচলাতে কচলাতে অনিমার মুখোমুখি হয়, বুক ভীষণ রকম কাঁপছিল। এই বুঝি চোর বলবে। চোর, ভানু চোর! সে হয় তো চোর হয়ে যাবে। কিন্তু কই অনিমাতো সেই রকম কিছুই বলল না। অনিমা কি সুন্দর হাত ধরে টেনে অভিযোগের সুরে বলতে লাগলো ‘তুই এতো দিন খেলতে এলি না কেন। আমরা বিকেলে পথ চেয়ে বসে থাকতাম এই বুঝি তুই আসবি এই বুঝি এসে পড়লি। কিন্তু না তুই এলি না। চল এখন ফুল তুলতে যাবো।’ অনিমার স্বাভাবিক ব্যবহারে ভানু সব এক নিমেষে ভুলে গেলো। দুজনেই বেরিয়ে পড়লো কুয়াশা মোড়া ধানক্ষেতের আল পথ দিয়ে। সবে মাত্র কাক ক্যা ক্যা করতে শুরু করেছে।
ঘড়ির কাঁটা দুটো বেজে দশ মিনিট।
‘অনেক রাত হল এবারে ঘুমিয়ে পড়। আমার ভীষণ ঘুম পেয়েছে, ভীষণ ক্লান্তি লাগছে।’
‘আচ্ছা মা বাকি কাল সকালে শুনবো।’
মেঘলা আকাশ, ফুরফুরে হাওয়া রাজকে যেন আরেকটু অলস করে তোলে। বিছানাও রাজকে আঁকড়ে রাখতে চায়। কিন্তু না গল্পটা সবটা শুনতে হবে রাজকে। দুটো চড়ুই সেই কখন থেকে চালের উপরে এসে কিচিরমিচির করে যাচ্ছে তবুও আজ রাজের রাগ হচ্ছে না। মনে মনে ভাবে চড়ুই দুটি তাদের অনেকদিনের না বলা কথা আজ এক মুহূর্তে এক নিমেষে সব উগরে দিচ্ছে, মিটিয়ে নিচ্ছে মনের ঝাল। আজ বাড়িতেই থাকবে রাজ তেমন কোন কাজ নেই, পুজোর পরের দিন যেটুকু কাজ সেইটুকুই, তবে সেই কাজ রাজের বাবাই সবটা করে থাকে। মা সকাল সকাল উঠে পড়েছে। বাড়ির অনেক কাজ। বিছানা থেকে উঠে মায়ের ব্যস্ততা দেখে আর জিজ্ঞেস করল না। নিজেই ঠিক করে নিল যে পরে ফাঁকা সময়ে মন দিয়ে শুনবে। চা খেয়ে বেরিয়ে গেলো বুড়ি বালাসনের কাছে। আহা কত প্রিয় এই বুড়ি বালাসন ঘাট। আর উত্তর দিকে সেই শ্মশান। শ্মশানে কার দাহ হচ্ছে জানে না রাজ। তবে বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে থাকে আগুনের ফুলকির দিকে। আর চুপটি করে মনোযোগ দিয়ে শোনে কাঠ ফাটার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে হরিবোল কণ্ঠস্বর। কত অভিযোগ, কত দুঃখ, কত না বলা কথা সব স্পষ্ট শুনতে পায় কাঠ ফাটার আওয়াজে, রাজ এবং এই বুড়ি বালাসন। এরপর হাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে একের পর এক সুখটান দেয়। আর মনে মনে বলে- ‘হে ঈশ্বর না জানি ওই ব্যক্তি কত পাপ করেছে, ওকে আজ আগুনে পুড়তে হচ্ছে। আপনি ওর সকল পাপ ক্ষমা করুন।’ বুড়ি বালাসন অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছে সমস্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া অস্থি ভস্মকে। তাইতো শীর্ণ হয়ে এলেও আজও সে নিজের মতোই নিজের বেগে বয়ে চলেছে গন্তব্যের লক্ষ্যে। রাজ জানতে চায় কত বছর থেকে এভাবেই ক্ষমা করে আসছে বুড়ি বালাসন। মানুষ জন্মের পর থেকেই নিজের পাপের ঘড়া ধীরে ধীরে পূর্ণ করতে থাকে, তাই হয় তো যখন পূর্ণ হয়ে যায় তখন শেষে সবটা ওই আগুনে চুকিয়ে দিয়ে যান নীরবে। ‘হে ঈশ্বর ওদের ক্ষমা করুন। ওদের মুক্তি দিন।’ রাজের চোখ লাল হয়ে আসে, চিতার বিপরীত ঘাটে বসেই মানুষের ইতিহাস বিলীন হতে দেখে। সে দেখতে থাকে কি করে মানুষ ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যায়। চোখের জল যেন ওই আগুনের ফুলকির জন্যই শুকিয়ে যায়। আর এই বুড়ি বালাসনও যেন ক্ষমা করতে করতে নিজের গর্ভ থেকে জল শুকিয়ে ফেলছেন। রাজ মনে মনে দুঃখ করে তার এই শৈশবের বন্ধু বুড়ি বালাসন নিজের মহিমা থেকে রোজ একটু একটু করে চ্যুত হয়ে পড়ছে। আরও ভাবে যে শেষে স্বার্থপর হয়ে যাবে নাতো তার প্রিয় নদী। রাজ জানে কিছুতেই এই নদী স্বার্থপর হতে পারবে না কারণ তার মজ্জায় মজ্জায় রয়েছে অদ্ভুত ক্ষমা প্রদানের শক্তি। ক্ষমা করতে করতে আজ সে শীর্ণ বিশীর্ণ অসুস্থ তবুও সে নিজ বেগে চলতে চায়। রাজের তিন তিনটে সিগারেট শেষ হয়ে আসে। সূর্য মাথার উপরে চলে আসে। হঠাৎ তার মনে পড়ে ভানুমতীর গল্পটা। ভানুমতী তবে এখানকার নয়। আসামের। তবে আসামের কথা কি কিছু মনে আছে তার। ও তো ছোটো থেকে বড় এখানেই হয়েছে। ওদিকে চিতাটা নিভু নিভু করছে। রাজের মুখটাও শুকিয়ে যায়। বাড়ি ফিরতে হবে। একাই এসেছিলো একাই ফিরে গেলো।
বাড়ি ফিরে স্নান সেরে খেতে খেতে শ্মশানের চিত্রটা মা’কে শোনালো। তারপর মায়ের কাছে ভানুমতীর পরের গল্প শুনতে চায় রাজ।
পরের বছর অনিমা ক্লাস টুতে আর ভানুকে ভানুর বাবা ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করিয়ে দিলেন। প্রথম প্রথম ভানু ভীষণ ভীত, না জানি স্কুল কিরকম হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে বন্ধু অনিমার খাতিরে মনের ভয়টা কেটে গেছে। দুজন ভিন্ন ক্লাসে পড়লেও একই ক্লাসে বসত। তাতে কারোর আপত্তি যেমন ছিলো না শিক্ষকেরও তেমন ছিল না। এদিকে ভানুমতী কিছুটা ছাড় পেলেও ছাড় পায়নি বিদ্যালয়ের কঠিন নিয়ম থেকে। পড়া না করাতে একদিন কি বেতের মারটাই না খেল। এরপর বেশ কিছুদিন সে স্কুল মুখো হয় নি। তবে তার স্কুলের জলপাই গাছটি ছিল ভীষণ প্রিয়। তাই তো আবার ফিরে আসে শুধুমাত্র জলপাই গাছের জন্য। অন্যান্য ছেলেদের মতোই সে উঠে যেত জলপাই গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটিতে এবং পা দিয়ে ঝাঁকি দিতো পাতলা ডালগুলোতে। বন্ধুরা জলপাই কুড়োত গাছের নিচে দাঁড়িয়ে। এই পটুত্বের জন্যই বন্ধু মহলে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো গেছো ভানু নামে। শিক্ষকরাও গেছো ভানু বলে ডাকতে শুরু করলো।
একদিন একটি খুব মজার ঘটনা ঘটে গেলো, বলছি শোনো। তখন স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। আমি আর ভানু মাঠেই ছিলাম। শিক্ষকরা যাবেন আর তারপর তারা দুজনে জলপাই পেড়ে বাড়ি নিয়ে আসবে। সন্ধ্যা হয় হয়। মাঠে খেলতে খেলতে সূর্য ডুববে ডুববে করছে। বাড়ি ফিরতে হবে। তবু জলপাই পাড়তেই হবে। অমাবস্যার সন্ধ্যা ছিলো। খুব তাড়াতাড়ি যেন অন্ধকার হয়ে গেলো সূর্য ডুবতেই। এদিকে জলপাই গাছে উঠেছে ভানু আর নিচে দাঁড়িয়ে অনিমা। ভানু গাছের মোটা ডালটি শক্ত করে ধরে পাতলা ডালটিকে পা দিয়ে ঝাঁকি দিতেই পাতাগুলো ঝপ ঝপ করে আওয়াজ করে উঠলো। তখনি একজন মহিলা পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন আওয়াজের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো গাছের মধ্যে একটা কালো ছায়া পা কিছুক্ষণ বাদেই আবার গাছে ক্যা ক্যা আওয়াজ করে কিছু বাদুর উড়ে গেলে গাছের নীচে কুকুরের জ্বলজ্বল করা চোখ দেখে আর আচমকা একটা হাওয়া বয়ে গেলে ভুত বলে চিৎকার করে মহিলাটা বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে অনিমা কাছে দৌড়ে আসে সেইসঙ্গে রাস্তার দুজন লোকেও কাছে আসে। লোকদুটি স্কুলের কল থেকে জল এনে মহিলাটার চোখে মুখে দিতেই হুঁশ ফিরে আসে। আর ভানু এইসব হওয়ার আগেই সেই মহিলার চিৎকারে সোজা লম্ফঝম্ফ করে উধাও হয়ে গিয়েছিলো কিছু বুঝবার আগেই।
তারা মহিলাটার কাছে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করলে আঙ্গুল দিয়ে গাছটির দিকে উদ্দেশ্য করে বলে ‘পেত্নী দেখলাম গো!’ কুকুরটা সামনে এসে ঘেউ ঘেউ করতে লাগছিলো আর ওর চোখটা বাল্বের মতো জ্বলছিলো। সবাই গাছের দিকে তাকায়, গাছে কিছু নেই। অনিমা এখন এখানে কী করে জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। ভানুর কথা চেপে যায়। অনিমাকে তারাই বাড়ি দিয়ে আসেন।
অনিমার রাতে কিছুতেই ঘুম আসে না এদিকে ভানুটা বাড়ি ফিরলো কি না সে কিছুই জানেনা। কখনও পেঁচার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায়, কখনও বাদুরের পাখনার ঝাপটায় সেই আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায়। কুকুরের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় এইভাবে যে কখন সে ঘুমিয়ে পড়ে সে নিজেও জানে না। পরেরদিনই তার জ্বর চলে আসে। ভানু সকালে ফুল তুলতে আসলে জানতে পারে যে অনিমার জ্বর হয়েছে। অনিমার মা অনিমাকে জলপট্টি দেয় আর ভানু পাশে বসে থাকে। ভানু অনিমাকে জলপাই দিতে চায় কিন্তু অনিমা খায় না। হঠাৎ অনিমা ঘুমিয়ে পড়লেও সারাটাদিন ভানু অনিমার পাশেই বসে থাকে। সন্ধ্যাবেলায় ভানু মনে মনে এবং মুখে নিম্নস্বরে কি যেন বিড়বিড় করতে করতে বাড়ি ফিরে গেলো। আর অদ্ভুত ভাবেই পরেরদিন ভানুরও জ্বর চলে আসলো।
জলপট্টিতে অনিমার জ্বর কমলেও ভানুর জ্বর কিছুতেই কমছিলো না। একদিন-দুদিন-তিনদিন পার হয়ে যাওয়াতে নিশিকান্ত ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার কিছু ওষুধপত্র দিয়ে আর ফলমূল খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে খালি পায়েও ঘুরতে বারণ করলেন। আর এভাবেই ভানু এক সপ্তাহের মাথায় সুস্থ হয়ে উঠলো।
বিদ্যালয়ে ততদিনে বেশ রটে যায় যে এ হলো ভূতুড়ে জলপাই গাছ। শিক্ষকদের অনুমতি ছাড়াই গ্রামের লোকেরা তান্ত্রিক এনে শুরু করলো তন্ত্রমন্ত্র, যজ্ঞ। দুদিন ধরে ঝাড়ফুঁক চলার পর শেষে ঠিক হলো গাছটি কেটে ফেলত হবে। অবশেষে দয়া-দাক্ষিণ্যে বিদায় যেমন জানানো হলো তান্ত্রিককে তেমনি বিদায় জানানো হলো জলপাই গাছটিকে।
আর এভাবেই আসল গল্প চিরদিনের জন্য গোপন রয়ে গেলো ভানু আর অনিমার মধ্যে।
আট
উ ৎ স ব
তখন আমি সবে মাত্র ফাঁসিদেওয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে উঠলাম। জ্যৈষ্ঠ মাস। এখন একটু বেশি গরম। বেশি গরম তখন থাকলেও ছিল গাছের ছায়া আর বেশ ছিলো মন জুড়ান বাতাস। তুই তো জানিস তোর মামার বাড়ি ওখানে কত বড়ো মেলা হয় কালীপূজায়। তখন কি মজাটাই না করতাম।
খুব জাগ্রত এই দশহাত যুক্ত মহাকালী। দশ হাতে বিরাজ করে খড়গ, চক্র, গদা, ধনুক, বাণ, পরিখ, শূল, ভুমন্ডি, নরমুন্ডি এবং শঙ্খ। এই পুজোটি শুরু হয়েছিলো প্রায় দুশো বছর আগে। সেখানকার জমিদার চালু করেছিলো পুজো। মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে যে তৎকালীন জমিদারের পুত্র কোন তান্ত্রিকের নিকট অভিশপ্ত হলে তা থেকে নিস্তারের উপায় হিসেবে জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যাতে তিথি ধরে পুজার প্রচলন শুরু হয়। তবে থেকেই বর্তমান পর্যন্ত চলছে ধুমধাম করে মহাকালীর পুজো।
সেইবারও বেশ ধুমধাম করে পুজার আয়োজন শুরু হয়েছিল। যার যার মানত রয়েছে তারা কেউ কেউ দিবে পাঁঠা বলি, কবুতরের চক্ষু দান, কবুতর ছাড়া, আরও কত কি। আর আশেপাশের গ্রাম থেকে প্রচুর লোকও আসতো, বেশ জমজমাট ছিলো।
অনিমা, ভানুমতীসহ সব বন্ধুরা সকাল থেকেই মেলার মাঠ আর মন্দির; মন্দির আর মেলার মাঠ। সকালে খালি একবার একটু খেয়ে বেড়িয়েছে আর বাড়ি ফেরার কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছে না তারা। আজ তারাও যেন এই মহাযজ্ঞের প্রধান কর্ম কর্তা। পুজো হবে রাতে তবু তারা সকাল থেকেই পড়ে রয়েছে মন্দিরে। আসলে পুজো রাতে হলেও সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বালানোর আগে যে সলতে পাকানোর যে মাধুর্য এবং নিশ্চিন্তের সুখ তারাও হাতছাড়া করতে চায় না। কাছেই ঘেঁষে সবকিছুর সাক্ষ্মী থাকতে চায় তারা। কিছু ধরতে না পারলেও এর ওর ফরমাশে সবটাই করে দেয় এক দৌড়ে।
বিকেলে তারা বাড়ি ফিরে আসে আবার সন্ধ্যার পরেই আবার মেলায় যেতে হবে। বাড়ি ফিরে একে একে সব আশ্চর্য কল্পনা রাজ্যের গল্প শুরু করে দেয় যে যার বাড়িতে। সবটা সবাই শোনেনা স্বাভাবিক কারণেই। ছোটদের এইসব আজগুবি কথায় কে-ই বা কান দিবে।
পুজো হবে রাত বারোটায়। যার প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। মহাভোগ থেকে শুরু করে ফলমূল-বেলপাতা, কাঁসর-ঘণ্টা জমজমাট। সেখান উপস্থিত রয়েছে অনিমার বাবা, মা, নিশিকান্ত এবং তার স্ত্রী আরও পাড়ার অনেকেই। তাই ভানুদের বাড়ি ফেরার কোনো প্রশ্নই উঠে না আর। এবার নিশিকান্তের স্ত্রীও কবুতর ওড়াবে সঙ্গে একটা মানতও রাখবে তার একটি মাত্র মেয়ের যেন একখানা সু-পাত্র জোটে আর ঘরের শ্রী যেন ফেরে।
কাঁসর ঘণ্টা ঢং ঢং শঙ্খ উলু ধ্বনিতে পুজো আরম্ভ। যতই ঢাক বাজতে লাগলো ততই যেন মহাকালী জাগ্রত হয়ে কাছে আসতে লাগলেন। ঢাক বাজছে ঢ্যাক কুড়া কুড় ঢ্যাক কুড়া কুড় ঢ্যাক। অমনি এক বুড়ির শরীরে মা কালী ভর করলেন। মাথা ঘোরাতে শুরু করলেন জটা চুলগুলিসহ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বাতাসকে শাসাচ্ছেন। আর নাক দিয়ে মুখ দিয়ে গম গম কর সতর্ক করে দিচ্ছেন। সবাই হাতজোড় করে একে একে কাছে এসে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। কোনও ভুল হয়নি তো পুজোর ।-‘রক্ত চাই রক্ত।’ অমনি বন্যার মতো ঢলে পড়লো জনতার ভিড়।
মা’য়ের সন্তুষ্টির জন্য সবার মানত করা পাঁঠা নিয়ে এসে হাজির বলি দেওয়ার জন্য। আর এই দৃশ্য চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছিলো অনিমা এবং ভানুমতীও, তাদের পা নিজের জায়গা থেকে একটুও সরাতে পারছিলো না। তবে বলির প্রস্তুতি দেখে ভানুরা যে কবুতর এনেছিলেন খাঁচায় করে, ভানু দৌড়ে গিয়ে কবুতরটাকে উড়িয় দিল। আর এ দেখে ভরগ্রস্ত বুড়ি বলে উঠলো, ‘নাচ্ছোর মাগি! সারাজন্ম তোর ভালো হবে না।’ লোকজন আরও ভিড় করে কাছে এলেন। তাদের কাছে বেশ মনোরঞ্জনের বিষয় হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
তারপর সবার চোখের সামনে দুম করে একটা পাঁঠা বলি হয়ে গেলো, মা রূপী সেই বুড়ি শান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তারপর একে একে সব পাঁঠা বলি হয়ে গেলো। আর পাঁঠা বলির রক্ত দেখে জোরে চিৎকার করে থ হয় দাঁড়িয়ে রইলো ভানুমতী। আর অনিমা কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিলো। তারপর সেই রাতের কথা রাজের মায়ের আর কিছু মনে নেই।
এরপর যা শুনেছে অনিমা সব বাবার মুখে। ভানু তখন জ্বরে শয্যাগত। মুখে কোন কথা নেই। সেই বুড়ি এসেছিলো ভানুকে দেখতে। সে বলছে, ‘মা যখন অভিশাপ দিয়েছে তখন খণ্ডানো মুশকিল।’ তবে বুড়ি আশ্বাস দেয় যে পরের বছর যদি একটা লালপাড় শাড়ি আর একটা পাঁঠা বলি দেয় তাহলে ভানু সুস্থ জীবন যাপন করবে।
এরপর পুরো এক সপ্তাহ জুড়ে চলল ভানুর যত্ন। বিছানায় শুয়ে থাকে কোন কথা বলে না, মা খাইয়ে দিলে কিছুটা খাওয়া হয় নয়তো আর খাওয়া জুটে না। অনিমা মাঝে মাঝে এসে খবর নিয়ে যায়, দেখে যায়। তারপর দুঃখ করে চলে যায়। পনেরো দিনের মাথায় গিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসে। তখন থেকেই ভানু যেন কেমন হয়ে গেলো। বেশি কথা বলে না, একা একাই কাটিয়ে দেয় ঘরের এককোণে।
সেইবার ভানুর ক্লাস ফাইভ। প্রাইমারী স্কুলের শেষ বছর। একা একাই যায়, চুপচাপ থাকে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন একটি বস্তুর মতো জীব মাত্র। পরীক্ষাটাও আশানুরূপ হল না। তারপর পরের বছর চলে এলো অনিমার স্কুলে।
‘আচ্ছা মা, এই যে তুমি বললে
মাসি একেবারে শান্ত হয়ে গিয়েছিলো আমার তো বিশ্বাস হয় না। তাহলে এখন এত কথা বলে কেন?’
‘সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ সেটা তো জানিস। কখন যে কোন সময় কী হবে তা কেউ জানে না। একেই নিয়তি বলে ।’
‘কিছুতেই মিলছে না। তুমি বললে চুপ হয়ে গেছে, আর এখন তো দেখচি বাচাল।’
‘সে তো সেই সময়ে শান্ত হয় গিয়েছিলো। তারপর তো আরও অনেক ঝড় বয়ে গেছে।’
‘আচ্ছা বলো…।’
‘না এখন না থাক। অনেক রাত হলো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। পরে বলবো।’
রাজ ঘুমোতে যায়, দরজা বন্ধ, আলো বন্ধ, পাখা চালু। রাজ একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ। ঘুম আসছে না। মাথার উপরে পাখা ঘুরছে। তবুও ঘুম আসছে না। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে দরজা খুলে যায়, বিড়বিড় করতে থাকে রাজ, না আমি যাবো না আমি যাবো না। দেহ ভাসছে বিছানা থেকে। দেহ অনেক উপরে, পিশাচ একটা দুটা তিনটা। যুদ্ধ চলছে। রক্ত রক্ত রক্ত, চারিদিকে রক্ত। কবুতর উড়ে যায় --- চোখ খুললেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। ওম নমঃ শিবায়, ওম নমঃ শিবায়। চোখ খুলে ফেলেছি --- সব ঠিক, কোথায় সব ঠিক? আবার কবুতর, আবার পিশাচ, আবার কালো ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে দরজা খুলে যাচ্ছে। আমি যাবো না আমি যাবো না। দেহ ভাসছে, দেহ ভাসছে। পাঁঠার গলা কাটা, ব্যা …। উচ্চস্বরে গুঙিয়ে ধরফর করে উঠে পড়ে রাজ। চোখ মেলে কিছুক্ষণ শুয়ে তারপর বসে তারপর জল পান করলো বোতল থেকে। তারপর মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে ভোর চারটে বেজে গেছে। আবার ঘুমোতে চেষ্টা করলো।
নয়
পা হা ড়
আকাশটা বেশ পরিষ্কার, গরম অনেকটা কম, মনটা ফুরফুরে, মাথাটা অনেকটা হালকা লাগছে। বহু দিনের প্ল্যান বাড়ির পুজো শেষে একদিন বন্ধুরা মিলে কার্শিয়াং ঘুরে আসবে। ঘুম থেকে উঠতে রাজের মনে হল বিষয়টা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে কৌশিককে মোড়ের মাথায় চায়ের দোকানে আসতে বললো।
‘সকাল সকাল কোথায় বেরোচ্ছিস। তোর জন্য কি চা বানাব?’
‘না মা, আমি কৌশিকের সঙ্গে বিমল কাকার দোকানে যাচ্ছি।’
‘দোকানে চা খাওয়ার কি দরকার। কৌশিককে আসতে বল আমি চা বানিয়ে দিচ্ছি।’
‘না মা, বল্লাম তো দরকার আছে। আমি আসি।’
কাচের গ্লাসের থেকে ধোঁয়া উঠছে। ফুঁ দিয়ে দুজনে চুমুকে চুমুকে কাঠের বেঞ্চিতে প্ল্যান করতে লাগলো। ‘বেশি বন্ধুদের বলা যাবে না, তুই আমি জিনি আর বিশ্বকে বলে দেখিস। বিশ্ব হয়তো না করবে না। বিশ্বকে বাইক নিতে বলিস, আমি বাবারটা নিয়ে যাবো।’
‘জিনি কি যাবে? ও কি সম্পূর্ণ সুস্থ।’
ঠিকই তো রাজের এইদিকটা একদম খেয়াল নেই। রাজ জিনিকে ফোনে যোগাযোগ করলো আর কৌশিক-বিশ্বকে ফোন দিল।
রাজ একটু ফাঁকে এসে জিনির সঙ্গে কথা বলতে লাগলো ‘কী করছিস জিনি?’
‘কিছু না রে।’
‘শোন না, মায়ের মুখে মাসির ছোটবেলার অনেক গল্পই শুনলাম।’
‘ও তাই, আমাকেও কিন্তু বলতে হবে বলে দিচ্ছি।’
‘এখন হাঁটতে পারছিস পুরোপুরি।’
‘হাঁটতে না পারলে কি তোদের বাড়ি যেতাম!’
‘একটা কথা বলার ছিল, বলছি যে তুই তো জানিস আমাদের অনেক দিনের প্ল্যান ছিলো পাহাড় যাবো। ভীষণ মন ছুটে গেছে বুঝলি তো। চল না কাল --- কৌশিক আর বিশ্বও যাবে।’
‘এখুনি কী করে যাই বল, মাত্র আমার পা ঠিক হলো। মা যেতে দেবে না। আর কাল তো হবেই না, কাল সকালে গানের ক্লাস আছে।’
‘আচ্ছা তাহলে পরশু চল। কিন্তু যেতেই হবে। নয় তো...।’
‘নয় তো কী?’
‘না না সেভাবে বলতে চাই নি। নয় তো আমাদের যাওয়া হবে না এই আর কি।’
রাজের মুখটা কালো হয়ে আসে। কথাগুলো আটকে আটকে বেরচ্ছিলো। ফোনটা রেখে দেয় রাজ।
‘কি রে রাজ, কাল যাচ্ছি তো?’
‘না কাল হচ্ছে না, পরশু যাবো।’
‘জিনি যাবে তো?’
‘ও না গেলেও আমরা যাবো।’
কৌশিক আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে চায় না। শুধু বলে, ‘আচ্ছা বাড়ি চল।’
রাজ বাড়ি যায় না। ‘তুই যা আমি আসছি, একটু ঘাট হয়ে ঘুরে আসি।’
কৌশিক বাড়ি ফিরে যায়। রাজ সিগারেট ধরিয়ে বুড়ি বালাসনের জলের দিকে মাছের চোখের মতো স্থির দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে পথ দিয়ে মন্থর গতিতে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলে। আজ আর বসতে ইচ্ছে করে না। জিনি যাবে না! না যাক। ও না গেলেই বা কি! প্ল্যান তো আমার নিজের। কাউকে যেতে হবে না আমি নিজে একাই যাবো। এই বুড়ি বালাসনের মতো আমিও একা চলব, কারোর প্রয়োজন নেই।
রাতে জিনির ফোন আসে। ফোন তুলে রাজ কিন্তু চুপটি করে গম্ভীর হয়ে থাকে। ‘মা প্রথমে না করেছিলো, কিন্তু আমি রাজি করিয়ে নিয়েছি। আসলে তুই তো আছিস তাই মা আর না করলো না। পরশু যাবো সিওর। চাপ নিস না। আচ্ছা সকাল সকাল আমি তোদের ওখানে চলে আসবো নাকি তুই এদিকে আসবি নিতে? আর হ্যাঁ ভানু মাসির গল্পটা যে তুই শুনেছিস ওটাও তো আমাকে শুনতে হবে নাকি? তুই কিন্তু একদম মনমরা হয়ে থাকবি না। আমারও অনেকদিনের ইচ্ছে একটু পাহাড় ঘুরে আসবো। ঘুরাও হয়ে যাবে পাহাড়, দেখাও হয়ে যাবে...’
সময় উপস্থিত গন্তব্য স্থির এখন খালি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার অপেক্ষা শুধুমাত্র। বিশ্ব, কৌশিক অপেক্ষা করে। রাজ জিনিকে বাড়ি থেকে নিয়ে এলেই চার বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়বে পাহাড়ের গন্তব্যে।
বালাসন নদী পাড় হয়ে মাটিগারা খাপরাল মোড়ের বামদিক দিয়ে চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে চলতে চলতে জনতার ভিড় কমে যায়। রাস্তার পাশ দিয়ে স্বাগত জানাতে থাকে পাতা ঝরা শালগাছগুলি। হঠাৎ যেন অদ্ভুত রাজ্যে প্রবেশ করতে শুরু করলাম। দুপাশে সবুজ সমতল চোখের সামনে ছোটো ছোটো কত পাহাড়, কোনটাতে যে আমরা উঠব। এটা না ওটা ঠিক ওই পাহাড়ের পেছনেই কাঞ্চনজঙ্ঘা বা এই ডান দিকেরট কি বাম দিকেরটা দিয়েই উঠে গেলে বোধ হয় দার্জিলিং। আমরা কোন পাহাড়ের দিকেই ছুটে যেতে পারছি না। পথ নিজের মতো করে আমাদের নিয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে শুরু করলো এই পথ ধরে উঠলেই বুঝি স্বর্গে ওঠা যায়। এবারে বোধ হয় অলৌকিক দরজা খুলে যাবে। সমতল ছেড়ে যে কখন পাহাড়ে উঠে গিয়েছি সেই খেয়ালই নেই। চারিদেকে শুধু সবুজ আর সবুজ পাখির কলতান, বাঁদরগুলো রাস্তায় ঘুরাঘুরি করছে।
কার্শিয়ং যেতে পথেই রোহিণী। ইচ্ছে হলো এই রোহিণীতেই একটু ঘুরে তারপর আবার বেরনো যাবে কার্শিয়ং-এর পথে। বাইক স্ট্যান্ড করে সোজা হাঁটতে শুরু করলো শিবের মন্দির দেখার জন্য। মন্দিরে যেতে হলে পাহাড়ের গা কাটা সরু পথে রেলিঙ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। রেলিঙের পাশে খাদ। আর এই রেলিঙ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কানে ভেসে আসবে পাশের সরু নদীর আওয়াজ। সরু নদী ঝরো আওয়াজে প্রতিক্ষণে প্রতিবাদ করে চলেছে এই মানুষ নামের জীবদের বিরুদ্ধে। কিংবা বলা যায় সরু নদী পাহাড়ের প্রেমে পড়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে বলছে, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি।’ উফ কি তেজ এই সরু নদীর। মুখটা বামপাশে ঘুরালেই সবুজ আর সবুজ আর সেই সঙ্গে খাদ। এগিয়ে গেলো রাজেরা মার্বেল দেওয়া মন্দিরটির দিকে। মন্দিরের ভিতরে বিশাল এক পাথর। সকলে এই পাথরকে দেবতা হিসেবে আরাধনা করে। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে রাজ আর জিনি গিয়ে বসলো টালি দেওয়া ছাউনিতে। বিশ্ব এবং কৌশিক গেলো অন্যত্র অর্থাৎ মোমোর দোকানে।
‘দেখ কি সুন্দর! এখান থেকে কতটা দেখা যায় নিচে! উফ নদীর কি আওয়াজ!’
রাজের বুড়ি বালাসনের কথা মনে পড়ে যায়। সেও শীর্ণ আর এই নদীও শীর্ণ অথচ কত তফাৎ। এই নদীর যে তেজ সেই তেজ বুড়ি বালাসনের নেই। জিনি রাজের কথা শোনে এবং চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে সবুজের দিকে তাকায় না। তারপর আরেকটু পাশে ঘেঁষে বসে রাজের ঘাড়ে নিজের মাথা রেখে বলতে লাগলো, ‘রাজ তুই আমাকে বেশি ভালোবাসিস নাকি এই পাহাড়কে?’
হো হো করে রাজ হেসে উঠে। ‘আরে আমার পাগলিরে কিসব ভাবছিস! এগুলো আবার বলতে হয় নাকি!’
‘না বল বলছি।’
‘আমি তো তোরই, তোকে আমি অনেকটা ভালোবাসি।’
‘জানি তো এই পাহাড়ের থেকে বেশি না আর তোর বুড়ি বালাসনের থেকে বেশি না। আচ্ছা আমি যদি এখান থেকে খাদে পড়ে যাই, কী করবি তুই?’
চমকে উঠে রাজ। এইসব ভাবনা শুধু রাজ ভাবে কিন্তু আজ কেন জিনি এইসব বলছে । এ তো দেখছি ছোঁয়াচে রোগের মতোন। জিনির হাত চেপে রাজ কপালে একটা চুমু দিলো তারপর বলে, ‘এইসব ভাবনা ভাবতে হবে না। চল কৌশিকরা অপেক্ষা করছে। এখন আবার কার্শিয়ং বেরতে হবে।’
রাজের একহাত জিনিয়ার ঘাড়ে। দুজনে নিচে নেমে এলে মোমো খেয়ে বেরিয়ে পড়বে কার্শিয়ং-এর গন্তব্যে।
পথের একপাশে সুউচ্চ পাহাড় আর এক পাশে খাই। ক্রমশই এগিয় চলছে মন আর পিছিয়ে যাচ্ছে রাস্তা। পথের বাঁকে বাঁকে কাঠের পাটাতনের ঘর। কোমরে লাল সাদা কাপড় লেপচা মেয়েগুলো হাত নেড়ে নেড়ে ঈশ্বরের মতো হাসি হেসে স্বাগত জানাচ্ছে। হঠাৎ যেন স্বর্গপুরীতে প্রবেশ করতে শুরু করে দিলো। মেঘ নেমে এসেছে। মেঘ আর পাহাড় উভয় উভয়ের গা ঘেঁষে কথোপকথনে ব্যাস্ত। আর শাল ওক পাইন সেই মেঘ চিরে সোজা আকাশের সাথে সংলাপ সারছে। হালকা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। হাত ধরে এক ছাতার নিচে প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল হাঁটছে। সবটাই এক শান্ত নিশ্চিন্তের দেশ। তারপর বাম পাশে চা পাতা বাগান দেখতে দেখতে প্রথমে গেলো কার্শিয়ং। তারা যায় একটি চার্চে। চার্চের দুপাশে কাঠের বেঞ্চি, সামনে ক্রুশবিদ্ধ যীশু। হাত জোড় করে কিছু একটা চেয়ে নেয় জিনি। চার্চের প্রবেশ পথেই বাম দিকে একটা ছোট্ট মাদার মেরী হাউস। সেখানে মাদার মেরী শিশু যীশুকে কোলে নিয়ে বসে আছে। আহা কি সুন্দর পবিত্র মূর্তি। জিনি মাদার মেরীর মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আর কী সব যেন ভাবে। শিশু যীশু মাদার মেরী মা, ভানুর সেই শিশু কোলে নিয়ে দৌড়…
দশ
প্র ণ য়
দুপুরে রান্নাঘর থেকে রাজের মা স্বামীকে বলছে, স্নান সেরে খেতে বসতে তার রান্না করা হয়ে গেছে। স্নান সেরে খেতে বসলে রাজের বাবা বলে, তুমি যে ভানুর গল্প বলছো, আচ্ছা তুমি যে একবার বলেছিলে ভানুর জন্য নাকি একটি ছেলে মার খেয়ে মারা গিয়েছিল।
‘আমি জানি না ঠিক কতটা সত্যতা রয়েছে। কিন্তু জানি ছেলেটা সত্য। বাঁচা মরা লোকের মুখে শুনেছি।’
‘কী ঘটেছিলো বল তো?’
‘তা কোনোদিনই তো শুনতে চাওনি? তা আগে কতবার বলতে চেয়েছি। তুমি শুধু এড়িয়ে গেছো। তা আজকে কী হল বল তো?’
‘ছাড়ো না আগের কথা। তুমি বলো না ঠিক কি হয়েছিলো?’
‘আচ্ছা আচ্ছা, আগে খেয়ে নাও তারপর বলছি, মাছের পেটিটা দেবো?’
‘হুম দাও।’
খাওয়া শেষে দুজনে বিছানায় গিয়ে ফ্যান চালিয়ে বিশ্রাম করতে লাগলেন। তারপর দুই পা বিছানায়া উঠিয়ে সোজা হয়ে বসে রাজের মা বলতে লাগলেন, ‘তখন আমি ক্লাস এইট আর জানোই তো ভানুদি কত দেরি করে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো। ওর বয়স তখন পনের কি ষোল।
‘বেশ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে শুরু করতে শুরু করেছিল দুজনে। দুজনে গলায় গলায় বন্ধু। কিন্তু এই পনের-ষোল বয়সটায় নারীদেহে ধীরে ধীরে অনেকটাই পরিবর্তন হতে শুরু করে। দেহে মনে মস্তিষ্কে সব জায়গায় যেন একটা নতুন পৃথিবী দোলা দিয়ে যায়। ভানুমতীরও ঠিক তাই হয়েছিলো। বেশ স্পষ্ট ভাবে সমস্ত লক্ষণগুলো পরিস্ফুটিত হয়ে দেখা দিচ্ছিল, মনটাও বেশ চঞ্চল হয়ে উঠতো। এই পৃথিবীর সমস্তই যেন এত দিন মিথ্যে ছিল, সবকিছুই নতুন করে জন্ম নিতে শুরু করলো তার কাছে। এই আকাশ নতুন, এই কমলা সূর্য নতুন, এই মাঠ নতুন, এই নদী নতুন, এই শাপলা ফুল নতুন, এই বকুল ফুল নতুন, নতুন ঋতু বদল।
‘ক্লাসে একদম মন থাকতো না ভানুমতির, স্কুলের নাম করে মহানন্দা নদীর ধারে এসে বসে থাকত। আর দেখত নৌকা করে খালি গায়ে মাঝিদের নৌকার দাড় টানা, জেলেদের জাল ছোড়া, আর ওই মেয়েগুলোর কলকল হাসি। তাকিয়ে থাকত নদীর জলে ঝপাঝপ স্নান করা উলঙ্গ ছেলেগুলোর দিকে। সব ছোকরাগুলো দৌড়ে এসে ঝাঁপ দিচ্ছে নদীতে, ভানুমতীরও মন চায় সেও ঝাঁপ দিক এই নদীর জলে।
‘এভাবেই বেশ কিছুদিন চলছিলো, তারপর হঠাৎ তাকে আর স্কুল দেখা যায় না। অনিমা খোঁজ করে দেখতে পায় এই মহানন্দা তীরে অর্জুন নামে একটি ছেলের সঙ্গে ভানুর বন্ধুত্ব জমেছে।
‘প্রায় স্কুল না গিয়ে অর্জুনের সঙ্গে দিন কাটিয় দেয় ভানু। এই অর্জুনের বাড়ি বালুরঘাট। সে এখানে এসেছে পাড়ার এক কাকার সাথে। চা পাতা বাগানে কাজ করছে ছয় মাস হলো।
‘প্রথম প্রথম যখন ভানুমতী নদীর পাড়ে একা বসে থাকতো তখন দূর থেকে দেখতো অর্জুন। এভাবে বেশ কিছু দিন দেখার পর একদিন অর্জুন কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি স্কুলে না গিয়ে রোজ এখানে এসে বসে থাকো কেন?’ অবাক হয় ভানুমতী, তাকিয়ে থাকে অর্জুনের দিকে। এত সুন্দর চেহারা সৌম্য, শান্ত দৃষ্টি। ঝাঁকড়া চুল। লম্বা দেহ --- ঠিক যেন স্বর্গ থেকে ঈশ্বর মর্ত্যে নেমে তার কাছে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন, ভাব জমাচ্ছেন।
‘তুমি কে?’
‘অর্জুন, অর্জুন দাস। আমার বাড়ি বালুরঘাট। তুমি এখানে বসে থাকো কেন?’
তারপর অর্জুনও বসে পড়ে ভানুমতীর পাশে, ভানুমতীরও মন চায় এই দেবতার পাশ আরেকটু ঘেঁষে বসি, কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও আরও ঘেঁষে আসতে পারেনা বরং আরেকটু দূরে সরে বসল। দিন যায় রোজ একটু একটু করে ভাব জমে। দুজন দুজনের অপেক্ষায় বসে থাকে। যেদিন অর্জুন কাজের চাপে নদীর ধারে আসতে পারতো না সেদিন এই নদী ওই মাঝি, ওই হাঁসের জলে নেমে যাওয়া, ছেলেদের স্নান সব কিছুই যেন অসংলগ্ন ঠেকে। কোথাও কোন মাধুর্য নেই, ছন্দ নেই, সমস্ত জগতটাই যেন সৃষ্টিছাড়া খাপছাড়া এক জড় পদার্থ। আর যখন অর্জুনকে পাশে পায় যেন কথা আর ফুরোতেই চায় না। এই নীল আকাশ, আকাশে সাদা বকের ঝাঁক, নদী, নদীর পাশে ঝোপঝাড় তারপর তার গ্রাম তার মাটি আরও কত কিছু। অর্জুন সবটা শোনে সবটাই মন দিয়ে শোনে। এই এতদিন পর ভানু কাউকে পেয়েছে যে তার সমস্ত কথা শোনে, এমনকি অনিমাও তার সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনতো না সে টের পায়।
‘অনিমা বিষয়টা জানতে পারলো বেশ কিছুদিন পর। অনিমা ঠিক বুঝে উঠতে পারতো না। তার মনে হতো এই অর্জুনের জন্যেই ভানুমতী রোজ একটু একটু করে তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, মনে মনে ভীষণ রাগ করে।
‘এখন অর্জুন যেন ভানুমতীর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। অর্জুন যখন যখন কাজের চাপে দেখা করতে আসতে পারত না তখন তার একদমই ভালো লাগত না, শরীরটা খারাপ লাগতো। একা বসে থাকতো মহানন্দা পাড়ে আর ভাবত সেই প্রথম দিন ভানু একা বসে ছিল এখনও সে একা বসে রয়েছে। তবুও মনটা খালি অর্জুন অর্জুন করে। কী যেন হয়ে গেছে ভানুর, শুধু অর্জুনের গলা শুনতে চায় মনটা অর্জুনের পাশে বসতে চায়। ভানু বুঝতে পারে অর্জুনের সঙ্গে দেখা করতে হলে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
‘অনিমার বকুনি ঝাঁকুনিতে ভানু আবার ফিরে এলো স্কুলে। দুজনেই বেশ হইহুল্লোর করত। একসঙ্গে স্কুলে আসতো কিন্তু ছুটির পর ভানু বাড়ি ফিরত না। সন্ধ্যা পর্যন্ত অর্জুনের সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করত। অর্জুন সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে পথ দিয়ে ভানুর সাথে গল্প করতে করতে বাড়ির রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতো পাছে কেউ দেখে না ফেলে তাই গ্রামের সীমানার আগেই তাকে একলা ছেড়ে দিতো। অর্জুন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো ভানু ফড়িঙের মতো উড়ে উড়ে বাড়ি ফিরছে। যতক্ষণ দেখা যেত ততক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো। ভানুর বাড়িতে দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতো অনিমাদের বাড়ি হয়ে ফিরেছে তাই দেরি। কারোর কোন অভিযোগ থাকার কথা নেই।
‘সেদিন ছিলো অর্জুনের ছুটির দিন এবং সেই সঙ্গে হাতে পেয়েছে সাপ্তাহিক মজুরি। ভানুকে আগের থেকেই বলে রেখেছিল আজকের সারাদিন থাকবে তার সঙ্গে। তাই ভানু একটু বেশি সেজেগুজে স্কুলের ড্রেস পড়ে ব্যাগের মধ্যে একটা নতুন জামা ঢুকিয়ে নেয়। সেদিন সে আর স্কুলে যায়নি এমনকি অনিমাদের বাড়িতেও নয়, একাই সকাল সকাল গিয়ে বসে মহানন্দা পাড়ে। তারপর সুযোগ বুঝে বাঁশ ঝোপের পেছনে গিয়ে জামা পরিবর্তন করে নিল। নদীর পাশে বসে অপেক্ষা করে ভানু। অর্জুন এলে ভানু দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে আজ কেমন দেখাচ্ছে তাকে। জবাবে অর্জুন শুধু একটা হাসে, আর তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পাশাপাশি বসে ভানু আকাশ পাতাল গল্প করতে করতে মাথা হেলিয়ে দেয় অর্জুনের কাঁধে। কিছুটা সময় কাটানোর পর দুজনে বেরিয়ে পড়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরতে, স্কুলের সামনে মনোহারি দোকান রয়েছে। অর্জুন তাকে একটা চোখের কাজল, লাল টিপের পাতা, কানের দুল কিনে দেয়। স্কুল ছুটি হলে অনিমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে ভানু। অনিমাকে উপহারগুলো দেখালে অনিমা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে । জিজ্ঞস করে, ‘বাড়িতে কী বলবি? কোথা থেকে পেয়েছিস এইসব?’
মাথা দোলাতে দোলাতে বলে, ‘বলে দেবো তুই দিয়েছিস। এগুলো তুই নতুন এনেছিস আমার জন্য।’
অনিমার বুক দুরুদুরু কাপতে লাগলো। ‘না আমার নাম বলবি না।’
‘তুই ভয় পাস না, আমি সামলে নেব।’
‘তারপর অনিমা আর কথা বলে না, দুজনে যে যার বাড়ি চলে গেলো। ভানু উপহারগুলো ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে রাখে।
‘রবিবারের দিনেও অনিমার নাম করে বেরিয়ে তাদের বাড়ি না গিয়ে বিকেলে অর্জুনের সঙ্গে দেখা করে। নদীর ধার দিয়ে হাঁটত হাতে হাত দিয়ে। গল্প করে অনেক সুখের দুখের। মনে মনে ছবি আঁকে অদূর ভবিষ্যতের, শুধু অর্জুন আর ভানু, ভানু আর অর্জুন। এই জগৎ শুধু তাদের, এই নদী তাদের, এই সূর্য তাদের, এই বিকলের আবছা চাঁদ তাদের, এই আকাশ তাদের। তারা পাখি হয়ে ঘুরে বেরাবে সমস্ত আকাশ জুড়ে। ভানু রান্না করে অপেক্ষা করবে, অর্জুন কাজ থেকে ফিরবে, ভানু ভাত বেড়ে দিবে, দুজনে গল্প করবে, নিশ্চিতে ঘুমাবে। অর্জুন এখানে কাজ করছে অনেক টাকা জমলেই বাড়িতে গিয়ে বলবে তারপর তাদের বিয়ে। বিয়ের কথা ভাবতেই ভানুর মনে আসে লাল পাড় হলুদ শাড়ি, শাঁখা, সিঁদুর আরও কত কি যেন ভাবতে থাকে সেই সময়ে একটা হলুদ প্রজাপতি কোথা থেকে উড়ে এসে গায়ে বসলে সম্বিৎ ফিরে পায় আর লজ্জায় মাথা নিচু করে।
‘বুধবার সন্ধ্যাবেলা স্কুল ছুটি হলে অভ্যাস মতো অনিমা একাই বাড়ি চলে আসে। ভানু অপেক্ষা করে অর্জুনের। দুজন চলে যায় নদীর পাড়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে ভানুর মনটা ধুকপুক করতে লাগলো। তাকে তাড়াতাড়ি জামা পাল্টে স্কুলের ড্রেস পড়ে বাড়ি ফিরতে হবে। আবার এইদিকে আকাশ কালো হয়ে আসছে মনে হচ্ছে ঝড় এই আসলো বুঝি। ভাবতে না ভবতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমে গেলো। ভানুমতী দৌড়ে বাঁশঝোপের পেছনে চলে যায় স্কুলের ড্রেসটি পড়তে হবে। অর্জুন বাঁশঝোপের উলটোমুখো হয়ে পাহারা দেয়, যেন কোন কাকপক্ষীও টের না পায়।
‘তারপর হঠাৎ সূর্য ডুবে যায়, মেঘ কালো হয়ে আসে, বৃষ্টিটা আরেকটু জোরে আসে, বিদ্যুৎ চমক দেয়। অর্জুনের মাথার চুলগুলো ভিজে কপাল ঢেকে গেছে, হাত দিয়ে মুখটা মুছে বারেবারে। অর্জুনের মনটা যেন কেমন চিনচিন করে উঠলো। আর পেছন ফিরে থাকতে ইচ্ছে করে না। ভানুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালে, ভানু সামান্য ভেজা শরীর নিয়ে তাকে ফ্রকের পিঠের হুকটা লাগিয়ে দিতে বলে।
‘অর্জুন আলতো করে ভেজা হাতটা বুলিয়ে দেয় ভানুর পিঠে।ভানু বিদ্যুতের চমকের সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় ঘুরে সর্বাঙ্গ ভেজা শরীর নিয়ে জড়িয়ে ধরে অর্জুনকে। তারপর মাথার ক’গাছি চুল ভানুর কপালে নেমে এলে আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে থুতনি ধরে এই প্রথম অর্জুন কোন মেয়ের কপালে চুমু খেল। তারপর হঠাৎ বয়ে যায় একটা দমকা হাওয়া। অর্জুন ধীরে ধীরে নিজের মুখটা গুঁজে দেয় ভানুর বুকের মাঝে। ভানু চোখ বন্ধ কর, তারপর একে একে খসে যায় গোলাপের পাপড়ি, সন্ধ্যার আকাশে খসে পড়ছে তারা, মাঝির নৌকার ছাউনিতে প্রবেশ করে গেল বেদেনী, রাজহাঁস রাজহংসীকে ডানার নিচে আগলে রাখছে, টিয়া পাখি টিয়া পাখির ঠোঁটে ঠোঁট রাখছে, ময়ুর পেখম তুলে নাচছে ... ।
‘এরপর এক সপ্তাহজুড়ে ভানুমতী চুপচাপ বাড়িতেই রইলেন, আর অর্জুনের সঙ্গে দেখা করলেন না। অর্জুন প্রতিদিন আসে মহানন্দা পাড়ে একলা বসে অপেক্ষা করে ফিরে যায়। এভাবেই দু মাস কেটে যাওয়ার পর ভানুর মায়ের মনে একটা খটকা লাগে দেহের এবং মনের পরিবর্তন দেখে। ভানুর মা কাউকে কিছু না বলে সোজা ডেকে আনে গোপালী বুড়িকে। এই গোপালি বুড়ির বয়স অনেক হয়েছে তিনি আগে গর্ভবতী মায়েদের সন্তান প্রসবে সহায়তা করতেন। তিনি এলে বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারেন, ভানুর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলেন, সবটা খুলে বলতে বলেন। সবটা শুনতেই ভানুর মায়ের মাথায় হাত। ভানুর মা’কে কী সব বুঝিয়ে তিনি চলে গেলেন।
‘রাতেই নিশিকান্ত বাবু সবটা শুনে যেন ধান কাটার কাস্তে নিয়ে মেয়ের গলা কাটতে যায়। দাদারা মারতে শুরু করে। পাড়ার কয়েকজন এসে উপস্থিত। কয়েকজন মহিলা এসে ভানুকে একটা ঘরে দরজা বন্ধ করে ঘর বন্দি করে দিলো।
‘ঘরের উঠোন বয়স্করা এবং প্রধান পঞ্চায়েতরা এসে মিটিঙে বসে। তারপর সিদ্ধান্ত নেয় তাদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক। এই কথা ভানুর কানে যেতেই সে মনে মনে অদূর ভবিষ্যতের সংসারের ছবি আঁকে। ভানু অর্জুন এবং তাদের সন্তান। তার রাতে ঘুম আসে না, সকাল হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
‘কোন এক বন্ধুকে দিয়ে অর্জুনকে ভানুদের বাড়িতে আসার খবর দেওয়া হলে, তৎক্ষণাৎ সে ছুটে আসে। না জানি ভানুর কী হয়েছে তাদের মধ্যে দেখা হয় না অনেক দিন কেটে গেছে, মনটা আর স্থির থাকেনা। অর্জুন বাড়ি এলে ছোড়দা ছুটে গিয়ে একটা বাঁশের টুকরো নিয়ে আচমকা মারলো অর্জুনের ঘাড়ে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠোনে গড়িয়ে পড়লো অর্জুন। এরপর একে একে বড়দা ছোড়দা, ছোড়দার বন্ধুরা লাথি-ঘুষি-বাটাম দিয়ে মারতে শুরু করলে দেহ দিয়ে মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু হয়। আর এই চিত্র দেখে ভানু চিৎকার করে কান্না শুরু করে অর্জুনের কাছে ছুটে আসতে চায় কিন্তু নিজের অজান্তেই জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে যায় ঘরের বারান্দায়। তারপর তাকে একটা ঘরে নিয়ে রেখে দেয়। জ্ঞ্যান ফিরলে ছুটে আসতে চায়, কিন্তু তাকে ঘরবন্দি করে রাখা হল। যখন অর্জুনের মাথা ফেটে রক্ত বের হতে শুরু করে তখন গ্রামের বয়স্করা এসে থামিয়ে দেয়। প্রধান এসে উপস্থিত হলে তিনি বোঝান যে এবারে কিন্তু একটা পুলিশ কেস হয়ে যেতে পারে। ‘আপনারা থামুন, ছেলের বাড়িতে একটা খবর দিন, ওই কে আছিস, ছোকরাটাকে হাসপাতালে নিয়ে যা।’
‘খবর পেয়েই বালুরঘাট থেক ছুটে আসে অর্জুনের বাবা। হাসপাতালে গিয়ে দেখতে পায় গ্রামের অনেক লোক উপস্থিত। আর তিনি হেপো, রুগ্ন শরীর নিয়ে কোন প্রতিবাদ করতে পারলেন না। শুধু খানিকক্ষণ পরপর একটা করে বিড়ি টানতে লাগলেন। পুলিশ এলে উভয়পক্ষের দোষ দেখতে পেলে প্রধান পঞ্চায়েত মাতব্বর সকলে মিলে টাকা পয়সা দিয়ে ঝামেলার একটা রফাদফা করা হয়। সেই সঙ্গে বলা হয় যেন এই ছেলেকে যেন এই অঞ্চলে আর দেখা না যায়।
‘তারপর থেকেই বিভিন্ন কথা কানে এলো। কারোর মুখে শুনি ছেলেটা হাসপাতালেই মারা গেছে। কখনও শুনি বাড়ি ফিরে গেছে। কখনও শুনি পাগল হয়ে গেছে। কোনটা সত্যি তা বলতে পারবো না।’
‘আর ভানু, ভানুর কী হল?’
তারপর থেকেই ভানু যেন কেমন হয়ে গেলো। গোপালি বুড়ি একটা ওঝা ডেকে নিয়ে এসে ঝাড়ফুঁক করে কত কি বেটে খাওয়াল। এভাবেই চল্লো প্রায় একমাস। সন্তানটি আর হল না। আর কোনোদিন বাচ্চাও হল না।
রাজের মায়ের চোখের কোণে জল চলে আসে। রাজের বাব একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছারলো। রাজের বাবা বলে, ‘মন খারাপ করো না, ভগবান দেখল না ওকে। কী করার আছে বলো?’
রাজের মা মনে মনে ভাবে সবটাই কি ভগবান করে? সবটাই কি নিয়তি? কিন্তু আমি যে এখানে নিজের চোখে সব জলজ্যান্ত মানুষগুলোকে দেখলাম, সমস্তটা ধ্বংস করে দিতে। এরা কি ক্ষমার যোগ্য। না সমস্ত নিয়তি না। মানুষ, মানুষ ক্ষমার যোগ্য না। রাজের মা বিছানার উপরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। রাজের বাবা ফ্যানের গতিবেগটা আরেকটু বাড়িয়ে দেয়।
এগারো
ক থো প ক থ ন
জানালা খুললে ওই দুরের বাঁশ ঝাড়ের কিছুটা অংশ আর নতুন অ্যাপার্টমেন্টগুলোর পাশের বড় সেগুন গাছের মাথাটি দেখা যায়। সেগুন গাছের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলো এক ঝাঁক শাদা বক। মেঘলা মেঘলা আকাশের সকালটা ছাই রঙের হয়ে আছে। হাওয়া চলছে বৃষ্টি আসলেও আসতে পারে। কয়েকটা ছেলে ব্যাট বল হাতে নিয়ে মাঠের দিকে চলে গেল। আজ ওদের নিমতলা দলের সঙ্গে ম্যাচ রয়েছে । দু-তিনটা বয়স্ক লোক বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে চায়ের দোকানে এগিয়ে গেল। একটি মহিলা ঢেঁকি শাকের বোঝা মাথায় নিয়ে কোলে তিন বছরের শিশুকে নিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। মহিলাটার ডান হাতটি মাথার বোঝার উপরে আর বাম হাতটা দিয়ে কোনক্রমে এতক্ষণ শিশুকে কোলে আগলে রেখেছিল। হয়তো হাতটা ক্রমশ বোধ শূন্য হয়ে আসছিল, বাচ্চার পা কোমর ধীরে ধীরে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে নিম্নগামী হচ্ছিল। পরে মা শিশুকে কোল থেকে নামিয়ে বাকি পথ আঙুল ধরে হাঁটিয়ে বাজারের দিকে চলে গেলো। বাচ্চাটির কোন অভিযোগ নেই, হাসিমুখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মাটির দিকে তাকাল। মায়ের মুখেও কোন ক্লান্তির চিহ্ন নেই। হাসিমুখে দুজনে প্রবেশ করছে বিশ্বসংসারের বাজারে। এরপর দরদাম হবে কেউ ঠকবে কেউ জিতবে কেউ সস্তায় কেউ জীবনের দাম দিয়ে সংসারের উপকরণ সংগ্রহ করবেন, তারপর মিলিয়ে যাবেন পথের ধুলোয়। আবার হাসিমুখে মা শিশু হাত ধরাধরি করে বাজারে প্রবেশ করবে। সংসারের ছন্দকে পরিচালনা করবে।
এইসব ঘটনা রোজ ঘটে কিন্তু আমরা দেখেতে পাই না। দেখতে পেলেও মস্তিষ্কের জানালা খুলে দাঁড়িয়ে উপভোগ করি না। রাজ পূর্ব দিকের জানালাটা খুলে এইসব দেখছিলো।
বিকেলে রাজ চলে আসে মাঠের গ্যালারীতে আড্ডা দিতে, যেখানে আগের থেকেই অপেক্ষা করছে কৌশিক, দীপ্তি, ভাগীরথী।
কৌশিকঃ রাজ তোর কাছে সিগারেট আছে?
রাজঃ না রে, পাশের জয়ন্ত কাকুর দোকান থেকে নিয়ে আসব?
দীপ্তি ব্যঙ্গ করে বলল, ‘তোরা যে কী?’ আসলে দীপ্তিরও মনে মনে ইচ্ছে সেও একটান দিবে সিগারেটে।
কৌশিকঃ আরে দাঁড়া দাঁড়া! এত ক্ষেপে যাচ্ছিস কেন? নিয়ে আসছি।
সিগারেট এনে ধরাতে ধরাতে সবাই একটান দুটান দিতে দিতে ভাগীরথী বলে, ‘আমাকেও এক টান দে তো।’ সবাই অবাক হয়ে ভাগীরথীর দিকে চেয়ে থাকে। যে মেয়ে এই সবের পাশ দিয়েও যায় না সে আবার চাইছে কেন! কৌশিক উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইলো ব্যাপারাখানা কী। ভাগীরথীর মুখটা কালো হয়ে আসে। তারপর আবার বলে, ‘রাজ তুই তো খুব স্বার্থপর, তোরাই ঘুরে এলি সব পাহাড় থেকে। আমাদের বললি না।’
কৌশিক পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার জন্য বলে, ‘হঠাৎ করেই প্ল্যান, জিনি হঠাৎ করে বলল তাই আমরা দুজনে বেরিয়ে গেলাম।’
দীপ্তি তীক্ষ্ণ বাঁকা চোখ করে বলে ওঠে, ‘থাক আর কৈফিয়ৎ দিতে হবে না।’
সিগারেট একে অপরকে পাস করতে করতে রাজ বলে, ‘কাল রাতে কী একটা ঘটনা হয়েছে, শুনলাম। মন্দিরের পাশের বাড়ি মানে মালিনী কাকিমাদের বাড়ি। অনেক লোক জড়ো হয়েছিল বলে?’
দীপ্তিঃ আর বলিস না। লোকের খেয়ে কাজ নেই তো, তাই কার বাড়ি কার ঘরে কী চলছে উঁকিঝুঁকি মারে। মানে, নরম পেলেই গরম হয়ে যায় সব, মাছির উপরে তরোয়ালের তরবারি।
কৌশিকঃ যেটা হয়েছে সেটা তো ঠিকই হয়েছে। ওনার জন্য পাড়াটা উচ্ছনে যাবে নাকি!
রাজঃ একটু পরিষ্কার করে বল। এখন আবার কী করল? উনি তো বাড়িতে বসে মদ খায় সেটা তো সবাই জানে। এ আবার নতুন কী?
ভাগীরথীঃ ড্রিঙ্ক করে তো কী হয়েছে? ড্রিঙ্ক করলেই কি খারাপ হয়ে গেলো নাকি? বেচারির স্বামী যদি অ্যাকসিডেন্টে না মরতো, বাচ্চাটি যদি ছোটো না থাকতো তাহলে তো উনি আর পাঁচ জনের মতোই জীবন যাপন করতেন।
রাজঃ ধুর, আর ভালো লাগে না, কী হয়েছে সেটা তো বল।
ভাগীরথীঃ তুই তো আগের থেকেই কথা বলে কথা বাড়াচ্ছিস।
রাজঃ আচ্ছা বল। আর মাঝখানে কথা বলবো না।
দীপ্তিঃ আরে রঞ্জিত কাকু, বিল্টু দা, নরেন দা, মিন্টু কাকুরা মিলে নাকি মালিনী কাকিমার বাড়ি থেকে একজন অপরিচিত লোককে ধরে বের করেছে। লোকটিকে কেউ চেনেনা, লোকটি নাকি বেডরুমে বেডের উপরে বসেছিলো।
রাজঃ কাকিমা কিছু বলল না?
ভাগীরথীঃ বলেছিল তো যে উনি নাকি কাকির ছোটবেলার বন্ধু। তার এই করুণ পরিস্থিতির অবস্থার কথা শুনেই নাকি ছুটে এসেছেন। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করলো না।
কৌশিকঃ কী বিশ্বাস করবে? কেন বিশ্বাস করবে? একেবারে যে হাতেনাতে ধরেছে। সবাই জানে মালিনী কাকিমা টাকা কামানোর জন্য কী করে! আর আগেও এমনটা হয়েছিলো। বল হয়নি?
দীপ্তিঃ তিন বছর থেকে একা একা থাকেন উনি। কত যুদ্ধ করতে হয়েছে নিজের সাথে। আর এই কয়েক মাস থেকে মদ খাচ্ছেন --- নিশ্চয় এমনি এমনি নয়। বাস্তব তাকে শিখিয়েছে এমনটা করতে, নয় তো কেউ নিজের সম্মান নিয়ে খেলা করে?
ভাগীরথীঃ আর তো বলিসই না। যারা ওই লোকটাকে ধরছে তারা কি কাকিমার দিকে শকুনের মতো ওঁত পেতে থাকে না? উফফ এমনি সময় তো কত ঢলাঢলি!
কৌশিকঃ তোরা সব ভুলভাল বকছিস। ওই লোকটা কাকির বন্ধু তোকে কে বলল?
দীপ্তিঃ কেন? তোরা কি কেউ কাকির কথা বিশ্বাস করিস না?
রাজঃ কেন করবো?
ভাগীরথীঃ তোরা যে সব পিকনিকে গিয়ে মদ গিলিস। সেই বেলায় বুঝি দোষ নেই? আর এখানেই যত সব রাজ্যের দোষ?
কৌশিকঃ আরে সেটা আলাদা ব্যাপার। পিকনিকে সবাই একটু আধটু খায়। আর এখানের ব্যাপারটা আলাদা। তুই বুঝতেই পারছিস না।
দীপ্তিঃ বুঝি, বুঝি, সব বুঝি। যত দোষ আমাদের।
রাজঃ ধুর, তোরা যে কী! সব বিষয়কে এতো পার্সোনাল নিয়ে নিস।
ভাগীরথীঃ বুঝি বুঝি। নিজেরা যে কত জায়গায় কত কিছু করে বেড়াও, একদিন এর সাথে আরেকদিন ওর সাথে ঘুরে বেড়াও, সেই বেলায় কোন দোষ নেই।
দীপ্তিঃ ওদিকে মলয় দা যে মালিনী কাকিমার দোকানে গল্প আর সিগারেট টানতে টানতে সারাটা দিন এবং সন্ধ্যা কাটিয়ে দেয়। কই সেই সময় তো কেউ আসে না। ও উনি একটু নাম ধাম করা রাজনৈতিক ব্যক্তি বলে নাকি? আর উনি কয়েকদিনের জন্য বাইরে গিয়েছে অমনি শুকুনের দল ঘিরে ঝাপটে ঝাপটে ঠোকর মারছে তাইতো। মলয় দা থাকলে এই রকম সাহস আর কেউ পেত না।
কৌশিকঃ আমার তো মনে হয় উনি নেই বলেই লোকটা বেঁচে গেছে। উনি থাকলে লোকটার হাড়হাড্ডি আর কিচুই থাকতো না। শেষ পর্যন্ত লোকটা যদি রঞ্জিত কাকুর পা না ধরতো তাহলে রেহাই ছিল না। লোকটা নির্ঘাত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেত কিংবা মর্গে! শেষে পাড়ার সম্মান রক্ষার্থে ছেড়ে দিলো। পিঠে যে উত্তম মধ্যম পড়েনি এমনটা নয়।
দীপ্তিঃ ও! পাড়ার সম্মান আছে, কাকিমার সম্মান নেই, না? মান সম্মান বুঝি এতই সস্তা যে এখন আছে দু-মিনিট পরেই নেই?
কৌশিকঃ কাকিমা সুন্দরী তাতে তার দোকান রমরমিয়ে চলছে। পান, সিগারেট, কোল্ড ড্রিঙ্কস তো ভালোই বিক্রি হয়। তাতে এইসব করবার দরকার ছিলো!
ভাগীরথীঃ হ্যাঁ দোষ এটাই, কাকি সুন্দরী। সুন্দরী হলেও দোষ আবার সুন্দরী না হলে তো কথাই নেই। আর এইসব বলে তুই কি ইঙ্গিত দিতে চাইছিস। কেন বলতো বিষয়টা এক তরফা দেখছিস বারেবারে। আর যদি কিছু করেই থাকে তো ভুল কী করেছে, আমি তো ভুল কিছু মনে করছি না।
কৌশিকঃ দ্যাখ তুইও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করছিস।
ভাগীরথীঃ তোরা পোশাক-আশাকেই আধুনিক হলই, মনের দিক দিয়ে আর হতে পারলি না।
রাজঃ কী সব বলছিস?
কৌশিকঃ পাড়াটা উচ্ছনে যাক তাই বলতে চাইছে।
দীপ্তিঃ আগে এটা ভাব যে, এরকম পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো।
কৌশিকঃ কিছু ভাব্বার নেই, আমি তো এটাকে সোজা কথায় ভুল মনে করি, বন্ধু হোক আর আত্মীয় হোক, সোজা বেডরুম!
ভাগীরথীঃ তোর মাথাটা ওখানেই আটকে গেছে বুঝতে পেরেছি। কী হয়েছে না হয়েছে, না জেনেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিচ্ছিস। তোরা আধুনিক হয়েও আধুনিক হতে পারলি না।
কৌশিকঃ থাক নাই বা হলাম আধুনিক। এই হচ্ছে আধুনিকের ছিরি! তুই বল ওটা ঠিক হয়েছে?
দীপ্তিঃ যাই বল, আমি কিন্তু কাকিমাকে দোষ দিতে পারবো না। সময় এই অবস্থা তৈরি করেছে। সমাজ কাকিমাকে এইরকম হতে বাধ্য করেছে। একটু হাসাহাসি করলেই তোদের এই সমাজ নারীদের বস্তু ভেবে বসে --- তাই নয় কি?
কৌশিকঃ ঢলাঢলি আর হাসাহাসি করেই তো দোকানটা রমরমিয়ে চলছে। তাছাড়া আমি এই সমাজেই থাকতেই চাই বুঝলে বাবাধনেরা!
দীপ্তিঃ ভিড়টা কারা করে থাকে? যেসব লোকেরা ঢলাঢলি করে ওদের বুঝি কোন দোষ নেই? সব দোষ এই মেয়েদেরই?
শুকনো পাতায় আগুন লাগলে আগুন যেমন দিকবিদিক জ্ঞ্যান শূন্য হয়ে বন্ধু আত্মীয় সমস্ত পরিচয়ের জ্ঞানহীন হয়ে চারিদিকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে তারপর শান্ত হয়ে চুপচাপ একলা বসে থাকে। ঠিক সেই সময়ে সেই রকম পরিস্থিতি উদ্ভব হতে যাচ্ছিল এবং আগুন লাগার ঠিক প্রাক মুহূর্তে উত্তাপ বুঝতে পেরে রাজ পরিস্থিতি সামলাবার জন্য হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলে, ‘যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। এখন আর এত বলে কী লাভ? কথা বাড়ালেই কথা বাড়বে।’
ভাগীরথীও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কথার মোড় ঘুরালো।
ভাগীরথীঃ তোরা যে পাহাড় গেলি কী কী দেখলি বল?
রাজঃ না তেমন ভাবে ঘুরা আর কোথায় হলো। গিয়েছিলাম শুধুমাত্র ওই দু-এক জায়গায়।
দীপ্তিঃ তাহলে আর কী লাভ বল? কিছুই যদি না দেখলি, তবে গিয়ে কী করলি?
কৌশিকঃ কেন রে জিনি তো সঙ্গেই ছিলো। ওটাই তো আসল লাভ! ( বলে হোহো করে হেসে উঠল)।
দীপ্তি কৌশিককে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘হ্যাঁ তুমি কাবাব মে হাড্ডি হয়েই থাকো!’ তর্ক বিতর্ক করতে করতে সন্ধ্যা আটটা বেজে যায় খেয়াল নেই। ঘড়ির দিকে তকাতেই ভাগীরথী বলে ওঠে, ‘শোন না আমি যাই। আমাকে পড়তে বসতে হবে।’ অর্থাৎ ইচ্ছে না থাকলেও তাদের এই নাটকের মঞ্চে বাধ্যতামুলক সমাপ্তি পর্দা টানতে হলো। হাসিমুখে কৌশিক দীপ্তি আর ভাগীরথীকে বিদায় জানাল।
তারা দুজনে চলে যাওয়ার পর আরেকটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট শেষ হয়ে এলো হঠাৎ করে যেন একটা ঝড় থেমে গেলো। একটা অশান্ত আবহাওয়ায় তছনছ প্রকৃতির দৃশ্য যেমন ভালো লাগে না ঠিক সেই রকম অস্বাস্তি হতে লাগল। দুজনে আর বেশিক্ষণ বসে থাকা সম্ভব হয় না। তাই অগত্যা রাজ এবং কৌশিককেও বাড়ির পথে পা দুটিকে অগ্রসর করতে হলো।
বারো
বি বা হ
বেশ কয়েকদিন কেটে যায় তবু ভানু মাসির গল্পটা পুরো শোনা হয়নি। অলস হাওয়া বইছে। ঘুম ঘুম পাচ্ছে কিন্তু এই ভর দুপুরে অভ্যাস মতো ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না। পাশের ঘরে মা ঘরের সব কাজ শেষ করে বাবার জামার বুকের বোতাম সেলাই করছে। সুযোগ বুঝে মায়ের কাছে অসম্পূর্ণ গল্পটা শুনতে চাইলো। মায়ের কাছে ঘেঁষে বললে, ‘মা, মাসির তো এটা দ্বিতীয় বিয়ে, আগেরটা কী হয়েছে? কেমন করে ডিভোর্স হল?’
‘ডিভোর্স আবার কিরে! কোন ডিভোর্স হয়নি। এমনি ছেড়ে দিয়েছে ভানু মাসিকে ওর বর।’
রাজ হাত পা গুটিয়ে ভালো করে বিছানায় ওপরে বসল। মা বুঝতে পারলো যে গল্পটা মন দিয়ে শুনতে চাইছে রাজ। বুকের বোতাম সেলাতে সেলাতে রাজের মা শুরু করলো গল্পটা
‘বুঝলি রাজ, ভানু মাসির একটা বন্ধু ছিল অর্জুন। অর্জুন খুব ভালোবাসতো তোর এই মাসিকে। ছেলেটি এসেছিলো বালুরঘাট থেকে এখানে কাজ করতে। আর তোদের মাসি সারাদিন বসে থাকতো মহানন্দা পাড়ে স্কুলে না গিয়ে। মহানন্দা পাড়ে বসে সারাটা দিন মাঝি-নৌকা-জেলে-বাচ্চাদের স্নান, পাখি এইসবই দেখত। আর এখানেই পরিচয় হয় অর্জুনের সঙ্গে ভানুর। কি সুন্দর নদীর পাড় দিয়ে ওঁরা ঘুরতো-ফিরত, গল্প করত। বেশ কয়েকমাস সব ঠিক ছিলো। কিন্তু যেদিন ভানুর দাদারা জানতে পারল, উফ সে কি রাগ। ছেলেটিকে ধরে কি বেদম মারটাই না মারলো। তার মধ্যে অর্জুনের বয়স ছিল কম। অর্জুনকে বেঁধে রেখেছিলো ভানুদের বাড়িতে। শেষে বাড়িতে পঞ্চায়েত বসলে বালুরঘাটে বাবাকে খবর দিলে বাবা ছুটে আসে। সেইসব গোলযোগের মধ্যে তো আমরা ঢুকতেই পারিনি। পরে যেটুকু শুনলাম ছেলেটির বাবা গ্রামের মোড়লদের হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেলো। আর এমুখো হয়নি কোনোদিন।’
‘তাই মা, মাসির প্রেমিক ছিলো! বাহ বেশ তো। মাসি এলে বলতে হয়।’
‘তোর মাসির কি মনে আছে নাকি! থাকতেও পারে। পুরো পাগল তো আর হয় নি।’
‘তারপর কী হলো?’
এতক্ষণ যেসব গল্প হচ্ছিলো কৌশিকের মা চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনছিল, আর থাকতে না পেরে ঘরে ঢুকে যায়। কৌশিকের মাকে দেখতেই রাজ উঠে দাঁড়ায়। তারপর বেরিয়ে যায়। বেরতে না বেরোতেই রাজ শুনতে পায় কৌশিকের মাও ভানুর ব্যাপারে জানতে ইচ্ছুক। তিনিও জিজ্ঞেস করে বলেন, ‘দিদি কিছুটা তো বাইরে দাঁড়িয়েই শুনতে পেলাম তারপর ভানুর কী হলো?’ রাজ চলে যায় পাশের ঘরে।
তারপর আবার বলতে শুরু করে রাজের মা।
‘অর্জুন চলে যাওয়ার পর রীতিমতো ঘরে বন্দি করে রাখতো ভানুদি-কে। স্কুলে যাওয়া বন্ধ। ঘরের মধ্যেই মা খাইয়ে দিলে খাওয়া হত, নয় তো আর নয়। দাদার শাসন, বাবার শাসন, মায়ের শাসন মনটা মুষড়ে যেতো। যেদিন আমি যেতাম সেদিন ঠিক গল্প হতো ঠিকই কিন্তু সেই আগের প্রাণোচ্ছল ভানুমতী আর ছিল না।’
‘শুধু ঘর আর ঘর। ভানুর মনমরা ভাব দেখে ঠিক ভালো ঠেকে না ওর মায়ের। গোপালী বুড়িকে ডেকে আনলে পরামর্শ দেয় যে খুব শীঘ্রই একটা বিয়ে দিয়ে দিতে। শুরু হল খোঁজ, অবশেষে পাওয়া গেলো পাত্র। শহরে একজন ব্যবসায়ী এবং জমির দালাল। দোষের মধ্যে শুধু তিনি কাজের মধ্যে এতটাই ঢুকে ছিলেন যে জীবনের ষাট শতাংশ বয়স খরচ করে ফেলেছেন নিজের অজান্তেই। তাও ধরা যাক বয়স ৪৫ এর মাঝামাঝি হবে। পাত্রীপক্ষ কোনরকমে ভানুর জীবনের প্রাক্ লীলার কথা ধামাচাপা দিয়ে দেয়। পাত্র ভানুমতীর রূপ সৌন্দর্য দেখে ভুলেছিলো। দাবি দাওয়া না থাকলেও বিয়ের আয়োজনটা বেশ জাঁকজমক ভাবেই করেছিলো।
‘ভানুমতীর বিয়ে বেশ আনন্দের, সম্পূর্ণ গ্রাম মিলে কাজে লেগে পড়লো, গোপালী বুড়ির নির্দেশে একে একে সমস্ত নিয়ম পালন হল। হলুদ কোটা থেকে শুরু করে অধিবাস, বৃদ্ধি, নদীর জল ভরা, স্নান, বরযাত্রী আপ্যায়ন, সিঁদুর দান, বাসি বিয়ে, একে একে সবটা নির্বিঘ্নে কেটে গিয়ে বিদায় জানান হল ভানুকে। সবটাই যেন রূপকথা।
‘দুবছর পর দ্বিতীয় বার ভানু বাড়ি এল, খুব কান্নাকাটি করে মায়ের কাছে। তার স্বামী খুব রাগি, তাকে নানাভাবে অত্যাচার করতেন। বাপের বাড়ি আসতে চাইলে আসতে দিতেন না। মা জানতে পারে যে ভানুকে মাঝে মধ্যে শোবার ঘরেও ঢুকতে দিত না। এমনকি এইবার শীতের কনকনে ঠাণ্ডাতেও রাতের অন্ধকারে ঘরের বাইরে বারান্দায় একলা কাটাতে হয়েছে।
‘আসলে ওর স্বামী শুধু চায় দেহ-যৌনতা। মদ গিলে গিলে যেদিন ভোর রাতে বাড়ি ফিরে এসেই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে সেদিন বুঝে নিতে হবে যে তার স্বামী আজ বেশ্যাপাড়া থেকে ফিরছে। আর যেদিন ঘুমোয় না সেদিন ভানুমতিকে বেশ্যার সাজ সাজতে হতো। নতুন রেশমি সিল্কের পাতলা শাড়ি, চোখে মোটা কাজল, মুখে কুমকুম দিয়ে তারপর গ্লাসে ঢালতে হবে মদ, স্বামীর মুখে মদ তুলে দিয়ে বিছানা গরম করতে হবে। যেদিন ভানু রাজি হয়না সেদিন কোমরের বেল্ট কথা বলে। এইসব সহ্য করতে করতে ভানু বুঝে যায় যে তার স্বামীর কাছে কখন কী রূপে দাঁড়াতে হবে। অবশেষে অত্যাচারের সীমা পেরিয়ে গেলে একদিন সে নিজেই চলে আসে বাপের বাড়ি।
‘মেয়ের আগের চেহারা নেই, রুগ্ন শীর্ণ ভাঙ্গা মুখখানা দেখে মায়ের বুক কেঁপে ওঠে।
‘অনিমা ছুটে আসে ভানুমতীর কাছে। বহুদিন পর দুজনের দেখা। ভানুমতী অনিমাকে দেখে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না চোখের জলে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। অনিমারও ভানুমতীর এই রূপ দেখে ভীত হয়ে চোখের কোণে জল চলে আসে।
‘দাদারা তেমন খুশি হতে পারেনি। আর বাবা মেয়েকে বোঝায় শ্বশুর শাশুড়ি নেই যাও একটা ননদ ছিল বিয়ে হয়ে গেছে এইরকম স্বামীর সংসার মানিয়ে নিতে হয়। সংসারে কতই না ঝামেলা থাকে তাই বলে সংসার ছেড়ে চলে আসবে!
‘গোপালী বুড়ি নিশিকান্তকে বোঝায় যে একদিন জামাইকে বাড়িতে ডেকে এনে সব বুঝিয়ে মেয়ে-জামাইকে আদর করে মিলিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে।
‘বেশ কয়েকদিন কেটে যাবার পর অনিমা আর ভানু দুজনে গল্প করতে করতে বেরিয়ে পড়ল তাদের প্রিয় মহানন্দা পাড়ে। মাঝিরা নৌকা বাইছে, জেলে জাল ছুরছে, ছেলেরা স্নান করছে নদীর জলে। দুজনে বসে বাঁধে। অনিমা জিজ্ঞেস করে, ‘তোকে খুব মারতো তোর বর? যখন খুশি তখন মারে?’
‘না রে, আমাকে তো মারে না।’
অবাক হয়ে অনিমা বলে, ‘তুই যে সেদিন বললি?’
‘সে কি মারের থেকে কিছু কম? ওর শুধু দেহের পিপাসা। যেদিনই বিছানায় উঠতে রাজি হব না, সেদিনি বেল্ট দিয়ে হাত বেঁধে ...।’
আর কথা বলতে পারেনা ভানু, হাত দুটো এগিয়ে দেখায় চওড়া বেল্টের ছাপ। মাটির পাত্র যেমন ক্ষয় হয়ে যায় ঠিক তেমনি হাতের কব্জিটা যেন ক্ষয়ে গেছে। অনিমার মুখ দিয়েও কথা বেরোয় না, শুধু চেয়ে থাকে।
ভানু আবার গুঙিয়ে গুঙিয়ে বলতে শুরু করৎ, ‘বুঝলি তো যেদিন রাতে ফিরবে না সেদিন বুঝে নিতে হবে ঠিক বেশ্যালয়ে আছে। প্রথম প্রথম বুঝতাম না। ভাবতাম না জানি কোন দূর-দূরান্তে জমির কাজের ব্যাপারে হয়তো ফিরতে পারে নি। কিন্তু যখন মদের গন্ধ মুখ দিয়ে ভক ভক করে বের হত আর জামাতে লাল লাল ছোপ ছোপ দাগ, বুঝতে আর দেরি থাকত না। মাঝে মাঝে কাজের লোকেরা যখন বাড়িতে আসত তখন এমন ঢলাঢলি করত যে স্ত্রী আর বেশ্যার মধ্যে কোন ফারাক রাখার চেষ্টা করত না। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হতো যখন রাতের অন্ধকারে ঘরেরর বাইরে বের করে দিত। আমাদের কোন ঘর নেই, তাই না অনিমা ?’
বলেই কাঁদতে শুরু করে দিলো ভানু। কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ওই যম যদি আবার আসে আমি বিষ খেয়ে মরব বলে রাখলাম তোকে!’
অনিমা ভানুর মাথাটা ধরে নিজের কাঁধে রাখলো। কোন সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পেলো না। শুধু চুপ করে বসে রইল।
তারপর একদিন সত্যি সত্যি ভানুর বর এলো। এতো প্রার্থনা, আর্জি, অনুরোধ চেয়েও কোন লাভ হল না। আবার তাকে ফিরে যেতেই হবে। ফিরতেই হবে ফিরতেই হবে, যমের দুয়ারে ফিরতেই হবে। এই ভাবতে ভাবতে বাড়িতে রাখা ধানের জমিতে দেওয়া বিষের বোতল থেকে বিষ পান করে নিল।
তারপর হাপাতাল। আর হাসপাতালে গিয়ে যে ব্যাপারটা ধরা পড়লো তাতে সবার চমক লেগে গেলো। ডাক্তারেরা গলার মধ্যে দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে বমি করাতে করাতে যেটা ধরা পড়লো সেটা হল গত দু মাস ধরে ভানুর গর্ভে ছিল একটা ভ্রুণ। ভানুর চেহারা এতই রুগ্ন ছিল যে সেটা কারোর চোখেই ধরা পড়লো না। অপারেশন থিয়েটারে ভানু জ্ঞানহীন হয়ে পড়েছিল। শেষে ভানু বেঁচে উঠলো কিন্তু যে অন্ধকারে সবে মাত্র রক্ত মাংসের মিলনে একটা দেহ গঠন হচ্ছিল সে সেই অন্ধকারেই তলিয়ে গেলো। অবশেষে যেটা দাঁড়াল, ডাক্তারদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষার মাধ্যমে রিপোর্ট অনুযায়ী, ভানু আর কোনোদিন গর্ভে সন্তান ধারণ করতে পারবে না। অতএব সে আর মা হতে পারবে না।
সেই সঙ্গে মস্তিষ্কে ঘটে গেলো এক ঝড়, অকালে পড়লো বাজ, ছিঁড়ে গেলো কয়েকটি শিরা উপশিরা, হিতাহিত শূন্য হয়ে পড়লো চেতন। অতএব ডাক্তারের নির্দেশে বাড়িতে চোখে চোখে রাখার পরামর্শ দিলেন। শুধু পাগল ঘোষণাটা করতেই বাকি রাখলেন। বাকিটা ইশারায় বুঝে নিলো পরিবার।
আর এখানেই বাধলো মস্ত বড় গোল। ভানু অসুস্থ তাই স্বাভাবিক ভাবেই থেকে গেলো বাপের বাড়ি। আর জামাই ব্যস্ত মানুষ, ব্যবসার কাজের জন্য বেরিয়ে গেলেন তিনিও। বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর দাদা যায় জামাইয়ের কাছে, কথা আদায় করে নিয়ে আসে যে সে একদিন এসে নিয়ে যাবে স্ত্রীকে।
তারপর একদিন-দুদিন, একমাস-দুমাস, বছরখানেক কেটে যাবার পর আবার বড়দা জামাইয়ের কাছে গেলে বিষয়টা এইরকম দাঁড়ায় যে, জামাই ভানুকে আর স্ত্রী রূপে স্বীকার করতে চায় না। এইরকম বাঁজা স্ত্রী সে চায় না যে তাদের বংশের প্রদীপ জ্বালাতে পারবে না, তাকে রেখে সে কী করবে? দাদা অপমানিত হলে পুলিশের কাছে খবর দেওয়ার কথা বললে, জামাই বলে, ‘তোমরা যে ছল চাতুরি করে ভানুর সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ছ সেই বেলা! তোমার বোনের যে আগের একটা সম্পর্ক ছিল, তা যে ধামাচাপা দিলে, তা জানতে বেশি সময় লাগে নি। এক কান দু-কান হতে সেই কথা আমার কানেও এসে পৌঁছেছে। তখন থেকেই সে সন্তান ধারনে অক্ষম। আর পুলিশের ভয় কাকে দেখাচ্ছ? আমার সব ওঠা বসা ওদের সঙ্গে। উলটে আমি তোমাদের ওপর মানহানির কেস দেবো। ভালো চাও তো ফিরে যাও।’
দাদা কিছু বুঝতে পারে না কী করবে, তার কাছে সবকিছু অন্ধকার ঠেকে। শেষে কিছু ভাবতে না পেরে পা ধরে বলতে শুরু কর- ‘বোনটার তাহলে কী হবে?’
জামাই বেশ স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয় যে, ‘তোমাদের বোন তোমরা কি করবে তোমাদের খুশি। বাড়িতে রাখবে না অন্য কারোর গলায় ঝুলাবে তোমাদের খুশি। আমি আর ওদিকে যাচ্ছিনে এই আমার শেষ কথা। ওইরকম পাগল নিয়ে আমি সংসার করবো না।’
খালি হাতে ফিরে আসে ভানুর দাদা। অন্যন্যরা বোঝায় যে ভালো করে জামাই কে বোঝাতে। কিন্তু মা আর রাজি হয়নি ওইরকম দানব জামাইয়ের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে। ভানুর মা বলে, ‘থাক, আমাদের মেয়ে যেমন আছে আমাদের কাছেই থাক।’
‘এতে ভানুর কতটা মন্দ হল তা জানিনে, কিন্তু নিঃসন্দেহে মুক্তি পেলো এটা বলাই যায়।’
ভানুর কথাগুলো বলতে বলতে চুপ হয়ে আসে রাজের মা। কেউ খেয়াল করেনি রাজ যে কখন দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছে। রাজের সামনে যে কথাগুলো বলবেনা ভেবেছিল, সেইসব কথা হয়তো রাজ সব শুনে ফেলেছে। তাই আর কপটতার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না। তাই রাজকে দেখে প্রথমে রাজের মা মাথা নিচু করে নেয় তারপর বলে, ‘আয় বাবা পাশে বস।’ কৌশিকের মা বলেন, ‘এসো রাজ, বসো।’
রাজ নির্বাক। গলাটা ভারী ভারী হয়ে আসে, চোখটা ভেজা ভেজা। কৌশিকের মা বলেন, ‘দিদি আমি আসি। অনেকক্ষণ হল এসেছি, বাড়ি ফিরতে হবে।’
রাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কথা বলবে কি না ভাবছে, ভাবছে যে আর কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে কি না। রাজের মা রাজকে দেখে বুঝতে পারে যে সে সবটাই জেনে গেছে তাই সে চুপ। তাই শেষে নিজেই বলতে শুরু করল, ‘বুঝলি রাজ তারপর থেকেই ভানুর মাথাটা যেন কেমন হয়ে গেলো। ও হয়তো এখন ভুলেই গেছে ওর সাথে যে এতবড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। হয় তো বিধাতা ওর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ইচ্ছে করেই ওকে সব ভুলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পুরো পাগল তাকে করল না। সব বুদ্ধি চুরি করল না। ও তো এখনও সবাইকে চেনে, হয় তো ঘটনা মনেও আছে। কী যে হল পরিষ্কার করে বলতে পারি না। তখন থেকেই সারাদিন খালি হাসে, কথা বললেই হাসতে থাকে। যেখানে হাসির কোন প্রয়োজন নেই সেখানেও হাসতে থাকে। যেখানে কাঁদার কোন দরকার নেই সেখানেও কাঁদতে থাকে।
‘তারপর আমার বিয়ে হয়ে গেলো বুঝলি রাজ। এখানে পরিচয় হল তোর ভীম ছেত্রী মেসোর সঙ্গে।ওনার স্ত্রী মারা গেছেন বহুদিন হয়েছে। মেয়ে ছিল বিয়ে হয়ে গেছে। লোকটা ভীষণ শান্ত তুই তো জানিসই। লোকটা সাত বছর ধরে একা একাই চলত ফিরত। আমি একদিন ইয়ার্কি করে বললাম, দাদা এই বয়সে আপনার কষ্ট আর সহ্য হয়না। একটা বিয়ে করলেই তো পারেন। লোকটা কোন প্রতিবাদ করলো না। শুধু হেসে বলল, বুড়ো বয়সে আবার বিয়ে, না বাবা সে ঝুঁকি আর নিচ্ছি না। কি হল আমারও ভানুর কথা মনে পড়ে গেলো। বলেই ফেললাম আমারও এক দিদি আছে, কথা বলে দেখতে পারি কিন্তু। তারপর দাদার কাছে ভানুর সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। বন্ধুত্ব, বিয়ে, মা হতে না পারার দুঃখ, কিছুটা পাগল। গল্প শুনতে শুনতে তার মনে মনে যে একটা করুণ রসের সৃষ্টি হচ্ছিলো তা মুখের উপরে শিরা উপশিরাগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। মুখ থেকে মায়া ঝরে পড়তে শুরু করেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম তাই আর জোর করি নি। কেন শুধু একটা আধপাগলীকে এখানে এনে ঝামেলায় ফেলা।
‘তারপর একদিন বাপের বাড়ি গিয়ে ভানুর মায়ের কাছে বিয়ের কথা পাড়তেই ভানুর বাবা এবারে রাজি হয় নি। কিন্তু আমার কথা শোনার পর ভানুর মায়ের ইচ্ছে হলো যে শেষকালে এই মেয়েটার একটা গতি করে দিলে সুখে মরতে পারেন। আর যেহেতু এখনে অনিমা সম্পর্কের কথা নিয়ে এসেছে তো সন্দেহের আর কোন জায়গা নেই। তাছাড়া ভগবান আর কত দুঃখই বা দিবেন, নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে, এই ভাবনা থেকেই ভানুর মা অনিমাকে পাত্রের কাছে খবরটা দিতে বললেন।’
‘ভীমদা এর কাছে গিয়ে রাজের মা বললেন, বুঝলেন দাদা একপ্রকার পাকা কথাই সেরে আসলাম। এখন আপনি মত দিলেই কাজ হয়ে যায়।
‘বেশ শান্ত ভাবেই অভিজ্ঞ সাংসারিক ব্যাক্তির মতোই জানিয়েছিলেন যে, সমাজে তাকে বাঁধা দেওয়ার মত আর কেউ নেই, তাছাড়া মেয়েটার গল্প শুনে বেশ মায়া হল বুঝলেন। আর এই শেষ বয়সে একটা সঙ্গী হলে মন্দ কি বলুন। শেষে একা একা কাটাতে হবে না। তবে বলে দিচ্ছি বিয়েটা করলে মন্দিরেই সারবো, সেই সব ঝক্কি আর নিতে পারবো না ক্ষমা করবেন।
‘অবশেষে দুই বাড়ির মতে ভীম আর তোর ভানু মাসির বিয়ে হয়ে গেলো। শুরু হয়ে গেলো তাদের দ্বিতীয় ইনিংস।’
রাজ উঠে যায় বিছানা থেকে। বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে, অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ, মাথা ঘুরতে থাকে, নানান হিজিবিজি কথা নদী-বিয়ে-মদ-যৌনতা-বিষ-গর্ভপাত-শিশু … না শিশু না শুধু রক্ত মাংসের পিণ্ড, শুধু গুচ্ছ রক্ত-বিষ-বিষ-অন্ধকার-অন্ধকার-চারিদিক অন্ধকার। দ্রুত জল দিয়ে মুখ ধুয়ে নেয় রাজ, তবু চোখ ঝাপসা ঠেকে, মস্তিষ্কে ঝিম ধরে আসে। বারংবার জলের ঝাপটা দেয় চোখে। সন্ধ্যার দিকে বেরিয়ে যায় রাস্তায়, সিগারেট ধরায়, একা একা হাঁটতে শুরু করে। তারপর আবার দাঁড়িয়ে পরে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে একটা মহিলা শিশুকে কোলে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গলির মোড় থেকে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আলো এলেই হয় তো আবার ফিরে আসবে।
তের
ক থো পক থ ন
শরতের আকাশ যেন নীল সমুদ্র, কোথাও কোথাও যেন রঙ তুলি দিয়ে সাদা রঙের আঁচড় টেনেছে কোন দৈব শিশু। বিকেল থেকেই ফুরফুরে হাওয়া বইছে। পাখিরা নিজের বাসায় ফিরছে, সাইকেল নিয়ে ফিরছে ব্যাগ ভর্তি সব্জি আর ক্লান্তি নিয়ে প্রত্যেক ঘরে ঘরে পিতারা। ঠিক সেই সময় নিত্য দিনের মতো একটি পাতলা কুর্তি পড়ে দীপ্তি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ভাগীরথীকে ডাকতে মাঠের গ্যালারীতে আড্ডা দেওয়ার জন্য। দীপ্তি ভাগীরথীকে ডাকলে বেশ স্পষ্ট ভাবে জানায় যে সে যাবে না। কিছুক্ষণ কী করবে না ভাবতে পেরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দীপ্তি। বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। ঠিক সেই সময়ে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল ব্যাপারখানা কী, তখনই ভাগীরথীর মা কাছে এসে বলল, ‘নিয়ে যা তো ওকে’। এরপরে দুজনেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। দীপ্তি এবারে পরিষ্কার করে বিষয়টি কি জানতে চায়। তাতে ভাগীরথী জানায় যে তাকে একটা ছেলে দেখতে আসবে বাড়িতে বিয়ের জন্যে।
গ্যালারীর কাছে পৌঁছে দেখে যে রীতিমতো বাকি দুজন অনুপস্থিত। গ্যালারীতে বসতে না বসতে কৌশিক হাজির।
দীপ্তিঃ তোরা প্রতিদিন লেট করে আসিস, রোজ রোজ অপেক্ষা করতে হয়, আমাদের কিন্তু ভালো লাগে না।
কৌশিকঃ ( একটু হেসে) কেন? অলওয়েজ লেডিস ফার্স্ট!
দীপ্তিঃ তোর বোরিং জোক ছাড়। আরেকজনের খবর কী?
কৌশিকঃ আসবে আসবে আমি তো গ্রুপে মেসেজ করে দিয়েছিলাম।
খানিকক্ষণ গম্ভীর থাকার পর ভাগীরথী বলে, ‘ডুমুরের ফুল’!
কৌশিক একটু অবাক হয়ে বলে, ‘মানে!’
দীপ্তিঃ সত্যি তুই কিছুই বুঝিস না। আরে রাজ তো সেই ডুমুরের ফুলের মতোই, কখনও কখনও ভুল করে অনলাইন দেখা যায়।
কৌশিকঃ ও তাই বল। আমি আবার এতো সাংকেতিক ভাষা বুঝি না বাবা!
এরই মধ্যে মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে রাজ এসে হাজির। পকেট থেকে লজেন্স বের করে কৌশিকের হাতে দিলে, কৌশিক বলে, ‘তোর কথাই হচ্ছিল।’
রাজ ভাগীরথীর এবং দীপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলো যে কিছু একটা হয়েছে। যা কিনা কৌশিক এতক্ষণ বিন্দুমাত্র টের পায়নি। রাজ বলে, ‘মনে হচ্ছে এই ঠাণ্ডা হাওয়ার মধ্যে একটা গরম গরম ভাব আছে’।
কৌশিকঃ হু আমিও তো তাই বলছি। কী হয়েছে বল তো। কেমন যেন একটা গম্ভীর গম্ভীর ভাব।
দীপ্তিঃ আরে বলিস না আজকে ওর মায়ের সাথে ওর ঝগড়া হয়ে গেল!
হঠাৎ করেই স্বভাব বশতঃ কৌশিক কথার মাঝখানে বলে ওঠে, ‘মানে!’
দীপ্তি রেগে গিয়ে বলে, ‘তুই খালি মানে মানেই কর! একটা কথা বলছি মাঝখানে খালি মানে আর মানে।’
রাজঃ আহ কৌশিক, বলতে দে না। তুই মাঝখানে কথা বলিস না।
দীপ্তিঃ বাড়িতে আজকে হঠাৎ করেই ওর মা ওকে বিয়ে কথা বলল। এর মধ্যেই নাকি একজন দেখতে আসবে তবে দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। আর তাতেই...
কৌশিকঃ এ তো বেশ মজার কথা! তাহলে আমরা অনেকদিন পর একটা বিয়ে খেতে পারবো বল, ঠিক বললাম না রাজ?
রাজঃ কেন ভাগীরথী --- তুই তো এখনো পড়ছিস, তাহলে তুই বল যে পড়া কমপ্লিট করে তারপর বিয়ে করবি।
চোখ মুখ লাল করে মাথা নিচু করেই বলে ভাগীরথী, ‘সেটা কি বাড়ির লোক জানে না?’
দীপ্তিঃ দেখছিস তো আমাদের প্রতিমুহূর্তে কত প্রবলেম ফেস করতে হয়। এভাবে কি পড়াশোনা করা যায়!
কৌশিকঃ তোর মা তো বিয়ের ডেট বা পাত্র কোনটাই ঠিক করে নি --- সো রিল্যাক্স।
দীপ্তিঃ ব্যাপারটা শুধু বিয়ে নয়। ব্যাপারটা এই যে প্রতিদিন বাইরের লোক এসে বাড়ির কানে ফুস মন্তর দিয়ে যায় মেয়ের বয়স নিয়ে --- তাতেই তো বাধে যতসব গোল।
কৌশিকঃ এ তো স্বাভাবিক, পাড়ার লোকের মাথাব্যাথা হবে না তো কার হবে।
রাজঃ বাড়ির লোক চিন্তা করবে না তো কে চিন্তা করবে? তাতে কি মনখারাপ করতে হয়।
ভাগীরথীঃ ও তোরা বুঝবি না। কারণ তোরা ছেলে।
কৌশিকঃ এখানে আবার ছেলে মেয়ে এই প্রশ্নগুলো আসে কোথা থেকে?
দীপ্তিঃ আসে আসে ও ঠিকই বলেছে তোরা বুঝবি না। কারণ তোরা টিউব লাইট!
রাজঃ টিউব লাইট হলেও ভালো, কারণ কিছুক্ষণ দেরি হলেও ব্যাপারটা তো বুঝি।
কৌশিকঃ এত চিন্তা করিস না। এখন গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হচ্ছে দুদিন পর চাকরি হবে।
রাজ পরিস্থিতি এবং গোমরা গোমরা মুখগুলো হালকা করার জন্য বলে, ‘চল একটা ট্যুর প্ল্যান করি’। আর সকলেই উৎসাহিত হয়ে বলে, কোথায় যাওয়া যায় বল।
কৌশিক বলে, ‘চাকরি পেলেই ভাগীরথী লঙ ট্যুরে নিয়ে যাবে’।
ভাগীরথী কৌশিককে বলে, ‘আমাদের কথা ছাড়! তোর তো হয়ে যাবে। তারপর তুই আমাদের নিয়ে যাবি’।
কৌশিকঃ এত সহজ নাকি চাকরি পাওয়া। আগে তো ঘুষের টাকা জোগাড় করি।
রাজঃ সে তুই ঠিকই বলেছিস। এখন যা অবস্থা, দু-দিন আগেই দেখতে পেলাম ভুয়ো ইন্টার্ভিউ। আর সেখানে কত ক্যানডিডেট টাকা দিয়ে স্বর্বস্বান্ত।
দীপ্তিঃ ঠিকই বলেছিস যা অবস্থা তাতে বেশি পড়াশোনা করেও লাভ নেই। কিছুদিন আগেই পেপারে দেখলাম এম.ফিল. করে ডোমের পোস্টে অ্যাপ্লাই।
কৌশিকঃ তোদের আর কী চিন্তা? চাকরি পাবি না, বিয়ে করে নিবি।
দীপ্তিঃ একদম বাজে কথা বলবি না। আমাদের তোরা চিনিস না। তোরা পুরুষ হয়ে কী ভাবে ভুলে যাস যে তোরা হয় তো চাকরিওয়ালা মেয়ে খুঁজিস নয় তো ষোল বছরের কচি খুকি খুঁজিস!
রাজঃ আবার কি নারী পুরুষ শুরু করেছিস বল তো! আমি গেলাম।
ভাগীরথীঃ ব্যস এইটুকুতেই! দাঁড়া দাঁড়া। তাহলে বোঝ আমার বাড়িতে কী রকম অনুভব হয়েছিল। তোরা তো বন্ধু আর এইটুকুই সহ্য হচ্ছে না?
কৌশিকঃ দেখ আমি আমার জীবনের সাথে ঠিক কিছু একটা করে নেবো।
দীপ্তিঃ যতটা সহজ ভাবে বলছিস ততটা সহজ নয়!
কৌশিকঃ তোর এতো গা জ্বালা করছে কেন রে? তোর মা তো আর তোর বিয়ে ঠিক করেনি, আর তোকে কিছু বলেও নি।
দীপ্তিঃ তুই তো একটা মস্ত বড় গাধা, বুঝলি? এটা একটা মেয়ের অসুবিধা হলে তো কোন ব্যপারই ছিল না। আজকে ওকে বলছে দুদিন পরে আমাক বলবে। প্রত্যেকটা মেয়ের এই-ই হয়ে আসছে। আর চাকরি পাওয়া তো সাধনার ব্যাপার। আর আমাদের সাধনা করার কোন অধিকারই নেই। মেয়েরা যেন সাধনা করতেই পারে না! তার আগেই হাত পা বেঁধে সাত পাক ঘুরিয়ে দেবে। সাধনা করার নো চান্স!
কৌশিকঃ কত মেয়েতো বিয়ের পরেও পড়াশোনা করছে। এমন কি আমি বেশ কয়েকজনকেও চিনি যারা চাকরিও পেয়েছে।
দীপ্তিঃ তাদেরকে স্যালুট জানাই। ব্যতিক্রম তো থাকবেই। কিন্তু তোরা ভাব, বিয়ের পর কি সেই কম্ফোর্ট জোন থাকে? তারপর বাচ্চা কাচ্চা হয়ে গেলেই তো ব্যাস আর কোন গল্পই নেই। সব হিসেব সব অঙ্ক গেলো চুকে!
দীপ্তি বাচ্চার কথা বলতেই রাজ যেন কী সব ভাবে। বিয়ে-বাচ্চা-সংসার। ভানু মাসিরও বিয়ে হয়েছিলো, পেটে বাচ্চা ছিলো, কিন্তু মা হতে পারল না। মাসি এতো দুঃখ কোথায় লুকিয়ে রাখে। মুখে যে এত হাসি, মাসি কি কাঁদতে ভুলে গেছে? আহ, ঈশ্বর কেন করলেন এইরকম মাসির সঙ্গে? হঠাৎ কৌশিক রাজকে ধাক্কা দিলে রাজ ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলে, ‘তখন থেকে তোরা কি নারী নারী করছিস।’
কৌশিকঃ সত্যি আজকে যেন কী একটা হয়ে গেছে। আড্ডা ঠিক জমছে না। ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইন্সটা। নতুন মিমটা দেখেছিস?
দীপ্তিঃ বল্লাম তো তুই একটা গাধা।
কাগজে আগুন লাগলে যেভাবে জ্বলে উঠে হঠাৎ ছাই হয়ে যায়, ঠিক সেই রকম ভাবেই তেজের সাথে জ্বলে উঠে কী একটা জোরালো প্রতিবাদ করতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলে চুপ হয়ে বসে পড়ল কৌশিক।
রাজ বলল, ‘ভাবছি এর মধ্যেই কল সেন্টার জয়েন করবো।’
ভাগীরথীঃ তাহলে দেখ তোরা কত সুযোগ পাচ্ছিস, তাও আবার পার্ট টাইম নিজের মতন করে। আর আমাদের তো হয়েই গেছে। পান থেকে চুন খসতেই বাড়ির কানে নানান কথা পৌঁছে যায়।
রাজঃ কেন? কত মেয়েই তো বাইরে কাজ করছে। ইচ্ছে থাকলেই পার্ট টাইম জব করে পড়াশোনা করতে পারিস। আমি বলি কি তুই তোর পড়াশোনা মন দিয়ে কর আর বাকি জিনিস সময়ের ওপরে ছেড়ে দে। এতো বেশি ভাবতে হবে না। আমার মনে হয় না বাড়ির লোক কোন সমস্যা সৃষ্টি করবে। তুই পড় পড়া শেষ করে কয়েক বছর চাকরির জন্য খাট । আর চাকরি পেলে কাকু কাকিমা নিজেরাই বুক চাপড়ে পাড়া ভরে মিষ্টি খাওয়াবে।
ভাগীরথীঃ সেটাই তো ভয়। চাকরি না পেলে কী হবে! যা পরিস্থিতি।
কৌশিকঃ আহ বেশি ভাবিস না তো। রাজ তুই আজকে মোমো খাওয়াবি বলেছিলি কিন্তু। চল না, মনটা বড় বেশি মোমো মোমো করছে।
সেই সময়ে ভাগীরথীর ফোনটা বেজে ওঠে। মা ফোন করেছে। মোবাইলে তাকাতে দেখে সময় অনেকটা হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে। আজ আর মোমো খাওয়ার সময় নেই তবে নিশ্চয়ই পরে একদিন খাবে।
তাই মোমোটা আজ খাওয়া হল না কারোরই। আর যে বেশি লম্ফঝম্ফ করছিলো তার সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হলো।
রাজ বলে, ‘বড়ে বড়ে সেহেরো মে ছোটে ছোটে বাতে হোতে রেহেতে হে। রাগ করিস না, এখন চল। মোমোটা কাল ফিক্সড।’
চোদ্দ
ভা নু ম তী এবং কি ছু ক থা
নীল আকাশে কিছু কিছু জায়গা জুড়ে সামান্য মেঘের ছটা। বাতাস শিউলির গন্ধে কাশ ভেসে বেড়ায়। সূর্য উঠলে আকাশের চারিদিকে নরম রোদ ছড়িয়ে পড়ে। পাখিরা বাসা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ভানুমতী। প্রতিদিনের ন্যায় ঘুম থেকে উঠেই উনুনের পারে বসে পড়ে। তারপর ফুঁ দিয়ে দিয়ে লাকড়ি আর শুকনো গোবরের জ্বালানীতে আগুন জ্বালিয়ে ভাতের হাঁড়ি চরিয়ে দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে নেয়। যেদিন ভীমের কাজ থাকে সেদিন ভীম সকাল সকাল খেয়ে বেরিয়ে পড়ে, আবার যেদিন কাজ থাকেনা সেদিনও স্টেশনে গিয়ে নতুন কাজ খোঁজে সেই সকালবেলাতে গিয়েই।
সকালে রান্নাবান্না শেষ করে স্বামীকে খাইয়ে বিদায় করলে ভানুর তেমন আর কোন কাজ থাকে না। যেটুকু সংসারের কাজ থাকে ঠিক ততটাই। এরপর সকাল সকাল স্নান সেরে অল্প কিছু খেয়ে নিয়েই বাসন-কোশন ধুয়ে নিজে তৈরি হওয়ার জন্যে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। পূর্বেই বলেছিলাম ভানু সাজগোজ করতে ভালোবাসে। ভানু নিত্য দিনের মত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবার নতুন করে মিলিয়ে নেয়। চিরুনি নিয়ে ভেজা চুলের উপরে চালিয়ে নেয় তারপর চুল খোলা রেখে দেয়। আলনা থেকে হলুদ পাড়ের লাল রঙের শাড়ী গায়ে দেয়। ভানুর কাছে শাড়ি অনেক রয়েছে। কারণ প্রত্যেকবার পূজাতে বেশ কয়েকটা শাড়ি পেয়েই থাকে পাড়া-প্রতিবেশিদের কাছ থেকে। তাছাড়া স্বামীও বছরে দু-তিনটে সুতির শাড়ি এনেই দেয় হাতে ভালো কাজ থাকলে।
আয়নার সামনে তৈরি হতে থাকে ভানু। গালে পাউডার মেখে, হাতে সামান্য পাউডার নিয়ে ঘাড়ে হাত বুলিয়ে নেয়। একটা লিপস্টিক রয়েছে সেটা আলতো করে ঠোঁটে লাগিয়ে নেয়। ধীরে ধীরে মোটা করে চোখের নিচে কাজল পরে। তারপর আলতা নিয়ে পায়ে পরে শুকিয়ে নিয়ে আবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আয়নার কোণে লাগানো অনেকগুলো টিপ থেকে কালো টিপ নিয়ে কপালে পরে আবার তা তুলে নিয়ে রেখে দিয়ে লাল টিপ পরে। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে নিজেকেই দেখে। তারপর তাকে আর কে আটকায়, ব্যাস বেরিয়ে পড়লো পাড়া টো টো করতে। এই রুটিন তার নিত্য দিনের এবং তা সকলেরই জানা। তাই সবাই অবচেতন মনে হলেও অপেক্ষা করতো, কখন ভানুকে দেখতে পাবে সকলে।
ভানু হাঁটতে হাঁটতে বাজারের পাশের এক কাপড়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। কাপড়ের দোকানের মালকিন তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে তারপর বলে, ‘আহা!’ আবার হেসে বলে, ‘ভানু তোর বয়স কত হলো রে? বাইশ হয়েছে কি? তাহলে তোর জন্য একটা পাত্র দেখতাম।’
‘আরে কী যে বলো, ভালো লাগে না, বরটা আমাকে দেখেই না, সালা বুড়া, শোনো না বুচির মা-টা না কী যেন আমার নামে সারাদিন বলতেই থাকে, ওর ভালো হবে না দেখে নিও। তুমি সত্যি বলছো আমার জন্য পাত্র দেখবে। ধুর মিথ্যে কথা বলছো আমি জানি। আমার বয়স বাইশ পার হয়ে গেছে আমি জানি।’
‘তুই ওইসব কথা ছাড় তোর বয়স বাইশ হয়নি আমরা জানি। আমরা কিন্তু তোর জন্য পাত্র দেখা শুরু করে দিয়েছি!’
ভানু শাড়ীটা দেখিয়ে দেখিয়ে বলে, ‘দেখ তো শাড়িটা কি সুন্দর না? টুপাইয়ের মা-টা একদম নতুন শাড়ি পরে না, সারাদিন একটা নোংরা শাড়ি পরে বাড়িতে কাটিয়ে দেয়। কত বলি ভালো ভালো শাড়ি পরো। কতবার আমি শাড়ি দিতে চাইলাম, আমার থেকে নেই-ই না। কথাটা শোনেই না।’
দোকানের কর্মচারী মোবাইলে একটা ফটো দেখিয়ে বলে, দেখো তো মাসি এই ছেলেটা কেমন, তোমার পছন্দ হয় নাকি?’
ভানু লজ্জা পেয়ে বলে, ‘ধুর আমার কি বিয়ের বয়স আছে নাকি! কই ছেলেটা, দেখি তো।’
কর্মচারী তারপর কাপড়ের প্যাকেট থেকে মডেলের ছবি দেখালে ভানু বলতে শুরু করে, ‘খালি খালি তোদের শয়তানি। ওই মেয়েটা দেখছিস ওই যে ওই যে ওই প্যাকেটের উপরে ওটাকে তুই বিয়ে করিস। শোন না বিশুর বৌটা একটা ছেলের সাথে লটরপটর আছে জানিস। আমি দেখেছি। আমি দেখলেই বুঝি বৌটা এক নম্বরের হারামি, আমাকে দেখলেই কেমন করে মুখটা ঘুরিয়ে নেয়। আমি যখন বিশুর মায়ের সাথে গল্প করি তখন বৌটা এসে বলে, তোমার কি রান্না হয়ে গেছে বাড়িতে! আমি কি ওদের বাড়িতে খেতে গেছি নাকি। তারপর ফোনের মধ্যে খালি টিপাটিপি করতেই থাকে। একদিন বললাম আমার দাদাকে ফোন লাগিয়ে দে, বলে কিনা ফোনে টাকা নাই। তোরা কিন্তু কেউ ওর সাথে কথা বলবি না, বলে দিচ্ছি আমি, একদম শয়তান...।’
আরও কথা বলতে থাকে, আর সেইসব কথা শোনার লোক কোনোদিনও ছিলো না। দোকানে কিছু কাস্টোমার চলে এলে ভানুকে বিদেয় করে। মালকিন ক্যাশবাক্স থেকে কুড়ি টাকা বের করে ভানুর হাতে দিয়ে বলে, ‘ভানু এই টাকাটা রাখ, এখন দোকানে লোক আছে, পরে আসিস, পরে কথা বলব।’
ভানু যেতে চায় না, লোক দেখে আরও গল্প জুড়ে দেয়, আর তাতে দোকানের কর্মচারীর অসুবিধা হওয়াতে একটা ধমক দিলো। মালকিন বুঝিয়ে বলে পরে আসতে।
তারপর ঝন্টুদের বাড়িতে ঢুকে, ঝন্টুর মা খুব ব্যাস্ত। কথা বলার সময় নেই, কিন্তু ভানুকে বিদায় করবার আগে তার হাতে দু প্যাকেট আটা ধরিয়ে দেয়।
একটা ক্যারিব্যাগে আটা নিয়ে ঘুরঘুর করতে করতে জ্যোৎস্নাদের বাড়িতে ঢোকে। তারপর সেই আটা দুটি জ্যোৎস্নাকে দিতে যায়, কারণ বাড়িতে রুটি বানানো ঝামেলা। কিন্তু জ্যোৎস্না আটা না নিয়ে উল্টে রেশন থেকে আনা আতপ চাল দিয়ে দেয়। ভানু জ্যোৎস্নাকে জানায় যে বিকেলে জমিতে যেতে, জমি থেকে শাক তুলে আনবে একসঙ্গে।
তারপর এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে দুপুরে গিয়ে বসে রাজের বাড়িতে। রাজের মা মাত্র স্নান সেরে পুজো দিয়ে উঠলো। ভানু জানে ঠিক এইসময়েই রাজদের বাড়িতে দুপুরের খাবার হয়ে থাকে। ভানু সঙ্গে করে আনা আটা এবং আতপ চাল দিতে চায় রাজের মা’কে। রাজের মা ভানুকে বোঝায় যে এইগুলি লোকে তাকে খেতে দিয়েছে, এইগুলি লোককে দিতে না, নয় তো লোকে পরে আর দিবে না। আসলে এইগুলো নিত্য দিনের রুটিন, এগুলো সবারি জানা।
দুপুরে বাড়িতে কেউ নেই। রাজের মা একাই খেতে বসলে ভানুকেও খেতে দেয়। কি রাঁধছিস, কখন রাঁধছিস, মাছের ঝোলে আরেকটু লবণ হতো, বাড়ির ভাতগুলো নষ্ট হল এইসব বলতে বলতে খাওয়া শেষ করে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। অতঃপর সন্ধ্যাবেলায় গল্প শেষ করে বাড়ি ফিরে যায়।
আবার পরের দিন নিজের পছন্দমতো পছন্দের বাড়িতে বাড়িতে জিনিসপত্রের যেমন আদান-প্রদান করে তেমনি গল্প করে কাটিয়ে দেয়। আবার যেদিন সে ঘর থেকে বেরোয় না সেই দিনেরও কৈফিয়ৎ লোককে দিতে হয়। আসলে লোকেও তার অপেক্ষা করে থাকে অভ্যাস মতোই।
এইখানে দুই একটা সামান্য কথা বলতে ইচ্ছা করি, পাঠকের কাছে। আশা করি আপনারা বিরক্ত হবেন না। আমরা যারা সাধারণ মানুষ অর্থাৎ নিজেদেরকে স্বাভাবিক এবং সচেতন জ্ঞ্যান উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বলে মনে করি একটু ভেবে দেখুন তো, আমরা কি কেউই কোন ক্ষেত্রে সামান্য হলেও অস্বাভাবিক আচরণ করি না? একটা পরিচিত মানুষ যখন আমাদের চোখের সামনে কোন দুর্ঘটনায় হঠাৎ করে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যায় তখন সে আমাদের কাছে হয়ে ওঠে করুণার পাত্র এবং তাদের পরিবার হয়ে যায় দয়ার সংসার। আর যে পুরো পাগল হল না কিন্তু মস্তিষ্কের সামান্য বিকৃতি ঘটে গেলো অথচ যার অতীত আমরা কেউই জানতে চাই না, যে কিছুক্ষণ বাদে বাদে অসংলগ্ন আচরণ করে, যুক্তিহীন কথা বলে, যার একটা কথার সাথে আরেকটা আচরণের কোন সম্পর্ক নেই, সে হয়ে যায় আমাদের কাছে হাস্যরসের বিষয় বস্তু। তাকে দেখলেই আমরা মনের মধ্যে কৌতুক সৃষ্টি করে তার সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে তামাশা করে ভাঁড়ে পরিণত করি কিংবা অবহেলা করি।
আমি কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি যে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন যাদের বয়সজনিত কারণে কিছু কিছু সামান্য স্মৃতি বিলুপ্ত হওয়াতে যখন স্বাভাবিক জীবন যাপনে অক্ষম হন এবং শিশুসুলভ আচরণ করেন তখন আমরা প্রায়ই তার জীবনের অধিকাংশ কর্ম জীবনকে মুল্য দিই না। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অবজ্ঞার পাত্র। আবার কোন শিশু যদি খোলা আকাশে ঘাস ফড়িঙের মতো নিজেকে মেলে ধরতে চায়, আমরা তাকেও দমন করে দেওয়ার চেষ্টা করি, অর্থাৎ শিশু শিশুর মতো আচরণ করবে, সে যদি আমাদের নিয়মের রাজ্যকে সামান্যতম হলেও বিঘ্ন ঘটাতে চেষ্টা করে তবে তাকে তখনই নির্বাসন দেওয়া হয়ে থাকে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে প্রতিনিয়ত আমাদের মন থেকে নরম নামক বস্তুটা কঠিন পাথর হয়ে উঠছে, কোন এক অজানা উদ্দেশ্যে।
এখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে অনেক কষ্টে নীল আকাশ দেখা যায়। বহু বাঁধা অতিক্রম করে বাতাসকে যেমন জানালা দিয়ে প্রবেশ করতে হয় ঠিক তেমনই খুব সামান্যই প্রবেশ করে হলুদ আলো। একের পর এক গাছ কেটে ফেলে আমরা প্রতিনিয়ত গ্রাম ছেড়ে শহরায়নের দিকে ছুটছি। এই যে রোজ একটু একটু করে শহর গ্রামে ঢুকে মাঠ ঘাট। খাল-বিল-ডোবা পুকুর হত্যা করে সুস্থ সবল নদীকে জরাজীর্ণ করে তুলছে, তাতে কারোরই কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
একটু খেয়াল করে দেখবেন ছোটবেলায় যেসব পাখি দেখতেন বিকেলের মাঠে, যেসব ফড়িং দেখতেন ঘাসের উপরে, ফুলের উপরে যেসব প্রজাপতি দেখতেন, আঁধারে জোনাকির আলোর সঙ্গে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ শুনতেন সেইসব তো কবেই আমরা অজান্তে মাটি চাপা দিয়ে কবর দিয়ে দিয়েছি। আর এখন চাঁদ দেখতে হলে আকাশে তাকালেই হল না ঠিক কোন বিল্ডিঙের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে তাও ঠিক করে নিতে হবে কল্পনা পিপাসু প্রেমিককে।
এর ফলে আমাদের মন রোজ রোজ উগ্র হয়ে উঠছে। যেখানে দুটো স্বাভাবিক কথা বললেই সব ঝামেলা চুকে যায় সেখানেও আমরা দুটি কটু কথা না বলে থাকতে পারছি না।
সামান্য কথা বলতে গিয়ে হয়তো কিছু অসংলগ্ন কথা বলে ফেললাম। এবারে হয়তো আপনারা ভাববেন আমিও ভানুর মতো পাগল। যেখানে যে কথাটি খাটছে না সেখানেও এসে ভুলভাল কথা বলে গেলাম।
এবারে আপনারা বলবেন, যেটুকু পড়লাম সেখানে তো আপনার কথার সাথে রচনাংশের কোন মিল পেলাম না মশাই। তবে বলি এখানে ভানুর সাথে অন্য সব চরিত্রের সৎ ব্যবহারের চেষ্টা করেছি মাত্র, নয় তো আপনারা সবই জানেন চারপাশে কী হচ্ছে।
এই যে উপন্যাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আপনারা এই নবীন লেখকের সামান্য কিছু যুক্তিহীন কথা শুনলেন তার জন্য ধন্যবা। আর যারা মেজাজ হারাতে যাচ্ছেন তারা যেন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি সহ ক্ষমা প্রদান করবেন।
পনের
ম হা ন ন্দা
শীতের বিকেল রাজ আর জিনিয়া একসঙ্গে বেড়িয়েছে বাইকে করে ফাঁসিদেওয়া অঞ্চলে ঘুরতে। জিনিয়া ভানুর গল্পের সেই মা কালীর মন্দির দেখতে চায়। জিনিয়া সবে মাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে আর রাজ কম্পিটিটিভ এক্সামের জন্য কোচিং সেন্টারে। পড়াশোনার তেমন কোন চাপ নেই, অতএব সুযোগ বুঝে দুজনেই চলে এলো।
ফাঁসিদেওয়া বয়েজ হাই স্কুলের বাম পাশে কালী মায়ের মন্দির। ছোটবেলায় রাজ পুজার সময় মামার বাড়ি এলে সে সারাদিন এখানে মেলায় পড়ে থাকতো। জিনি এই প্রথম এসেছে এই অঞ্চলে।
প্রথমেই তারা প্রবেশ করলো মন্দির প্রাঙ্গনে। মন্দিরের কলতলায় হাত পা ধুয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে। আহা মূর্তির কী সুন্দর রূপ! কী উজ্জ্ব! চোখে যেন ধাঁধাঁ লেগে যায়, মুগ্ধ হয়ে যেন সারাক্ষণ চেয়ে থাকি এই মুখের দিকে। এইরকম ভাবেই জিনিয়া চেয়ে ছিল মায়ের মুখের দিকে। তারপর হাত জোড় করে নতজানু হয়ে মায়ের কাছে রাজ আর জিনির সম্পর্কের বন্ধন যেন আরও গভীর হয় এইটুকু মনে মনে চেয়ে নেয়।
মন্দিরে কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর রাজ জিনিকে মন্দিরের সামনের গলি দিয়ে নিয়ে যায় মহানন্দা তীরে।
রাজ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ‘ওই যে দেখা যাচ্ছে নদীর ওপারে ঘরগুলো এমনকি নৌকাগুলি আর নৌকা করে ওপরে মানুষগুলো সব জাল ফেলছে, ওটা কি জানিস! ওটা হলো বাংলাদেশ।’
জিনি অবাক হয়ে যায়, প্রথমে সে বিশ্বাসই করতে পারে না সে এতো সহজে বাংলাদেশ দেখতে পাবে।
হাঁসগুলো নদীতে মাথাটা ডুবোচ্ছে আর তুলছে, পাখিগুলো আকাশ দিয়ে উড়ে ওপারে চলে গেলো। মাঝখানে কোন কাঁটাতার নেই। জিনি ভাবে, ইস ওই পাখিদের মতো যদি সে উড়ে ওপারে যেতে পারতো। যেমনি ভাবনা তেমনি বলে ফেলা।
রাজ সতর্ক করে দেয় যে, ‘নদীর মাঝখান বরাবর যাওয়ার পড় কোন দিক থেকে যে গুলি এসে লাগবে, তা আমরা কেউই বিন্দুমাত্র টের পাব না!’ আরও বলে, ‘সংবাদপত্রে দেখিস না মাঝে মাঝে রাতের অন্ধকারে সীমা পেরোনোয় জওয়ানের গুলিতে অনুপ্রবেশকারীর হত্যা!’
জিনি মনে মনে যতটা সহজ ভেবেছিলো ঠিক ততটা সহজ ব্যাপার নয়। দুজনেই বাঁধের উপরে এসে বসলো। নদী আপন মনে বয়ে যায়।
নদীর ওপারের লোকগুলোকে দেখতে দেখতে জিনির মনে পড়ে যায় ইতিহাসের পাতার কথা। জিনি একা একাই বলতে শুরু করে দিলো- ‘১৯৪৭ এ নেহেরু-জিন্নার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেশ ভাগাভাগি হয়ে গেলে, বাংলার মানুষের জীবনে শুরু হয় অনিশ্চয়তা এবং দাঙ্গা। জাতি-দাঙ্গার রক্ত রূপ দেখেছে পূর্ববাংলার মানুষগুলো। মানুষগুলোর কী দোষ বল! কী সুন্দর সবাই একসঙ্গেই তো ছিলো! তারপর কত লোক ওপার থেকে এপারে চলে এলো, আজও লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক আসছে। ওই অসহায় সম্বলহীন উদ্বাস্তুরাই তো এদেশে বাঙাল নামে পরিচিত।’
জিনি একবার ইতিহাসের কথা শুরু করলে আর থামতেই চায় না যতক্ষণ না বক্তব্য শেষ হচ্ছে। তারমধ্যে পেয়েছে একজন ভালো শ্রোতা, এই সুযোগ কিছুতেই সে হাত ছাড়া করতে চায় না, সে আরও বলে, ‘এই উদ্বাস্তুদের মধ্যে সব শ্রেনির মানুষ ছিলেন শ্রমজীবী থেকে বুদ্ধিজীবী, চাষি, কামার, কুমোর, ধোপা, নাপিত, পুরোহিত থেকে শুরু করে সকলে। তারা এখানে এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লেন।’
জিনিয়া একটি গবেষণার বই পড়ে আরও জানতে পারে যে ‘যখন এই বাঙালরা পূর্ববঙ্গের সীমানা অতিক্রম করে তখন থেকেই কলকাতা পর্যন্ত অঞ্চলের রূপরেখা পাল্টাতে লাগলো হঠাৎ করে। তাদের সংসার বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা আর কর্মের কোন বাছবিচার রাখলেন না। যে যা কাজ পেলেন তাই করতে লাগলেন। আর যারা কাজ পেলেন না তারা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে কুলির দলে যোগ দিতে লাগলেন। বাড়ির মহিলারাও ঘরে বসে থাকলেন না। মাঠ-ঘাট, পুকুর-ডোবা ইত্যাদি জায়গা থেকে মানকচু, কলমিশাক, কচুর শাক, কচুর লতি, শালুক ফুল, শাপলা, নলতে শাক প্রভৃতি তুলে এনে নিজেরাই বাজার সৃষ্টি করে বসলো। এইভাবেই মাঠ ঘাটের অবৈধ শাক সব্জি শহুরে ঘরে প্রবেশ করতে লাগলো।’
জিনিয়া সেই গবেষণা গ্রন্থের জনৈক ব্যাক্তির জীবনী থেকে জানতে পাড়ে যে ‘৪৭-এর দেশ ভাগের আশেপাশের সময় ধরে সেখানকার সম্পন্ন হিন্দু গ্রাম তথা দেশ ছাড়তে শুরু করলেন। চলে এলেন বিভক্ত ভারতবর্ষে। সেখানকার প্রতিবেশি মুসলিমরাও চায়নি যে তাদের এতদিনের পড়শি সব তাদের ছেড়ে চলে যাক। বরং উল্টে তারা প্রতিনিয়ত গ্রামের হিন্দু ভাইদের আশ্বাস দিয়ে যেতেন, যে তারা যেন গ্রাম ছেড়ে না যান, তাদের পাশে সর্বত্রই তারা থাকবেন। কিন্তু কিছুই করার থাকে না, কারণ শাসনের দন্ড ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। তারা নামিয়ে দিলেন সেনাবাহিনী। শুরু হল দাঙ্গা-অত্যাচার-হত্যা-ধর্ষণ। যার ফলস্বরুপ সকল হিন্দুরাই পালিয়ে আসতে চেষ্টা করলো, ভারতবর্ষের বুকে নরম মাটির দেশ বাংলাদেশ ছেড়ে।’
রাজ ভাবে অন্য কথা, তাকিয়ে থাকে নদীর জলের দিকে। এই নদীর মতো কোনদিনই বুড়ি বালাসন গর্ব করে বলে উঠতে পারবে না ঝাঁপ দাও আমার বুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাই কোন অজানার দেশে। আর ভাবে ভানুর কথা। ভানু বাংলাদেশ থেকে আসেনি, এসেছে আসাম থেকে, তবুও সে উদ্বাস্তুর মতোই জীবন কাটিয়ে দিল। মা বলেছিলো এই মহানন্দা পাড়েই ভানুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো অর্জুনের। তারপর কত জল গড়িয়ে যায়। বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, প্রেম আরও কত কিছু। বোধ হয় এই বাঁধের পাড় দিয়ে হেঁটে বেরাতো ভানু। হয় তো এখানেই এসেই কত না গল্প করতো দুজনে। ভানু আর অর্জুন, অর্জুন আর ভানু কেউ কোথায় নেই। যদি অর্জুনের সঙ্গে ভানুর বিয়ে হতো, তাহলে তো পরিচয়ই হতো না কিংবা একটা ট্র্যাজেডির গল্পও সৃষ্টি হত না। এই নদী একটা পরিণতির সাক্ষী থাকতে পারলো না, তার আবার কিসের গর্ব! কিংবা ভানুর ক্ষেত্রেই শুধু ব্যাতিক্রম ঘটে গেলো। হিজিবিজি ভাবতে থাকে রাজ। শীতের বিকেলে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চলে আসে। মাথাটা ধরে যায়। হালকা করে মাথাটা জিনির ঘাড়ে এলিয়ে দিলো রাজ।
জিনি আর রাজ পাশাপাশি নিরব, নিরবেই হাতে হাতটা রাখে। রাজ জিনির কাজল দেওয়া চোখে চোখ রাখে। প্রজাপতির ন্যায় ছুটোছুটি করছে চোখের মণি। জিনির বুকটা দুরুদুরু করতে থাকে। শীতল হওয়া বয়ে যায় পূর্ব থেকে পশ্চিমে। গোলাপে চুমু দেওয়ার মতোই রাজের গালে আলতো করে চুমু দেয় জিনি। পাপড়ি ঝরার মতোই ঝরে পড়ে রাজের ঠোঁটে জিনির ঠোঁট। শিরা উপশিরা দিয়ে বয়ে রক্তস্রোতের বেড়ে যায় গতিবেগ। গলার স্বরে ফাটল এসে যায়। আবারও ঠোঁট এগিয়ে দিয়ে শক্ত করে বাহুর বেষ্টনীর মধ্যে জড়িয়ে ধরে রাজের ঘাড় জিনিয়া। হঠাৎই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলে টুপটাপ করে ভিজতে শুরু করে দুজনের জামা, হঠাৎই একটা বিদ্যুৎ চমক দিলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে, কী করবে তৎক্ষণাৎ মাথায় খেলে না।
তখনই পাশের সেনা ছাউনি থেকে মাথায় পাগড়ী পড়া এক সৈনিক ডাক দিলেন তাদেরকে, আপাতত আশ্রয় নেওয়ার জন্যে। জিনি দৌড়ে চলে আসে। জিনির দৌড় দেখে রাজ থমকে দাঁড়িয়ে ছিলো। দেখছিলো কী ভাবে ফড়িং উড়ে যায় আশ্রয়ের খোঁজে।
জিনি চিৎকার করে ওঠে, ‘ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজবি নাকি?’ রাজও চলে আসে।
সেনা ছাউনিতে পাগড়ী পড়া পাঞ্জাবী সেনা য়ুনিফর্মের বুকে নেম প্লেটে নাম লেখা রয়েছে হরবিন্দর সিং। হাতে একটা রাইফেল। গলায় দূরবীন। সে বললে, ‘কিয়া হুয়া বেটা উহাপঢ় অ্যাইসে খাড়া কিউ হো গেয়া?’
‘কুছ নেহি আঙ্কেল। অ্যাসে হি।’
‘আপকা নাম কিয়া হে বিটিয়া?’
‘জিনিয়া। দোস্তলোগ জিনি বোলকে বুলাতি হে।’
‘বাহ! বহুত খুবসুরত নাম, জিনিয়া। মেরা ভি আপকি জ্যাসে এক বিটিয়া হে। ও আভি কলেজ মে পঢ়তি হে।’
‘আপকি বিটিয়া কে নাম কিয়া হে?’
‘মেরে বিটিয়া জসপ্রীত।’
রাজ জিজ্ঞেস করে, ‘আপ কাহাসে হো?’
‘মে হরিয়ানা সে হু। ইহা পে তিন সাল হো গয়া। ইসসে পেহেলে পোস্টিং পাঞ্জাব বর্ডার মে থা।’
জিনি জিজ্ঞেস করে বাড়িতে আর কে কে রয়েছে। তিনি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তার পরিবারে ফটো দেখালেন, মা, বাবা, স্ত্রী এবং একমাত্র কন্যাকে দেখালেন। মেয়ের ফটো দেখাতে দেখাতে চোখের কোণে জল চলে আসে। আর বলে-‘বহুত প্যায়ার করতা হু বিটিয়া কো, বহুত ইয়াদ আতা হ্যে মেরা পরিবারকা। দোস্তলোগ অউর সরসো কা খেত বহুত জাদা মিস করতা হু!’
রাজ অবাক হয়ে যায় এইরকম একটা লম্বা চওড়া হোমরা লোকের চোখেও জল আসতে পারে। এইরকম একটা কঠিন দেখতে লোকের মাঝেও নরম একটা হৃদয় রয়েছে।
বৃষ্টিটা যেমনভাবে এসেছিলো হঠাৎ ঠিক তেমনি হঠাৎ কমে গেলো। অতঃপর দুজনে সেই সেনাকে বিদায় দিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো।
জিনিয়া কে বাড়িতে দিয়ে এসে ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে যায়। খাওয়া শেষে বিছানায় একা ঘুমোতে গেলে নানান চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।
ভানু-অর্জুনও বোধ হয় এভাবে তাদের আজকের মতো দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছে নদীর বাঁধে। কত স্বপ্নই হয়তো দেখেছিলো, পায়ে পায়ে হেঁটেছিলও, পাশে বসেছিল, চুমু খেয়েছিলো, তারপর হঠাৎ বৃষ্টি, হয় তো তাদের মতো একদিন এভাবে দৌড়ে আশ্রয় নিয়েছিলো সেনাছাউনিতে।
সেনার চোখেও জল, এতো মস্ত একটা লোকের চোখেও জল। তাহলে যে আমরা রোজ রোজ এতো অভিনয় করি, সবকিছুকে তুচ্ছ জ্ঞান করি, বৃহৎকে ক্ষুদ্র করি, ক্ষুদ্রকে বৃহৎ করি। মনের ভিতরে ভিতরে অহং সৃষ্টি করি। নিজেক কোথাও ভাসাতে ভয় পাই, বারংবার নিজেকে রক্ষা করি দেওয়াল দিয়ে ঝড়ের। প্রতিনিয়ত মস্তিষ্কে শান দিয়ে দিয়ে হৃদয়ের উন্নয়ন ঘটাই, তবুও কি দীর্ঘ ঘষামাজার পর মায়া-বন্ধন জীবন থেকে মুক্ত হতে পারি!
উফফ! কী সব ভাবছে রাজ? ঘুমটাই আসছে না, শুধু ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে। একটু ওলট পালট হয়ে আবার ঘুমোতে চেষ্টা করে। মাথায় আবার চলতে থাকে—হয়তো আমরা কিছুই পারি না, এই নদীর মতোই আমাদের জীবন বয়ে চলে। ইচ্ছে করলেই ফেরত আসা যায় না। ফিরতে হলে হয়তো অনেক কিছু ত্যাগ করে ফিরতে হয়। হয়তো তখন লোক তাকে ফকির বলে। আমরা ফকির সবাই ফকির এই বৃহৎ সংসারের কাছে সকলেই ফকির!
অবচেতন মনে এইসব ভাবতে ভাবতে ভোর রাতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে রাজ।
ষোল
দো ল এবং মৃ ত্যু
রাস্তাতে ধুলো উড়ছে। আতা গাছের পাতা ঝরা ডালগুলিতে অনেক আতা ধরে রয়েছে। আর সেই ডালে সকাল থেকে বসে একটি কোকিল চেরা গলায় কুহু ডেকেই চলেছে। গাবগছের কাঁচা সবুজ খয়েরি নতুন লম্বা পাতা টকটকে হয়ে ঝুলছে। নিম গাছে সিম ফুলের মতো বেগনি ফুল থোকা থোকা ফুটে রয়েছে। ডালিম গাছে পলাশ রঙের ডালিম ফুল ফুটে রয়েছে। আর রাস্তাতে ধুলো উড়ছে। এই ভর দুপুরে ফাঁকা রাস্তায় ভ্যাপসা গরমেও যখন কোন লোক দেখা যায় না তখনও দুটি বাচ্চা ছেলে ময়লা হাতে পায়ে পড়ে থাকে কুল গাছের নিচে। আর দূর থেকে ভেসে আসে কাঠের ঠক ঠক আওয়াজ। নিশ্চয়ই কোথাও ঘর বানানোর কাজ চলছে।
ফাল্গুন মাস পূর্ণতিথি। পূর্ণিমা পলাশ ফুলের সুগন্ধি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ করেই মাঝে মাঝে দেখা দিচ্ছে ধনেশ পাখি। রাধা জ্যোৎস্নায় পরিপূর্ণ এই পৃথিবী। আকাশ থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে কুমকুম রঙের আবীর।
আকাশের পূর্ব দিকে শুকতারা তখনও হীরের মতো চকচক করছে। পাখিরা নিয়মিত লাগাতার ডেকেই চলছে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে যেন একটা উৎসবের আমেজ। আর কাল দোল উৎসব অর্থাৎ হোলি। তার ওপর কাল ব্রজলীলার শ্রেষ্ঠ লীলা দোল, চৈতন্যদেবের জন্মদিন। পাড়ায় শুরু হবে অষ্টপ্রহর কীর্তন।
ভোরে অধিবাসের পরেই শুরু হয়ে গেলো একনাম হরিনাম সঙ্কীর্তন। ভানুও সকাল সকাল চলে আসে কীর্তন শুনতে। অগত্যা বাড়িতে কিছুই রান্না করেনি বরং স্বামীকে বলে আসে যে দুবেলা যেন কীর্তনের প্রাঙ্গন থেকে খেয়ে আসতে।
একনাম কীর্তন চলতে থাকে সেই সঙ্গে গানের তালে তালে ভানু কীর্তনিয়াদের সঙ্গে সঙ্গে নেচে ওঠে। আবার যখন কীর্তনিয়াদের কণ্ঠে করুন রস উদ্বেলিত হয় তখন কান্নায় ভেসে যায় ভানু। এভাবেই সারাদিন ভানু কীর্তনের আসরে কাটিয়ে দেয়।
সন্ধ্যা বেলা শুরু হয় সন্ধ্যারতি। দশজন পুরুষ কীর্তনিয়া খোল করতাল নিয়ে প্রবেশ করলে এবং দুটো শিশুর একজন মুখে নীল আবীর মেখে হাতে বাঁশি আর অন্যজন শাড়ী, মাথায় মুকুট পড়ে রাধা সেজে বাদ্যের তালে তালে নাচতে শুরু করলে আর কেউই বসে থাকে না আসরে, সকলেই দাঁড়িয়ে বাহু তুলে রাধাকৃষ্ণ নাম জপ করতে করতে বাদ্যের তালে তালে নেচে উঠে।
পরের দিন সকালে বেরলো নগর কীর্তন সঙ্গে রইলো ভানু। কৃষ্ণ নাম জপ করতে করতে পাড়া দিয়ে ঘুরতে শুরু করলো, মাথায় গোপালকে সঙ্গে করে নিয়ে। প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি প্রবেশ করে গোপাল, তারপর চলে আবীর দেওয়া, তারপর সন্ধ্যা প্রসাদের জন্য চাল, ডাল সব্জি দান।
এইভাবেই নগর ভ্রমণ করতে করতে হঠাৎই ঘটে যায় একটি ঘটনা। আর সেটি হলঃ নগর ভ্রমণ শেষে কীর্তনিয়াদের মধ্যে কয়েকজন ভাঙের নেশা করেছিলো। আর সেই দুই একজন লোক ভানুকে ভাঙের ঘোল খাইয়ে দেয়। তারপর ভানুকে আর কে সামলায়। সকল লোকের মাঝেই চিৎকার করে হো হো করে হাসতে শুরু করে, একবার এদিক দোলে আরেকবার ওদিকে দোলে। পাহাড় পাহাড় বলে চিৎকার, এই পড়ে যাবো পড়ে যাবো, এই ধরবি না কেউ আমাকে ধরবি না আমার কিছু হয় নি --- এই বলেই আবার নাচতে শুরু করে লাফাতে শুরু করে। আবীর ছুড়তে শুরু করে, আবীর নিজের মুখে মাখে। পুরুষ মানুষের সামনে ঢলতে থাকে, আর বলে, ‘আমাকে বিয়ে করবি, আমাকে বিয়ে করবি, আমার কিন্তু এখন বাইশ, আমি বিয়ে করব! এই নে তোর মুখে আবীর মেখে দিলাম, এই কে আছিস কে আছিস আমাকে আবীর দে আমাকে আবীর দে, এই নে চুল ছেরে দিলাম, দে দে আবীর দে, আমি বিয়ে করবো, এই নে তোর মুখে আবীর মেখে দিলাম, আমাকে আবীর দে।’
গান শুরু করে দেয় ভানু-
‘ওরে তোরা আমায় বিয়ে কর
তুই হবি আমার বর
ওরে তোরা বিয়ে কর আমায়
কৃষ্ণের মত মুকুট পড়ে কাছে আয়
আমি হব রাধা
তোরা হবি কানু হারামজাদা।
আমায় বিয়ে কর ...’
অন্য একজনকে কৃষ্ণের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, ‘এই তুই কৃষ্ণের মতো দাঁড়া আমি রাধার মতো দাঁড়াই। দেখ দেখ আমার শাড়ীটা দেখ কি সুন্দর! এই এই এই মাটি দুলছে কেন? ভুমিকম্প হচ্ছে কেন রে? দেখ দেখ সুপুরি গাছটা দুলছে, দেখ দেখ রাধাকৃষ্ণ নাচছে ...।’
এই দেখে বাচ্চাদের মধ্যে আরও বেশি কৌতূহল। সকলেই হো হো করে হাসছে। বাচ্চাগুলো দৌড়ে দৌড়ে আবীর ছুঁড়ছে। কয়েকজন যুবক বলছে মাসি আরও ঘোল খাবে নাকি! আবার কেউ কেউ বলছে, ‘আমি করবো, আমি বিয়ে করবো, আমি আমি।’
আর অনুষ্ঠানের দায়িত্বে যেসব ব্যক্তিরা ছিলেন তারা প্রথমে বিষয়টা হালকা ভাবে নিয়েছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বিষয়টা হাতছাড়া হচ্ছিলো তখন পরিস্থিতি সামলাবার জন্যে এক বালতি জল ঢেলে দেয় মাথায়। তবুও তাকে স্থির করা যায় না। তারপর আরেকজনের পরামর্শে বালতি ভর্তি জলে গোবর মিশিয়ে ভানুর মাথায় ঢেলে দিলে, ভানু শান্ত হয়ে আসে, পরে ভানুকে স্নান করিয়ে পাশের বাড়িতে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়।
তিনদিন পরেই ভীমের কাছে খবর আসে যে ভানুর বড়দা মাঠে ফুলকপি তুলতে গিয়ে স্ট্রোক করে মারা গেছেন। ভানুকে ভীম নিয়ে যান শ্বশুরবাড়ি। ভানুর জন্যেই দীর্ঘক্ষণ শবদেহ উঠোনে রেখেছিলো। বোন এলেই নিয়ে যাবে শ্মশানে।
ভানু বাপের বাড়ি প্রবেশ করার পূর্বেই পথের মধ্যে হাউ মাউ করে চিৎকার করে। ‘ও দাদা তুই কই গেলি রে’ বলে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তার মধ্যে শুয়েই ধুলোর মধ্যে গড়াগড়ি শুরু করে দেয়। ভাইপো এসে তুলে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু তার পক্ষে তুলে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়। ভানুর কাঁদতে কাঁদতে বারম্বার দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিলো। মাথায় জল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে দাদার সামনে পাশে নিয়ে বসায়। ভানু আবার দাদার পা ধরে বুক ধরে কাঁদতে শুরু করে দেয়। বাড়িতে দীর্ঘক্ষণ মৃত দেহ রাখার ফলে পাড়ার লোকেরা এবারে ব্যাস্ত হয়ে ওঠে। তাই শেষে সকলে পায়ে জল, আমপাতা দিলে এবং ভানুর বৌদির শেষ সিঁদুর দান করে বিদায় জানাতে হলো দাদাকে।
শ্রাদ্ধ শান্তি চুকে গেলে যেদিন ভানুরা ফিরে আসবে বাড়িতে। ভানু বৌদির সঙ্গে বসে দীর্ঘক্ষণ গল্প করতে করতে শেষের দিকে বলে, ‘বৌদি এখন তোর কী হবে!’
কাঁদতে শুরু করে দেয় ভানু, আবার বলতে লাগলো একাই, পাশে বৌদি বসে। ‘বৌদি এখন তোর কী হবে? স্বামি তো নেই! এখন তোর ছেলেরা তোকে দেখবে না। আমার মা তো অনেকদিন আগেই মরেছে, আমার মা’কেও কেউ কোনোদিন দেখল না, বাবাও না! তোকে কে দেখবে? তোর ছেলেরা, তোর ছেলেরা তোকে দেখবে না। আমি বললাম দেখবে না দেখিস। তোকে কে খাওয়াবে এখন? তুই আমাদের বাড়ি চলে আসিস। হ্যাঁ। তুই কিন্তু আমাদের বাড়িতে চলে আসিস। আমি খাওয়াবো তোকে। তোর ছেলেরা তোকে না দেখলে চলে আসবি। হ্যাঁ। তুই কিন্তু আমাদের বাড়িতে চলে আসিস। আমার ছেলে তো নাই! আমার ছেলে তো নাই!’
চুপ হয়ে যায় ভানু। গলা শুকিয়ে আস, তারপর শুকনো গলায় ঢেকুর গিলে আবার বলে, ‘আমার তো ছেলে নাই, বৌদি আমার ছেলে হবে না জানিস! বৌদি আমার ছেলে যদি থাকত, তোকে এখনই নিয়ে যেতাম।’
শাড়ির আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের কোণে জল মুছতে মুছতে আবার বলে, ‘আমার ছেলে নাই! আমার ছেলে হবে না!’
তারপর ভানুকে চুপ করিয়ে বলে, ‘ঠিক আছে চিন্তা করিস না, আমি কিছুদিন পরে তোদের বাড়িতে ঘুরতে যাবো। ছেলে নেই তো কি হয়েছে! এই যে আমার ছেলেরা রয়েছে আমাকেও দেখবে তোকেও দেখবে। ক্যামন!’
ফিরে আসে বাড়িতে ভানুরা। পরের দিনই ভানু অনিমার কাছে এসে দাদার সমস্ত শ্রাদ্ধ শান্তির কথা বলে। আর বলে দাদার জীবনের কাটানো শেষ জীবনের অশান্তির কথা। ভানুকে কথা ধরিয়ে দিতে হয় না। সে একা একাই গৌরচন্দ্রিকা করতে পারে।
‘বুঝলি দিদি আমার বৌদিটা না একদম বদমায়েশ। এই বয়সেও নানান কেচ্ছা। দেখিস বলে দিলাম ওর ছেলেরা ওকে দেখবে না। এই যে আমি কিরে খেয়ে বললাম ওকে দেখবেই না। তাই বৌদিকে আমাদের বাড়িতে চলে আসতে বল্লাম। আমাদের বাড়িতে অনেক চাল আছে জানিস। খাওয়ার কোন অভাব নেই জানিস। বৌদি খেয়ে শেষই করতে পারবেনা।’
ভানু খেয়াল করলো যে ওর কথা অনিমা শুনছেই না, তাই অনিমার মনটা নিজের দিকে ঘোরাতে বলে, ‘দিদি আমার ছেলে হবে না রে! বল না দিদি আমার ছেলে হবে না?’
রাজের মা কিছু না বললেও, এবারে মেজাজ হারিয়ে বলে, ‘চুপ কর তো! চুপ কর। চুপ করে বস।’
তারপর আবার নিজেকে সামলে নিয়ে রাজের মা অন্যান্য কথা বলে।
বিকেল হলে রাজ ফিরে আসে বাড়িতে। বাড়িতে মাসিকে দেখে কুশল-মঙ্গল জিজ্ঞেস করে। ভানু রাজকে জবাব দেয় না। ভানু অনিমাকে বলে, ‘দেখিস এই ছেলে বড় হয়ে তোকে দেখবে।’
তারপর ভানু রাজকে বলে, ‘রাজ তুমি একটা খুব সুন্দর টুকটুকে মেয়ে দেখে বিয়ে করবে হ্যাঁ, তোমার বউ যেন তোমার মা-কে খেয়াল রাখে। আচ্ছা রাজ তুমি আমাদের বাড়িতে যাও না কেন? কত বলি একদিন আমাদের বাড়িতে এসো। তুমি কিন্তু আসোই না। তুমি যদি না যাও, আমি কিন্তু আর আসবো না তোমাদের বাড়িতে এই বলে দিলাম।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা মাসি যাবো।’
বিকেলেই হঠাৎ সজোরে হাওয়া বইতে শুরু করে। সুপুরি গাছের মাথা দুলছে। কাঁঠাল গাছের পাতায় সোঁ সোঁ আওয়াজ হচ্ছে। রাস্তায় ধুলো ঝড় শুরু হয়েছে। রাজ পরিস্থিতির অবনতি দেখে জানালা বন্ধ করে দিলো।
সতের
আ ত্ম হ ত্যা
ঘুম থেকে উঠেই কৌশিক শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে রাজকে খবর দিতে এলো। ভোর রাতেই নাকি বিকাশ স্যার গলায় দড়ি দিয়েছেন। তারপর দুজনেই বেরিয়ে গেলো স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। গিয়ে দেখতে পেলো যে বাড়ির মন্দিরের লোহার গেটের উপরে দড়ি বেঁধে ঝুলে রয়েছে। ভোর সকালে প্রথমে স্ত্রী উঠেই এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে জ্ঞান হারা হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। স্যারের আত্মহত্যা বলে কথা! তাছাড়া যে কোন আত্মহত্যার মৃত দেহ দেখতে লোকে দূর-দুরান্ত থেকে ছুটে আসে, আর এখানেও যেমনটা পাড়ার লোকেরা এসে ভিড় করলেন তেমনি ছুটে এলো দূর-দুরান্ত থেকে তার ছাত্রদের দল। কিচ্ছুক্ষণ বাদে পুলিশ এলে সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ করে দেহ নামিয়ে অ্যাম্বুলেন্স করে দেহ পাঠিয়ে দিলেন লাশ কাটা ঘরে।
বিকাশ স্যার ছিলেন অংকের শিক্ষক। তারাপদ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াতেন। সেই সঙ্গে বাড়িতেও টিউশনি পড়াতেন কুড়ি বছর ধরে। ছিল এক বিধবা মা, স্ত্রী এবং সাত বছরের এক পুত্র সন্তান। সকল ছাত্রসহ পাড়ার লোকেরাও তাকে সম্মান করতেন। অবশ্য তাদের সম্মান দেওয়ার জায়গাটা হল গিয়ে ভিন্ন। ছাত্ররা সম্মান এবং ভালোবাসতেন এই কারণে যে তিনি একেবারে গুরু গম্ভীর ভয়ংকর একটা বিষয় অংক জলের ন্যায় সরল তরল করে বোঝাতেন। আর পাড়ার লোকেরা সম্মান করতেন তার ব্যবহারে এবং সততার কারণে। অঞ্চলে সৎ সাহসী আদর্শের উদাহরন হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
বিকাশ চক্রবর্তী জাতিতে ব্রাহ্মণ। প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে স্নান সেরে গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করে সূর্য প্রণাম করে ভগবানের মন্দিরে পুজো দিয়ে দিন শুরু করতেন। সকাল সকাল এক ব্যাচ টিউশনি পড়িয়ে তারপর তৈরি হয়ে খাওয়া শেষ করে যেতেন স্কুলে। টিউশনিতে যেমনটা জনপ্রিয় স্যার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন তেমনি স্কুলের ছাত্রদের কাছেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন কঠিন কঠিন অংক খুব সহজে সমাধান করানোর জন্যে এবং জীবনীমূলক বক্তব্য ক্লাসে রাখার জন্যে। চাকরিটা যেহেতু বারো বছর ধরে করছেন এবং তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান খুব সহজেই করতে পারেন এছাড়া বন্ধুত্বসুলভ আচরণ ব্যবহার করে থাকেন তাই কলিগরাও তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।
দেখাশোনা করে বিবাহ হয়, স্ত্রী প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা। বিবাহের তিন বছর পরেই পুত্র সন্তান। ছেলের নাম রাখেন প্রশান্ত চক্রবর্তী। দুজনেই শিক্ষিত এবং সদ্গুন সদবুদ্ধি সম্পন্ন। তাই তারা দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতির কথা ভেবেই আর কোন সন্তান তারা নেবেন না। প্রশান্তকেই মানুষের মতো মানুষ করে তুলবে। এই কঠিন সামাজিক পরিস্থিতিতে যেখানে একটু ভালো ভাবে বাঁচা দায় এবং ভবিষ্যতের ইঁদুর দৌড়ের কথা ভেবেই একমাত্র সন্তানকেই শুধু ভরন পোষণের দায়িত্ব নিলো চক্রবর্তী দম্পতি। এবং তখনি তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে ডাক্তার দেখিয়ে শলা পরামর্শ করে হিস্টেরেক্টোমির অপারেশন করাবেন। যেমন ভাবনা তেমন কাজ, করিয়েও নিলেন। ছোট পরিবার সুখী পরিবার। গড়াতে থাকলো তাদের সুখের সংসার।
বিয়ের দশটা বছর এবং পুত্র লাভের সাতটা বছর কেটে যাওয়ার পর, বিকাশের মনে অদ্ভুত একটা অন্ধকার জন্ম নিতে শুরু করে। সবসময়ে তার মনে হয়, যে তার যেন কিছু একটা নেই, যেন আশেপাশে শুধুই শূন্যতা। রোজ রোজ আর স্ত্রীর পাশে ঘুমোতে ইচ্ছা করে না। রাতের বেশিরভাগটাই অন্ধকারে জেগে জেগে কেটে যায়। জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখলে চোখ জ্বালা জ্বালা করে। তবুও পরের দিনের কথা ভেবে চোখ বুজতে হয়।
সকালে টিউশনি পড়াতে গেলে কচি কচি মেয়েগুলিরে দিকে তাকালে বিকাশের মনে হয় চারিদিক থেকে যেন একটা অন্ধকার ধেয়ে আসছে, কিংবা কোন ধিক্কার। নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে ক্রমশ চলছে এক অজানা টানাপোড়েন।
স্ত্রী বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারেন যে তার স্বামীর কিছু একটা হয়েছে, রোজ রোজ কোন মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছেন। তাদের মধ্যে ক্রমশই বার্তালাপ কমে আসছে। একই বিছানায় ঘুমোলেও দুজনের বিপরীত দিকে মুখ করে থাকে। কোন এক অজ্ঞাত কারণে স্ত্রীর স্পর্শ হতে নিজেকে সবসময়ে দুরত্বে রাখে। এই হেন আচরণের কারণ স্ত্রী বহুবার জিজ্ঞেস করলেও কোন সদুত্তর পায়নি।
আবার সকালে সন্তানের মুখ দেখলে বিকাশের মনটা শান্ত হয়ে আসে। একটু শান্ত হয়, সন্তানের গালে চুমু খায়, স্কুলের কাজে বেরিয়ে যায় আবার মনটা কেমন যেন হয়ে যায়।
দুজনেই শিক্ষিত এবং সমাজে একটা মান-সম্মান রয়েছে। তবুও স্ত্রী নিজেকে বাঁধতে বাঁধতে জল যখন সীমা অতিক্রম করে যায় তখন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। তিনি আর সহ্য করতে পারেন না তার স্বামীর অবহেলা। হঠাৎই একদিন লেগে যায় তুমুল ঝগড়া।
স্ত্রী বেশ স্পষ্ট করে জানতে চায় তার এই অবহেলার কারণ কী? কেন সে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ব্রহ্মচর্য পালন করছে? কেন সে তাকে স্পর্শ পর্যন্ত করে না?
বেশ স্পষ্ট জানতে চায়, যে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে কি না? সে সবটা জানতে চায়। কিছুতেই মুখ খুলে না বিকাশ। শুধু চুপ হয়ে রাঙা চোখ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
এবারে স্ত্রী পরিষ্কার করে বলে যে যদি সে তার এই ব্যবহারের কারণ না জানায় তবে সে তার পুত্রকে নিয়ে সারা জীবনের জন্য বাপের বাড়ি চলে যাবে। নিত্যদিন এই অবহেলা আর মেনে নিতে সে পারছেনা।
শেষে কিছুতেই কিছু না হলে স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার হুমকি দিলে বিকাশ চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘আমি আবার বাবা হতে চাই! পারবে পারবে?’ বলেই খানিকক্ষণ নীরব হয়ে যায়। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বিকাশ। স্ত্রী ঘরের মেঝেতে বসে পরে, চোখ জ্বলজ্বল করছে, ফুপোচ্ছে। শাশুড়ি কিছুই বলতে পারেন না শুধু বউমার কাছে এসে বুকে আগলে রাখে।
এরপর থেকেই সম্পর্কের মধ্যে একটা জড়তা এসে হাজির। সংসার যন্ত্রের মতো চলতে লাগলো। ঘুম থেকে উঠে আর গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা হয় না, মন্দিরে পুজো দেওয়া হয় না। সকালে পড়াতে শুরু করলে কচিকচি মেয়েগুলোর মুখ যেন তার কাছে স্বর্গের নৃত্য মঞ্চের অপ্সরা। এক সূক্ষ্ম জহুরির দৃষ্টি নিয়ে মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
স্কুলে পড়ানোর সময়ে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছাত্রীগুলি তাকে আকর্ষিত করে প্রতিনিয়ত। লাল পাড় সাদা শাড়ি ছাত্রীগুলির সম্পূর্ণ যৌবন ঢাকা পড়েনা। সামান্য ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখা যায় কোমরের মেদ, লাল ব্লাউজে বুকের পাহাড় যেন শাড়ি ভেদ করে উপচে পড়ছে।
বিকাশের মনে ঘটে যায় অগ্ন্যুৎপাত। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।
ক্লাসে পড়ানোকালীন তার প্রিয় ছাত্রী নীলা, কাছে এলে বিকাশের মন দুরু দুরু করতে থাকে। তাকিয়ে থাকে প্রিয় ছাত্রীর চোখ, মুখ, ঠোঁটের দিকে। তারপর সেই বুক, যেন কাঁচা আপেল দুটো রাঙা হয়ে ধরা দিতে চায় বিকাশের হাতে। কী সব যেন একা একাই ভাবতে থাকে। অতঃপর ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের কথোপকথনের গতিবেগ বেড়ে গেলে, নিজেকে সংযম করে ফিরিয়ে এনে, স্পষ্ট বার্তালাপ করে বিকাশ।
কয়েকমাস হল বিকাশ স্কুল শেষে সোজা বাড়ি ফিরছেনা পূর্বের মতো। ঘুরেফিরে নিজের অজান্তেই উপস্থিত হয়ে যায় নিষিদ্ধ পল্লীতে। প্রথম প্রথম দূর থেকে দেখতেন সেই সব মায়াবী নিষিদ্ধ মেয়েদের, কাছে যেতে মনে একটা সংকোচের ভাব আসত। অবশেষে তাদের কাছে না ভিড়তে পারার ভীরুতায় মদ্যপান করে রাতে বাড়ি ফিরতেন।
এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর শেষে একদিন খুব মাত্রায় মদ্য পান করে মনের সমস্ত সংকোচ ভাব দূর করে উপস্থিত হয়ে যায় বেশ্যাপল্লীতে। তারপর মনের মধ্যে আর কোন বাঁধা রইলো না। তৈরি হয়ে গেলো একটা রুটিন। স্কুল শেষে হোটেলে খাওয়া তারপর রাতে মদ্যপান করে বেশ্যা যাপন। নিত্য রুটিনে জোগাড় হয়ে গেলো একজন নির্দিষ্ট বেশ্যা। বেশ পরিচয় হল তাদের। কথা বার্তা যেমন হতো তেমনি খানিকটা সময় উভয়পক্ষে একটু বেশি কাটাতো।
তারপর একদিন হঠাৎ সেই মায়াবী নিষিদ্ধ মেয়ে শান্ত ভাবেই বিকাশ বাবুর এই রোজ রোজ বেশ্যা পাড়াতে আসার কারণ জানতে চায়। সঙ্গে এটাও জানায় যে, রোজ রোজ এখানে আসা ভালো নয়।
অবাক হয়ে যায় বিকাশ, এই ভেবে যে এইসব নিষিদ্ধ মেয়েরাও তাকে না করছে এখানে আসতে। ওরাও কি মনের কারবার করে!
একদিন বিকাশবাবুর মদের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাওয়ার পর নিষিদ্ধ মেয়ের ঘরে পড়ে পড়ে হুমড়ি খাচ্ছিল। তার মস্তিষ্কে আর কোন স্বাভাবিক জ্ঞ্যান ছিল না। বারংবার মায়াবী মেয়েটিকে ধরে পাশে শুতে চাচ্ছিল, তাতে মেয়েটি রেগে গিয়ে তীব্র ঝংকারে ধাক্কা দিয়ে নিন্দা করতে শুরু করেছিল। আর বারংবার বলছিলে যে এখানে আর আসতে না। তাতেই বিকাশবাবুর মাথা বিগড়ে গেলে মায়াবী মেয়ের হাত ধরে সজোরে ধাক্কা মারলে কপালটা গিয়ে লাগে দেওয়ালে। মাথা দিয়ে সামান্য রক্ত বেরিয়ে এলে ভীষণ ভয় পেলেন বিকাশ বাবু।
তারপর মুখ চেপে উল্টে কাঁদতে শুরু করে দেন তিনি। কপালে হাত দিয়ে মায়াবী মেয়ে কাছে এলে। বিকাশ বাবু একে একে মনের কথা বলতে শুরু করে দেন। তিনি জানান যে তিনি আবার বাবা হতে চান। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। মায়াবী মেয়ে বিকাশবাবুকে মেঝে থেকে তুলে নিয়ে বিছানায় বসালে, সাহস করে বিকাশ বাবু বলে ফেলেন, ‘তুই মা হবি?’
প্রশ্ন শুনতেই রণংদেহী রূপ নিয়ে সূর্যের মতো জ্বলন্ত চোখ নিয়ে উদ্ধার করে দিল বিকাশ বাবুকে। ‘দেখুন বিকাশ বাবু! আপনি রোজ রোজ এখানে আসেন দেখে কী ভেবেছেন, আপনি আমাকে কিনে নিয়েছেন? যা মনে আসবে তাই বলবেন? খবরদার এইসব কথা আর বলবেন না কাউকে। আর এখানে তো একদমই কাউকে বলবেন না। হতে পারি বেশ্যা তাই বলে কি আত্মার কোন দাম নেই? আপনাকে দেখে যথেষ্টই ভদ্র ঘরের মনে হয়। এই যে আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম, আমার হাত ছুঁয়ে বলুন এখানে আর আসবেন না। আপনি এখানে আর আসবেন না।’
স্কুলে বসন্ত উৎসব পালন হবে। অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শেষ, উৎসব আরম্ভ হবে। কিন্তু বিকাশবাবু অনুষ্ঠানের আসরে নেই। বেশ কিছুদিন উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য বিদ্যালয়ের এক্সাম কপি দেখা হয়ে ওঠেনি। বসন্ত উৎসব শেষে ছাত্রদের ক্লাস এক্সামের রিপোর্ট কার্ড তৈরি হবে। তাই সুযোগ বুঝে আজকের এই ছুটির দিনে একটি ফাঁকা ক্লাসে বসে ছাত্রদের দেওয়া অংক পরীক্ষার খাতাগুলো দেখে নিচ্ছেন।
উৎসব মাঠে অনুপস্থিত বিকাশবাবু, বিষয়টি খেয়াল করলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। অতএব প্রধান শিক্ষক নিজের কাছে নীলাকে পেয়ে আদেশ দিলেন বিকাশ স্যারকে ডেকে আনার জন্য। উৎসব এখনই শুরু হবে।
নীলা স্যারের সামনে দাঁড়াতেই স্যারের চোখ আটকে গেলো নীলার সৌন্দর্যে। চোখে টানা কাজল, ঠোঁটে লাল গোলাপ রঙের লিপস্টিক, গালে কুমকুম রঙ, মাথার একটা-দুটো চুল কপালে ভাসছে, চন্দন দিয়ে কপালের মাঝখানে ছোট্ট আল্পনার মাঝে লাল রঙ্গা টিপ, কানে বড় বড় কানের দুল, নাকে নথ, খোপায় গুঁজে রেখেছে পলাশের ফুল, হাতে কাঁচের চুরি, হলুদ শাড়িটি খাটো করে পড়া, আলতা পায়ে নূপুর ঝম ঝম করছে, বুকে লাল ব্লাউজ।
নীলা কাছে এসে দাঁড়াতে এবং হাসিমুখে স্যারকে ডাকল। স্যার নিজস্ব কল্পনার জগতে তখন ভাসছেন।
ঘরের এক কোণে একটি হলুদ প্রজাপতি অনেকক্ষণ থেকে খালি এদিক আর ওদিক ছুটছে। মাকড়সা জাল বুনছে। টিকটিকি ওঁত পেতে বসে আছে। উড়তে উড়তে প্রজাপতি জালে আটকে যায়, আবার নিজেকে কোনোক্রমে ছাড়িয়ে আবার উড়ে যায়।
স্যার অকস্মাৎ আচমকা বিদ্যুৎ বেগে নীলার হাতটা খপ করে ধরে বসলেন। নীলা হতভম্ব হয়ে যায়, প্রথমে মুখ থেকে কোন কথাই বের করতে পারেনা। তারপর চেয়ার ছেড়ে এসে নীলাকে টেনে নিয়ে এসে দেওয়ালে ঠেস দিয়েই হঠাৎ করেই চুমু দিতে শুরু করলেন নীলার ওই রাঙ্গা ঠোঁটে ও গালে। টিকটিকি খপ করে প্রজাপতিটির একটি ডানা ধরে ফেলে, এবারে শুধু গেলার পালা, প্রজাপতিটি প্রাণপণে ছটফট করতে থাকে।
নীলাকে পেছনে ঘুরিয়ে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া কাচা-পাকা আপেল দুটিকে আত্মসাৎ করার জন্য নীলার হাত বেঁকিয়ে পিঠে রাখতে গেলে, হাতের কাচের চুরি ভেঙ্গে গিয়ে বিকাশ বাবুর হাতের তালু কেটে গেলে, তৎক্ষণাৎ কোনক্রমে নিজেকে ছাড়িয়ে ঠাটিয়ে বিকাশ বাবুর গালে চড় মেরে দৌড়ে পালিয়ে যায় নীলা। প্রজাপতিটিও বাকি একটা ডানার জোরে ঝাপটা মারতে মারতে টিকটিকির মুখ থেকে নিজেক বাঁচিয়ে কোনোক্রমে ঘরের বাইরে উড়ে গেলো।
বিকাশ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজের এই জ্ঞানহীন আচরণের জন্য নিজেই নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। এবারে কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।
অতঃপর নিজেও বেরিয়ে গেলেন কিন্তু আর বসন্তোৎসবে যোগ দিলেন না। এমনকি আর বাড়িও ফিরলেন না। অনেক রাতে মদ্যপান করে বাড়িতে প্রবেশ করেন। রাতে ঘুমোতে চেষ্টা করেন কিন্তু ঘুম আসেনা। বারেবারে নিজেকেই বিশ্লেষণ করতে লাগলেন কেন এইরকম আচরণ করলেন! নীলা যদি কাউকে বলে দেয়, সে কি অস্বীকার করতে পারবে! কোথায় যাবে তার এতদিনের মান-সম্মান! লোকেরা আর তাকে বিকাশবাবু বলে ডাকবে না! ঘেন্নার চোখে দেখবে! ছি! আজকে নিজেকে ভীষণ ঘেন্না হচ্ছে! নীলা তো তার কন্যার মতনই। নীলা মেয়ে! কন্যা নীলা! শুধু বিছানার এপাশ আর ওপাশ।
স্ত্রী কাছে এসে কথা বলতে চাইলে সে কথা বলতে পারেনা। এইভাবেই কেটে যায় বেশ কয়েকদিন। রাতে তার কিছুতেই ঘুম আসে না। চোখের চারপাশে কালো দাগ গাঢ় হয়ে আসে। স্কুলেও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, ফোনে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। একে একে সব টিউশনি বন্ধ হয়ে গেছে। যখন তিনি ঘরে থাকেন ঘরের এককোণে জড় বস্তুর মতনই পড়ে থাকেন।
তারপর একদিন তিনি আবার বেশ্যাপল্লীতে যান। মনে মনে ভেবেছিলেন তার এই কু-কর্মের তার এই পাপের কথা অন্তত তার সেই পরিচিত বেশ্যার কাছে বলে কিছুটা হালকা হবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখতে পান সেই পরিচিত মায়াবী মেয়ে অন্য খরিদ্দারের সাথে হাসিমুখে কথোপকথনে ব্যাস্ত। রাস্তা থেকেই ফিরে আসেন তিনি। তার মনের মধ্যে বয়ে চলেছে লাভাস্রোত। এক সমুদ্র স্নানেও সেই আগুন শান্ত হবে না।
মা, ছেলের অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে ভীত হয়ে, পঞ্জিকা দেখে বাড়ির মন্দিরে গীতা পাঠের আসর রাখলেন। গীতা পাঠ হচ্ছে। সেখানে ছেলেকে বৌমাকে নাতিকে বসিয়ে গীতা পাঠ সকলে মিলে শুনছেন। যিনি গীতা পাঠ করছেন একে একে প্রত্যেকটা শ্লোকের সহজ ব্যাখ্যা করে চলেছেন। বিকাশ সব কথা মন দিয়ে শোনেন না।
একটি সংস্কৃতের শ্লোক ব্যাখ্যা করে বলছেন, ‘এই আত্মাকে কোন শাস্ত্র ছেদন করতে পারে না, অগ্নি দহন করতে পারে না, জল আর্দ্র করতে পারে না এবং বায়ু একে শুষে নিতে পারে না।’
আবার অন্য শ্লোক ব্যাখ্যা করছেন, ‘সকল প্রাণী জন্মের পূর্বে দেহহীন এবং মৃত্যুর পরেও দেহহীন অবস্থাতে থাকে, কেবল জন্ম মৃত্যুর মধ্যেকার সময়ে এই দেহধারণটা আমরা দেখে থাকি...।’
বিকাশের কানে গিয়ে মৃত্যু শব্দটা বাজলো। গীতা পাঠ শেষে, অনুষ্ঠান শেষে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমোতে যায় সকলে। বিকাশও ঘুমোতে যায়। কিন্তু তার ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করে। শূন্য, শূন্য চারিদিকে শূন্য অন্ধকার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে নীলা। নীলা হা হা করে হাসে, দাঁত বের করে হাসে আর বলে, স্যার আপনি আমাকে গিলে নিতে চেয়েছেন কিন্তু পারেন নি, শুষে নিচ্ছেন শুষে, কিন্তু কত শুষবেন! একদিন আমিও গিলে নেবো হা হা আর সকলকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবো ওই হল গিরগিটির জাত, সকলে দেখুন কিভাবে রঙ বদলিয়ে বদলিয়ে বেশ আছেন। হাসছে সকল লোক মিলে হাসছে, তার শিশু সন্তানও আঙুল দেখিয়ে হাসছে। চোখের সামনে নীলা বড় হা করে এগিয়ে আসে।
‘তুমি আমার মেয়ে, তুমি আমার মেয়ে’ বলেই হঠাৎ করেই চোখ খুলে ফেলেন বিকাশ। কপাল মাথা মুখ ঘামে ভিজে যায়, ভিজে যায় বালিশ। কোন রকমে আবার চোখ বন্ধ করে বিকাশ। তারপর ভাবতে থাকে ক্ষমা চেয়ে নিবে সে নীলার কাছে। ক্ষমা চেয়ে নিবে একে একে সকলের কাছে। কিন্তু স্ত্রী কি তাকে ক্ষমা করবেন! সে কি সকলের চোখে চোখ রাখতে পারবেন পূর্বের মতন।
আবার ভাবে সেই বেশ্যার কথা। সে কি ক্ষমা করবে!
তারপর ভাবতে থাকে গীতা পাঠের কথা, আত্মাকে কেউ ছেদন করতে পারে না। অগ্নি না, আলো না, জল না, বায়ু না কেউ না কেউ না। এই দেহ দেহহীন, জন্ম-মৃত্যু দেহহীন, মৃত্যু-মৃত্যু, মৃত্যু হলে সব সমাধান। মৃত্যু মৃত্যু...।
হঠাৎ করেই অন্ধকারে ঘুম থেকে উঠে এগিয়ে যায় মন্দিরের দিকে। কাপড় মেলার দড়ি খুলে এগিয়ে যায় মন্দিরের গেটের দিকে। তারপর গেটের উপরে দড়ি ঝুলিয়ে অকস্মাৎ ভাবেই নিজেও ঝুলে পড়লেন।
আর এভাবেই শেষ হয়ে যায় একটা গোটা জীবন আর গোপন হয়ে যায় একটা বীভৎস ইতিহাস।
রাজ ফিরে আসে বাড়ি। মাস্টারমশাইয়ের আত্মহত্যায় সকলেই অবাক ভীষণ রকমের নির্বাক। ভানুও রাজের বাড়িতে এসে দেখতে পায় রাজের চোখের কোণে জল। ভানু রাজকে বলে, ‘বাবা মন খারাপ করে না। মাষ্টারের তো ছেলে আছে, ওই ছেলে ওর মা’কে দেখবে।’
রাজ কোন কথা শুনতে চায় না এখন। চুপ করে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে গেলো। মনে মনে ভাবে কি করে একটা মানুষ এভাবে আত্মহত্যা করতে পারে! কী ছিল না ওনার? কেন করবে আত্মহত্যা? আরও কিকি যেন সব ভাবতে থাকে রাজ। মাথা ঝিম ধরে আসে, কিছু ভালো লাগে না। ফোন করে জিনিয়াকে। জিনিয়াকে জানায় স্যারের সুইসাইডের কথাটা।
দরজার বাইরে থেকে ভানু খেয়াল করে যে রাজ জিনিয়ার সাথে গল্প করছে ফোনে। অতঃপর নিজেই বিড়বিড় গড়গড় করতে করতে বেরিয়ে গেলো রাস্তায়।
আঠার
ক থো প ক থ ন
রাজ সন্ধ্যায় ইউটিউবে ইন্সটিটিউটের ক্লাস করছিলো। সেইসময়ে কৌশিকের ফোন এলো। কৌশিক বেরিয়ে গেছে, রাজকে গ্যালারীতে আসতে বললে। ক্লাস শেষ করে রাজ চলে আসে গ্যালারীতে। কৌশিক সিগারেট ধরিয়ে এক মনের মত টান দিয়ে রাজকে দিলো।
দীপ্তি বলে, ‘আমাকেও দে আমিও দু টান দিই। কবে মরে যাবো ঠিক নেই, সব কিছু টেস্ট করেই মরি।’
ভাগীরথীও বলল, ‘হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছিস, আমকেও দিস।’
কৌশিকঃ স্যার সুইসাইড করে নিলো বিশ্বাসই হচ্ছে না।
ভাগীরথীঃ হ্যাঁ, কেন যে করলেন! কিসের দুঃখ স্যারের চাকরি ছিল, ছেলে ছিল, বউ ছিল, সম্মানও ছিলো। সবার আদর্শ ছিলেন তিনি। কেন যে করলেন!
দীপ্তিঃ জানি, তবু জানি/ নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি; / অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়—/ আরও এক বিপন্ন বিস্ময় / আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে /খেলা করে; / আমাদের ক্লান্ত করে / ক্লান্ত--ক্লান্ত করে ---।
কৌশিকঃ দ্যাখ দ্যাখ, এই মেয়ে আবার কবিতা আবৃত্তি শুরু করে দিলো।
রাজঃ বাহ। সুন্দর বললি তো।
ভাগীরথীঃ জীবনানন্দ দাশ আমার খুব প্রিয়।
কৌশিকঃ ওসব আমি বুঝি না, আমি যেটা বলতে চাই সেটা হল স্যার কেন আত্মহত্যা করলো, তোদের কী মনে হয়?
দীপ্তিঃ আর জেনে কী হবে? লোকটা তো নেই।
কৌশিকঃ আলবাৎ জানতে হবে।
দীপ্তিঃ তুই নিশ্চয়ই কিছু ভেবেছিস, তাহলে তুই বল আমরা শুনি, তারপর না হয় কিছু বলি।
কৌশিকঃ আমার মনে হয় স্যারের বউ অন্য কারোর সঙ্গে চুপি চুপি প্রেম করত। আর, তাই সমাজে কি করে মুখ দেখাবে, এই ভেবেই আত্মহত্যা করে নিয়েছে।
ভাগীরথীঃ কী সব ভাবিস বল তো তুই। তাহলে তো ডিভোর্স দিলেই হয়ে যেতো।
রাজঃ আমারও মনে হয় ব্যাপারটা অন্য কিছু আছে, নয় তো আত্মহত্যা করার মত ছিল?
দীপ্তিঃ আচ্ছা লোকে আত্মহত্যা কেন করে? আগে এটা বল তো।
কৌশিকঃ এমন কোন কাজ করে ফেলে মানুষ তারপর আর সমাজে নিজের মুখ দেখাতে পারবে না তখনই মানুষ সুইসাইড করে।
ভাগীরথীঃ আমার মনে হয় মানুষ অবহেলা পেতে পেতে এমন ডিপ্রেশনে চলে যায়, তারপর এমন কোন কাজ করে বসে, সেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না, তখনই আর কিছু না উপায় পেয়ে আত্মহত্যা করে বসে।
কৌশিকঃ হ্যাঁ ঠিক বলেছিস, এমন কোন ক্রাইম করে তারপর আর ফিরতে পারে না। তখনই সুইসাইড করে।
রাজঃ আমার মনে হয় জীবনের সব কিছু চাওয়া পাওয়া হয়ে গেলে মানুষের হয়তো আর বাঁচার ইচ্ছা থাকে না।
কৌশিকঃ তোর কি মনে হয়, স্যার কি জীবনে সব পেয়ে গিয়েছিলেন! কই স্যারকে তো সেই পুরনো বাইক নিয়েই স্কুলে যেতে দেখতাম। একটা নতুন বাইকও তো পরে কিনতে দেখলাম না।
দীপ্তিঃ আহ। কিসব ভুলভাল বকছিস বলতো তুই কৌশিক। আলো-অন্ধকারে যাই---মাথার ভিতরে/ স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!/ স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,/ হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়! --- এই বোধ থেকেই মনে হয় লোকে স্ব-মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়।
কৌশিকঃ আহ। এই মেয়েটা কী শুরু করলো বল তো। ভালো লাগে না। এটা তোর ইউনিভার্সিটি নয় যে, যখন তখন কবিতা আবৃত্তি শুরু করে দিবি।
দীপ্তিঃ এই ছেলটা কী রে! কিছু বুঝে না নাকি! মাথায় গোবর! আচ্ছা যা আর বলবো না, খুশি থাক। কী বললাম মানে কিছু বুঝল না, খালি ভুলভাল তর্ক করতে পারলেই বাঁচে।
রাজঃ হ্যাঁ দীপ্তি তুই ঠিক বলেছিস ওই বোধ থেকেই মানুষ আত্মহত্যা করে। যখনই বোধ জন্ম নেয় তখনই ভুলটা বুঝতে পারে।
ভাগীরথীঃ কিন্তু স্যার কি ভুল করলো বল তো? ভাব্বার বিষয়!
কৌশিকঃ তোরা কি খেয়াল করেছিস, আমরা যখন স্যারের কাছে পড়তাম তখন কিন্তু স্যার মদ খেতেন না। আর এখন কিন্তু প্রায় রোজ খেতেন। একবার তো শুনলাম স্যার নাকি বেশ্যা পাড়ার দিকেও যেতেন।
রাজঃ শুনেছি। তবে বেশ্যা পাড়ার গল্পটা কতটা সত্যি তা জানা নেই। তবে মদ ধরেছিলেন এটা বেশ স্পষ্ট।
দীপ্তিঃ কৌশিক তোর আসলে ঠিক কী কী মনে হয় সেটা বল আগে পরিষ্কার করে। একটু আগেই বললি ওনার স্ত্রীর দোষ, আবার এখন ওনাকে দোষ দিচ্ছিস।
কৌশিকঃ আমি তো পসিবিলিটিগুলো বলছি। কী হতে পারে সেসব। এমনও তো হতে পারে যে স্কুলে যদি কোন মহিলা কলিগ কিংবা ছাত্রীর সঙ্গে চোখাচোখি মাখামাখি ঢলাঢলি করার পর যেমনি অনুশোচনা হলো তেমনি লটকে গেলেন।
দীপ্তিঃ এই ছেলেকে এখান থেকে বের কর তো। প্রথম থেকেই মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছে। ও নির্ঘাত আজকে আমার হাতে খুন হবে!
কৌশিকঃ আচ্ছা তাহলে তোরাই বল, মানুষটা এমনি এমনি সুইসাইড করলো? নাকি তোর কবিতা আবৃত্তি করতে করতে!
দীপ্তিঃ দ্যাখ সহ্য করার একটা সীমা থাকে। আর একটা বাজে কথা বল, আমি চলে যাবো বলছি।
রাজঃ কৌশিক তুই একটু শান্ত হ। তোকে কিছু বলতে হবে না, এমনকি কিছু ভাবতেও হবে না।
ভাগীরথীঃ মানুষ সুইসাইড কেন যে করে, কয়েকদিন অন্যত্র গিয়ে থাকলেও তো বাঁচে।
দীপ্তিঃ বাঁচাটাই কি সব?
কৌশিকঃ মরাটাই সব? মরে গিয়ে কি স্যার ইতিহাস কিছু তৈরি করে গেলেন?
দীপ্তিঃ হয় তো কিছু গোপন করে গেলেন।
কৌশিকঃ এটাই বলছি এতক্ষণ ধরে, কি গোপন করে গেলেন? প্রেমে ধোঁকা খাওয়ার বয়সতো এটা না!
রাজঃ আহ কৌশিক আজ কিন্তু বড্ড বেশি বাজে বকছিস।
কৌশিকঃ ঠিক আছে এই নে মুখে আঙুল দিলাম। তোরা বল, আমি শুনছি।
ভাগীরথীঃ বৌটার কী হবে এখন! বাচ্চা একটা ছেলে রয়েছে। আর মায়ের বয়স তো কম হল না! এই শেষ বয়সে এসে পুত্র শোক সহ্য করতে হচ্ছে। তার কত দুঃখ ভাব।
দীপ্তিঃ খুব কষ্ট হচ্ছেরে ভাবতেই।
রাজঃ ভাগ্যিস স্যারের বউ চাকরি করে, নয়তো ভাব --- কী পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হত একবার ভাব।
ভাগীরথীঃ ছেলেটার উপর দিয়ে কী ঝড় যাবে ভাব। এই বয়সে বাবাকে হারালো।
রাজঃ ছেলেটা মানুষের মতো মানুষ হোক।
কৌশিকঃ আরেকটা বিয়ে করে নিলেই ঝামেলা সব চুকে যাবে।
রাজঃ কৌশিক তোর বাচালতাটা একটু কমা বুঝলি।
ভাগীরথীঃ আজ আসিরে অন্ধকার বেশি হয়ে গেলো। বাড়ি ফিরতে হবে।
ভাগীরথী এবং দীপ্তি বাড়ি ফিরে যায়। কৌশিককে রাজ বলে, ‘তোর ব্যাপারখানা কী বল তো? সবসময়ে দীপ্তির সঙ্গে উঠে পড়ে লেগে আছিস। কেন গায়ে পড়ে ঝগড়া করছিস?’
কৌশিক হোহো করে হেসে উঠে উত্তর দিলো, তেমন কিছুই না রে। ও অল্পতেই রেগে যায়, তাই ওকে রাগাতে ভালো লাগে।’
তারপরে যে যার বাড়িতে ফিরে গেলো।
রাজ ঘুমোতে যায়, জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখে। বালিশের এপাশ আর ওপাশ হয় তারপর ভাবে, স্যারের এমন কী বোধ জন্ম নিলো যে স্যারকে সুইসাইড করতে হল। সব কিছুই ছিল স্যারের কাছে, সুখেই ছিলেন। তবে কেন এতো সহজে গলায় দড়ি দিয়ে দিলেন। এখন পরিবারটার কী হবে? তবু একটা ছেলে আছে। ছেলেটা ধীরে ধীরে বড় হবে। এইসব কিছুই ওর মনে থাকবেনা। স্যারের বউ তবু ছেলেটাকে নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। তারপর আবার মনে আসে ভানু মাসির কথা। ভানু মাসির কোন ছেলে নেই। কোন সন্তান নেই। ভানু মাসিরও গর্ভে সন্তান এসেছিলো কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়। মায়ের কাছে শুনেছিলো মাসিও নাকি একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। কিন্তু মরেনি। আত্মহত্যা কি এতো সহজ! ভানু মাসি তো তাকে ছেলের মতোই দেখেন, তবে তারা কেন মাসির সাথে খারাপ ব্যবহার করে। মাসিকে আর কোন কষ্ট দেওয়া যাবে না। যখন আসবে ভালো ব্যবহার করতে হবে, আদর যত্ন করতে হবে।
এইসব ভাবতে ভাবতেই রাজ ভোর রাতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে নিজের অজান্তেই।
উনিশ
নি ষি দ্ধ গ লি
কয়েক রাত থেকেই ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না রাজের। চৈত্রের গরম, ফ্যানের হাওয়া আরও গরম হয়ে আসে। রাস্তার কুকুরগুলো সারারত চিৎকার করে। আর সেই চিৎকারে বারংবার ঘুম ভেঙে যায়। আর ভাবে মানুষের কথা। মানুষ নিজেকেই ঠিক করে চিনতে পারে না একটা গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পরেও। কী অদ্ভুত এই মানুষ, নিজের অজান্তেই কত কি করে ফেলে। ভাবতে ভাবতে একেক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লে মাথাটা ঝিম ধরে আসে। মুখ শুকিয়ে আসে, তবু ঘুম আসে না। জিনিয়া বলেছিল যখন মনের মধ্যে বাজে চিন্তা ভাবনা আসবে তখন যেন তাকে ফোন করে। প্রায় রাতেই তাই করেছিল, তবু রাজের ঠিকমতো ঘুম হত না। তবু রাতের পর রাত ফোন করে কথা বলা হত। তারপর একটা নিশ্চিন্তের ভাব নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করত। আবার মাঝে মাঝে এই ভাবনাটাও আসত যে একে রাতে নিজের ঘুম তো হচ্ছেই না জেগে রয়েছে সেই সঙ্গে অন্যকেও কেন শুধু শুধু জাগিয়ে রাখা। তারপর প্রায় রাতেই সোশ্যাল মিডিয়া ঘাটতে ঘাটতে কখনও নতুন কোন ফিল্ম দেখতে দেখতে নিজেকে ক্লান্ত করে ঘুমিয়ে পড়ে। আর যে ভোর রাতে জ্যোৎস্নার আলোতে ভুল করে সকাল ভেবে পাখিরা ডেকে উঠতো তখনও যখন ঘুম আসতো না সেই সময়ে মোবাইলে নিষিদ্ধ নীল ছবি দেখে চোখ, মস্তিষ্ক শুকিয়ে, বালিশের শুকনো লবণ মুছতে মুছতে মৈথুনতায়, নিজেকে ক্লান্তের থেকেও ক্লান্ত করে ঘুমিয়ে পড়ত।
সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে যায়। বেশ ফুরফুরে হাওয়া বইছে। দাঁত মাজতে মাজতে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। রাজ পূর্বদিকে তাকায়, দেখতে পায় আকাশে কমলা করে সূর্য উঠেছে। গাছ থেকে পাখিরা উড়ে চলে যাচ্ছে অজানার উদ্দেশ্যে। রাজের ভালোই লাগে এইসব দেখতে। কিন্তু রাতে অনিয়মের কারণে তার সকালে ঠিক করে উঠা হয় না বেশ কয়েকদিন হল।
সামনে পয়লা বৈশাখ। বাড়ির জন্য কিছু কিছু নতুন জিনিস কিনে আনতে হবে। এ বছর রাজের উপর দায়িত্ব রয়েছে শিলিগুড়ি হকার্স কর্নার থেকে মার্কেটিং করে আনার।
বেরিয়ে গেলো রাজ এবং কৌশিক বাইক নিয়ে মার্কেটিং করতে। পর্দা, চাদর, ঝাড়ু এইসব কিনে নিয়ে মহাবীর স্থানের রেলগেট পেরিয়ে ডানদিকে ধরে বেশ্যা গলির সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে কৌশিক আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলে, ‘জানিস বিকাশ স্যার এখানে আসতেন।’
রাজের ভালো লাগে না শুনতে। বলে, ‘চল, তোকে এখানে দাঁড়াতে কে বলল?’
তারপর ঝংকার মোড় হয়ে বেরিয়ে নৌকাঘাট ব্রিজের উপর এলে রাজ দাঁড়াতে বলে। বাইক থেকে নেমে উত্তর দিকে চেয়ে থাকে রাজ মুগ্ধ চোখে, যেখানে বালাসন এবং মহানন্দা উভয়ে মিলে পোয়াতি রূপ ধারণ করে আছে। আর দুটি নদীর মিলন স্থানের উপরে বাঁধে রয়েছে সবুজ ছোট্ট গ্রাম। তাকিয়ে থাকে রাজ। উত্তরের আকাশে তাকালেই দেখা যায় গিরিশৃঙ্গ পর্বত চূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা। কী মনোরম দৃশ্য! মনটা নরম হয়ে আসে। আর দক্ষিণ দিকে নদীর উপর দিয়ে চলে গেছে রেলে ব্রিজ। রেল লাইন দিয়ে ছুটে গেলো রেলগাড়ি। এই দৃশ্য শেষ করে তারা দুজনেই বাড়ি ফিরে এলো।
আরও একদিন রাজকে একাই মার্কেটিং করতে আসতে হল শিলিগুড়িতে। চড়া রোদে মার্কেটিং শেষ করে রীতিমতো ঘাম ঝরছে। এদিকে বিকেল শেষ হয়ে এলো। সন্ধ্যা হয় হয়। রাজ হাঁটতে হাঁটতে স্যারের কথা ভাবতে ভাবতে রেল লাইন ধরে কখন যে বেশ্যা পাড়ার নিভু নিভু ল্যাম্পপোষ্টের নিচে এসে দাঁড়ালো সে নিজেই জানে না।
সে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় ওই নিষিদ্ধ মেয়েদের, যাদের মুখে মাখা রয়েছে জবরজং রঙ, চোখে গাঢ় কাজল, প্রতি মুহূর্তে আকর্ষণ করে টেনে নিচ্ছে দুর্বল হৃদয়ের মানুষদের।
নানান সম্ভবনাময় চিন্তা ভাবনা মাথায় আসে, ‘স্যার এখানে আসতে পারেন না কিংবা এসেছেন তো কী হয়েছে?’
মাথায় খেলে গেলো মায়ের সেই গল্পটা। ভানুকেও একদিন ওর স্বামী জোর করে অত্যাচার করে যৌনতায় উন্মাদ হয়ে পশুর মতো হিংস্র আচরণ করতো। ভাবতে ভাবতে মনের মধ্যে চলে আসে মালিনী কাকিমার কথা। যার কিনা স্বামী নেই, ওই একটা ছোট্ট দোকানে যে সংসার চলে না এ কথা বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। অসুবিধা হয়না বুঝতে সংসার চালানোর জন্যই মালিনী কাকিমার এতোটা ঢলাঢলি। কিন্তু কই মালিনী কাকিমাকে তো সে কিছুতেই ঘৃণা করতে পারছে না।
এই অবৈধ গলির নিষিদ্ধ মেয়েগুলোকে নিয়ে নানা রকমের খিস্তি, গসিপ করতে করতে ভদ্র সমাজে একটুও বাঁধে না। অথচ ভদ্র সমাজের নানান লোকেরা তাদের নিজেদের যৌনতার তৃষ্ণা মিটিয়ে নেবার জন্য প্রতি মুহূর্তে হাজির হচ্ছে এই নিষিদ্ধ গলিতে, কিংবা ওই মালিনী কাকিমাদের মতো বাড়িতে। হয় তো যেমনটা এসেছিলেন বিকাশ স্যার।
এইসব ভাবতে থাকে রাজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তারপর হঠাৎই চোখে পড়ে রাজের ওই ছোট্ট কাঠের ব্রিজের পেছনে কাঠের ঘরের পাকা মেঝের উপরে দু তিনটি শিশু। তারা খেলনা নিয়ে বসে সেখানে খেলছে। রাজ মনে মনে ভাবে এরা সকলে তাহলে শুধু মাত্র বেশ্যা নয় কেউ কেউ মা আছেন তবে। তাহলে এরা মা হওয়ার আনন্দটুকুও পেয়েছে। বাবার দরকার নেই। বাবা ছাড়াই শিশুরা বড় হয়ে উঠছে, এই অবৈধ গলির কম আলোযুক্ত ল্যাম্পপোষ্টগুলোতে।
কিন্তু ভানুর কোন সন্তান নেই। ভানু মা হতে পারেনি। পেটে অজান্তেই একবার শিশু মরে গেল, হয়তো সেই সন্তানের হাত, পা কিছুই ছিল না। তবুও রক্তমাংসের একটা টুকরো ছিলো। যেখানে একে একে জোড়া লাগত হাড় শিরা উপশিরা। হতো হাত-পা, ফুটত চোখ, একটা গোটা সন্তান। কিন্তু ভানুর সন্তান হল না। ভানু মা হতে পারলো না।
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর এক পতিতার সঙ্গে চোখাচোখি হলে সে ইশারায় কাছে ডাকলে রাজ চারিদিকে তাকিয়ে দেখল প্রত্যেকটা ল্যাম্পপোস্ট জ্বলে উঠেছে রাস্তায়। ঘরগুলোর উপরে টুনিবাল্বগুলো চকমক করছে। বুঝতে আর দেরি হল না, সে সেখানেই দীর্ঘক্ষণ থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সময় বয়ে গেছে অনেকটা।
কেন সে সেখানে এসে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল সেইসব ভাব্বার সময় ছিল না। রাজ আবার উলটো পথে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বাস ধরে বাড়ি ফিরল।
মাস্টার মশাইয়ের মৃত্যুর পরে কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরও বেশ একটা থমথমে ভাব ছিল পাড়ার মধ্যে। সেইসব ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের স্মৃতিতে খুব একটা নেই। ধীরে ধীরে দিন বয়ে যেতে লাগলো, বিকাশ মাস্টার মশাইয়ের ঘটনাও ঘটমান বর্তমান থেকে অতীত হয়ে গেলো। কারও কারও মুখে বেশ কিছু দিন মুখরোচকের মতো বিষয়টা চললো, তারপর একেবারে চুপ হয়ে গেলো। রাজও ধীরে ধীরে মন থেকে বিষণ্ণতা মুছে গেলো।
নদীর স্রোতের মতোই সময় বয়ে চললো। নিয়ম করে সূর্য উঠতে লাগলো, অস্ত যেতে লাগলো। পাখিরা বাসা ছেড়ে উড়তে লাগলো, সন্ধায় বাসায় ফিরতে লাগলো। ফুল ফুটতে লাগলো। নরম শীতল হওয়া বইতে লাগলো। আকাশে মেঘ জমতে শুরু হলো। বর্ষা এসে হাজির হলো।
কুড়ি
বু ড়ি বা লা স ন
মাঝরাতে যখন নিদ্রা গভীর অতলে ডুবে যায় ঠিক তখনই বিদ্যুতের চমকে চমকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তারপর ক্রমশই বাজের পর বাজ, যত না বৃষ্টি হচ্ছে তার চেয়ে বেশি মেঘ গুরু গম্ভীর হয়ে সারারাত বিদ্যুৎ বর্ষণ করে। বিদ্যুতের আওয়াজে মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙলেও ভোরের ঠাণ্ডা বাতাসে প্রকৃতি ঠাণ্ডা হয়ে আসে আর ঘুম অতলে ডুবে যায়।
সকালে মেঘলা মেঘলা আকাশ, গুড়ি বৃষ্টি রয়েছে যখন তখন রাজের মনটা আর ঘরে বসে থাকতে চায় না। কৌশিক সকাল সকাল পিঁপড়ের ডিম কিনে নিয়ে এসে রাজের বাড়িতে হাজির। তারপর ছিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুজনে বুড়ি বালাসনে।
এই বর্ষাতেও রুগ্ন শীর্ণ দেহ বুড়ি বালসন নিজের যৌবন আবার ফিরে পায়। একবুক জল নিয়ে আপন স্রোতে স্রোতে ছলাত ছলাত শব্দে সকলকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। পাড়গুলোতে পিচ্ছিল শ্যাওলা জন্ম নেয়, দু একটা ব্যাঙ নদীতে লাফ দেয়। কিন্তু পাড় ভেঙে গ্রাম ভাসিয়ে দেওয়ার সাহস তার কোনদিনই হয়নি। তাই তো বৃদ্ধ থেকে শিশু সকলেই নদীতে এসে আপন আপন কলা শৈলীতে সাঁতার দিতে পারেন নিশ্চিন্তে।
বালাসন-মহানন্দার মতো হয়তো এই নদীর গর্ব করার বিষয় কিছু নেই তবুও যা রয়েছে তাতে এই বর্ষায় প্রত্যেক শিশু থেকে কিশোরের এবং সকল মানুষের হৃদয় কেড়ে নেয়। এই সময়ে সমস্ত ছেলের এই নদীর পাড়েই সময় কাটে। পানাপাতার ফাঁকে ফাঁকে ছেলেরা ছিপ ফেলে তাতে শিঙ্গি, মাগুর, ট্যাঙরা, পুঁটি, সরপুঁটি উঠে আর মাঝে মধ্যে হয়তো এক ঝাঁক ফলি মাছ পথ ভুল করে এদিকে চলে আসে। জেলেরা জাল নিয়ে চলে আসে সারাটা দুপুর বিকেল মাছ ধরে সন্ধ্যায় গিয়ে বাজারে বসে।
গত দুদিন থেকে কখনও এক নাগাড়ে আবার কখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয়েই চলেছে। রাতের বেলায় ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামলো সঙ্গে বিদ্যুতের চমক। ভীম আর ভানু ঘুমোতে পারে না। ফুটো চাল দিয়ে যেখানে যেখানে ঘরের ঘরের মধ্যে টুপটুপ করে জল পড়ে, সেখানে সেখানে বালতি দিয়ে রেখেছে। ছাগলটাও সারারাত ঘুমোয় না, পাশের ঘর থেকে ম্যা ম্যা ডেকেই চলেছে। ভীম বাইরে এসে দেখতে পায় এক হাঁটু জল জমে গেছে উঠোনে। ঝড়ের গতিবেগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে বাতাস। ঘরের পশ্চিম দিকে মটকা জাম গাছটা ঝড়ের হাওয়ায় দুলতে দুলতে মটমট করে ভেঙ্গে পড়লো উঠনের উপরে।
ভীম বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছে এইরকম ঝড় সে গত কয়েক বছরেও দেখেনি। সে একবার হয়েছিলো যখন ছোট্ট ছিল। আর এভাবেই তার বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল আর তারা ঘরের ভিতরে। আবার মনে আসে তার সন্তানের কথা। না জানি তারা এখন কেমন আছে। তাদের যেন কোন বিপদ না হয় মনে মনে প্রার্থনা করে। এখন আর তার কোন সন্তান নেই। এই ঝড়ের রাতে ঘরে রয়েছে শুধু ভানু। ভানুর মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না, শুধু জবুথবু হয়ে বিছানার উপরে এক কোণে বসে থাকে আর বাঁশ পাতার মতো কাঁপতে থাকে।
সকাল হলেই বৃষ্টি থেমে যায়, পূর্বাকাশে বড় হলুদ হয়ে সূর্য ওঠে। আকাশ থেকে কেটে যায় মেঘ। ভীম উঠোনে জলের মধ্যে নেমে বাড়ির ড্রেনের মুখে আটকে থাকা প্লাস্টিক পরিষ্কার করে দিলে ধীরে ধীরে কমে যায় জমে থাকা জল। তারপর কুড়াল নিয়ে রীতিমত লেগে যায় জাম গাছ কাটতে।
ভানু ছাগলটিকে ঘর থেকে বের করে ছেড়ে দেয়, বিকেলে একাই ফিরে আসবে। তারপর সেও লেগে যায় স্বামীর সঙ্গে ঘরদোর পরিষ্কার করতে। দিনের বেলা আর কোথাও বেরোয় না ভানু। গা’টা গরম গরম অনুভব করছে, মাথাটা ঝিমঝিম করছে, শুয়ে থাকে ভানু।
এর মধ্যেই ঘটে যায় একটি ঘটনা, যা ইতিপূর্বে বুড়ি বালাসনের বুকে কখনও ঘটেনি। শ্মশানের বাঁধের কিনারে এসে ঠেকেছে একটি তরুণ যুবকের লাশ। সকাল বেলায় জেলেরা মাছ ধরতে এসে জাল ফেলতে গিয়ে তাদের চোখে পড়ে। রীতিমত খবরটি ছড়িয়ে যায়, বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ এসে ভিড় জমাতে থাকে। পুলিশ এলে লাশ তুলে নিয়ে লাশকাটা ঘরে পাঠিয়ে দেয়।
লোকমুখে এবং পরদিন দৈনিক সংবাদ থেকে জানা যায় যে, শ্মশান থেকে দক্ষিণ দিকে যেদিকে নদীটা বাঁক নিয়েছে সেখান থেকে ৫০০ মিটার দুরত্বে যে নতুন অ্যাপার্টমেন্টগুলো তৈরি হচ্ছে, সেখানে মেদিনীপুর থেকে আসা কম বয়সী শ্রমিকদের মধ্যে একজন, সেই ছেলেটা। আরও যেটা জানা যায় যে, সেটা হল, তাদেরই একজন ত্রিকোণ প্রেমের প্লটের থেকে একজন নায়ককে চিরকালের মতো বিদায় দিয়ে দিল এই মর্ত্যলোক থেকে।
এই ঘটনা সকল লোককে কিছুটা আশ্চর্য করলো ঠিকই কিন্তু তাতে যেমন অ্যাপার্টমেন্টের কাজ থামলো না তেমনি বুড়ি বালাসনের বুকে রক্তের দাগ লাগলো ঠিকই কিন্তু নদীর স্রোত থামলো না। নদী আপন গতিতে নিজের মহিমায় বয়ে যেতে লাগলো। রক্তের দাগ গেলো মুছে।
তবুও বেশ কয়েকদিন রয়ে গেলো এই ঘটনার রেশ। কয়েকদিন দেখা মেলে নি ছেলেদের নদীর পাড়ে।
সময়ের সঙ্গে মানুষের যেমন ভীতি কমে আসে ঠিক তেমনি কয়েকদিন পর আবার যখন উত্তেজনা কমে আসে পরিস্থিতি গরম থেকে নরম হয়ে আসে সমস্ত ছেলেরা বেশ উপস্থিত হতে লাগলো বুড়ি বালাসনের বুকে।
যে কদিন ছেলেরা নদীতে আসেনি যেন নদী মন্দ গতিতে বয়ে চলছিলো কিন্তু বর্তমানে নদী স্বমহিমায় সোঁ সোঁ করে ছেলেদের গায়ে ধাক্কা দিতে দিতে আপন আনন্দে বইতে শুরু করে দেয়।
নদীর বাঁধে রাজ বসে থাকে নিশ্চিন্ত মনে। যে কোন সময়ে বৃষ্টি নেমে আসতে পারে। আকাশ কালো মেঘলা হয়ে আছে। তবু রাজের ভালো লাগে এই বর্ষায় পোয়াতি বুড়ি বালাসনকে চুপচাপ বসে দেখতে। সারা বছর বইতে বইতে রুগ্ন শুষ্ক করুণ হতে হতে হঠাৎই আশ্চর্যজনক ভাবে এই সময়ে গর্ভবতী হয়ে ওঠে। এই সমস্ত তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে লোকের ভাবে না। চোখে দেখতে পায় সবাই কিন্তু কেউই ভাবতে চায় না। অবাক দৃষ্টি দিয়ে এইসব ভাবতে রাজ ভীষণ ভালোবাসে।
হঠাৎ দমকা শীতল হাওয়া বয়ে যায়, রাজ চোখ বন্ধ করে, বাতাস অনুভব করে, তারপর সিগারেট ধরায়। একলা বসে ভাবে বুড়ি বালাসন কি জীবন্ত। রাজ নিজের মন খারাপের সময় সেই ছোট্ট থেকেই এখানে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়। এখানে এলে বাড়ির কথা মনে পড়ে না রাজের। চারপাশ নরম সবুজ আর গাছে পাখিদের কিচিরমিচির সব ভালো লাগে। ভাবতে ভালো লাগে পাখিদের সংসারের কথা।
নানান আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো ভানু। ভানু জিজ্ঞেস করে, ‘কী করছো এখানে বাবা? বৃষ্টি নামবে তো। বৃষ্টি এখনই আসবে দেখেছো তো আকাশটা কেমন করেছে। কোথাও মনে হয় বৃষ্টি পড়ছে, দেখছো তো ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। চলো আমাদের বাড়ি যাবে। তুমি তো কোনোদিন আমাদের বাড়িতে আসোই না। চলো বাড়ি যাবে। রান্না করে রাখছি, তোমার মেসো বাড়িতেই আছে, কাজে যায়নি। চলো খাওয়া দাওয়া করবে আমাদের বাড়িতে। বৃষ্টি চলে এলো মনে হয় ...।’
রাজের মনে একটুও বিরক্তি আসে না, খালি একটু মুচকি হেসে বলে, ‘অনেক বেলা তো হয়ে গেলো, বাড়ি ফিরবো এখন, অন্য সময়ে তোমাদের বাড়িতে যাবো।’
রাজ প্রায়দিন সকালের দিকে বুড়ি বালাসনের পাশে এসে একা একা বসে থাকতে ভালোবাসে। সে কত কী ভাবে এই নদী নিয়ে। এই নদী আশেপাশের জমিকে ভাসাতে পারে না, তবু রয়েছে এই নদীর বুক ভর্তি সাহস। প্রতিনিয়ত বুড়ি বালাসন সময়ের সাথে জীবন যুদ্ধ করে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অভিজ্ঞ এই নদীর থেকে রাজ প্রতিনিয়ত শিক্ষা লাভ করছে কি করে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হয়।
ভানু প্রায় নিত্যদিন রাজের পশ্চাদানুধাবন করে রোজ কিছুক্ষনের জন্যও গল্প করে যায়। ভানুর গল্পের কোন যৌক্তিকতা নেই, কোন দোষগুণ নেই, কখনও অপরের গুণগান, কখনও নিন্দে, কখনও নিজের স্বামীর প্রসংসা কখনও বদনাম, আবার কখনও নিজের সাজগোজ নিয়ে কথা বলতে থাকে। রাজ হাসিমুখে তার প্রতিক্রিয়া জানায়, কোন বিরোধিতা করে না। হয়তো সবটা সে মন দিয়ে শোনে না। ভানু আসে ভানু যায়। এভাবেই বেশ দিন কাটছিল।
রাতে ভীষণ রকমের বৃষ্টি হচ্ছিলো। ভানুর ঘুম আসছিলো না। মনে মনে ভাবছিলো কাল সকালে এমন সুন্দর করে সাজবে, যে রাজ তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে, আর কোনোদিন তাকে অবজ্ঞা করতে পারবে না।
সকালে বৃষ্টি কমতেই সংসারের সকল কাজকর্ম ছেড়ে ভালো করে সাবান দিয়ে স্নান করে, চুল শুকিয়ে নিয়ে, চুল ছেড়ে রাখে। মুখে কুমকুম রঙের আভা, চোখে কাজল ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, কানে দুল, কপালে লাল টিপ পড়ে, লাল ব্লাউজের উপর একটি নতুন শাড়ি পড়তে পড়তে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে যায়। পায়ে আলতা পড়ার সময় আর মিলল না। রাস্তা দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যায়। চালচলন দেখে কেউ মনের চঞ্চলতাটা ধরতে পারবে না। ঝর্ণা যেমন খাড়া পাহাড় থেকে যে গতিবেগে স্রোতের ন্যায় ঝরে পড়ে ঠিক তেমনি ভানুর মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। খোলা আকাশে একঝাক পায়রা শুধু এদিক আর ওদিক করছে। লোকেরা তাকে দেখলে এগিয়ে আসে কথা বলার জন্য, কিন্তু সে ধুলোর ন্যায় তাদের উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে এগিয়ে যায়। সে যত এগিয়ে চলছে মনটা ততই কেঁপে উঠছে। তবু আত্মবিশ্বাসের কোন অভাব নেই।
আজ সে রাজের সাথে অনেক কথা বলবে। রাজ সব কথা শুনবে, রাজের কথা ভানু শুনবে। রাজ আজকে তাকে একেবারে ফেলনা ভাবতে পারবে না। হাঁটতে হাঁটতে আরও কিসব যেন বিড়বিড় করে, আর ভ্রুর নানান ভঙ্গি করে আর একা একাই হাসে।
কিছুটা কছে যেতেই খেয়াল করে রাজ বাঁধের উপরে বসে রয়েছে। কিন্তু রাজ একা বসে নেই। সঙ্গে কেউ যেন আছে। রাজের ঘাড়ে কেউ যেন মাথা শুইয়ে রেখেছে। আরেকটু সামান্য কাছে যেতেই দেখতে পায় এবং বুঝতে পারে রাজের সঙ্গে জিনিয়া বসে রয়েছে।
ভানু হতভম্ব হয়ে যায় কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। সে কি রাজের কাছে যাবে নাকি বাড়ি ফিরে যাবে এই দোলাচলতা মনের মধ্যে চলছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভানুর চোখে জল চলে আসে। মাথা নিচু হয়ে আসে।
আকাশ মেঘলা হয়ে আসলো। ভানু মাথা ঘুরিয়ে পিছু হটতে শুরু করে, মনে মনে ঠিক করলো বাড়ি ফিরে যাবে। শুরু হয়ে গেলো গুড়ি বৃষ্টি। মনটা আরেকবার চাইলো পেছন ফিরে দেখুক রাজ কী করছে। পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলো যে, রাজ আর জিনিয়া দুজনে হাত ধরে দৌড়ে বাড়ির দিকে যেতে শুরু করেছে।
ভানু এই দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হাত দিয়ে চোখের জল মুছে।
পথের মধ্যে রাজ আর জিনিয়ার দৃশ্য শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার পর, বৃষ্টির মধ্যে ভানু দৌড়ে এসে ঝাঁপ দিলো বুড়ি বালাসনের বুকে।
বুড়ি বালাসনে কিছুক্ষণ নিজেকে ডুবিয়ে রেখে মনের আগুন নিভিয়ে, শীতল করে, ভেজা শরীরে বাড়ি ফিরে এলো।
একুশ
বা র্তা লা প
একমাস হয়ে গেছে দীপ্তি ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে চলে গেছে। ভাগীরথীকে আর একা একা ঘর থেকে বেরোতে দেয় না সন্ধ্যা আড্ডার জন্যে। রাজ আর কৌশিক দু-জনে গ্যালারীতে বেশ কয়েকদিন আসলো ঠিকই কিন্তু আড্ডা পুরনো দিনের মতো আর জমলো না। ধীরে ধীরে রাজ সন্ধ্যার আড্ডাতে আসা বন্ধ করে দিলো, সন্ধ্যার পর কম্পিটিটিভ এক্সামের জন্য পড়াশোনা করতে লাগলো। উপায় না দেখে কৌশিকও কম্পিটিটিভ এক্সামের পড়াশোনার জন্যে ঝুঁকল।
দীপ্তির হোস্টেলে মানিয়ে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয় নি। রুমে রয়েছে একজন হোস্টেলমেট রীনা। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়াশোনা করে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে ক্লাসরুমে যায়। লাগাতার তিনটে ক্লাস করার পর ওয়ান আওয়ারের ব্রেক লাঞ্চ সেরে তারপর আবার তিনটে ক্লাস শেষ করে রুমে ফিরে যায় রীনার সঙ্গে।
রীনা দীপ্তির ভালো বন্ধু হয়ে উঠলেও তবু তা শুধুমাত্র পড়াশোনার ক্ষেত্রে। রাতের পড়া শেষ করে তাদের কথোপকথন আর বেশিক্ষণ চলে না। সারাটা দিন ব্যাস্ততায় কেটে যাওয়ার পর ঘুমানোর আগে মোবাইলে ম্যাসেজ আদান প্রদানের মাধ্যমে শুধু কৌশিকের সাথেই কথা হয়।
দীপ্তি চলে যাওয়ার পর এবং বিশেষত সন্ধ্যার আড্ডা বন্ধ হওয়ার পর, কৌশিকের মনের মধ্যে একটা শূন্যতা দেখা দিতে লাগলো। একটা ফাঁকা ফাঁকা অনুভব হতে লাগলো। তার মনে হচ্ছে সে যেন একটা মানুষ হারিয়ে ফেলছে। মন খুলে কথা বলতে পারছে না। রাজ বন্ধু হলেও মনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতিটা তার কমছে না তার সঙ্গে কথা বলেও। সারাটা দিন এদিক ওদিক ব্যাস্ততায়, শূন্যতায়, আনন্দে, নিরানন্দে, আলস্যে, ক্লান্তিতে কাটিয়ে দেওয়ার পর রাতের বেলায় দীপ্তির সঙ্গে অনলাইন কথা হওয়ার পর একটা নিশ্চিন্তের ঘুম আসে।
সারাটা দিন আলস্যে কাটিয়ে দেয় দীপ্তি। ক্লাসে যায় না। মেঘলা মেঘলা আকাশ। ঠাণ্ডা আবহাওয়া। হস্টেলের চারপাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের হাওয়া বইছে। রাতের খাওয়া শেষে রীনা সামান্য পড়াশোনা করে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর এদিকে দীপ্তি পড়তে বসেনি ঠিকই কিন্তু সে ঘুমিয়েও পড়েনি। মোবাইলে সোশ্যাল মিডিয়া ঘাটতে ঘাটতে, সাইলেন্ট মোডে ভাইব্রেশন হয়ে উঠলো মোবাইল। মেসেজ আসলো কৌশিকের, ‘দীপ্তি কী করছিস?’
রিপ্লাই দিলো দীপ্তি, ‘একটু সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটছিলাম। তুই কী করছিস?’
‘তোর মেসেজের অপেক্ষা করছিলাম। ঘুম আসছে না। তুই তো আর মেসেজ করলি না। তাই আমি নিজেই করে ফেললাম।’
‘তাই বুঝি।’
‘তুই বুঝি অপেক্ষা করিস না?’
‘সত্যি বলবো, বাড়ি থেকে এখানে চলে আসার পর আর কারোর সাথেই তেমন কথা হয় না রে। এই তুই যা একটু রাতে মেসেজ করিস। তো অপেক্ষা তো করি কখন তোর মেসেজ আসবে। মিথ্যা বলব না।’
‘ক্লাস কেমন কাটলো আজ?’
‘আজকে ক্লাসে যাইনি রে। মনটা কেমন যেন করছিলো, ভালো লাগছে না। তোদের সবাইকে ভীষণ মনে পরছিলো।’
‘শরীর ভালো আছে তো? খেয়েছিস?’
‘হ্যাঁ খেয়েছি। তুই?’
‘হ্যাঁ খেয়েছি।’
‘বল।’
‘তোকে খুব মিস করছি জানিস। তোর কথাগুলো খুব মনে পড়ে। উফফ! কী তেজের সাথে কথা বলতি তুই। তোকে ভীষণ মনে পড়ছে।’
‘তুই তো খালি আমার সাথে ঝগড়াই করতি। কথা আর কোথায় বলতি। তবে সন্ধ্যগুলো খুব মনে পড়ে জানিস।’
‘দীপ্তি।‘
‘কী?’
‘কিছু নারে’
‘কী? বল, বলছি।’
‘না রে এমনি ডাকতে ইচ্ছে হল তোর নাম। তাই ডাকলাম, দীপ্তি।’
‘একটা কথা বলছি। তুই আমার প্রেমে পড়ে যাসনি তো। সাবধানে থাকিস। এগুলো একদম ভালো না।’
‘হাহা! কী যে বলিস তোর প্রেমে। হাসালি।’
‘হাসার কী আছে? আমার প্রেমে বুঝি কেউ পড়তে পারে না?’
‘অবশ্যই পড়তে পারে। তবে কোন স্বাভাবিক মানুষ নয়।’
‘স্বাভাবিক নয় মানে কী?’
‘এই ধর পাগল, ছাগল!’
‘কী বললি রে তবে, দাঁড়া তোর হবে একদিন, যা কথা বলবো না আর কোন দিন?’
‘লাভ ইউ ইয়ার।’ ‘এই নে একটা রোজ ইমোজি দিলাম।’ ‘ কিরে কথা বল।’ ‘ধুর ভালো লাগে না কিন্তু।’ ‘কথা বল বলছি।‘ ‘আচ্ছা বাবা সরি।’ ‘এবারে তো কথা বল।’ ‘সরি সরি সরি সরি সরি ...’
‘আরে বাপ রে! এতো মেসেজ। পাগল হয় গেলি নাকি? আমি একটু ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। আর এর মধ্যে পাগল ছেলেটা, এত সরি। যাক ভালোই তাহলে, এখানে তাও সরি বলছিস।’
‘তোর জন্য একটু পাগল হতে হয় আর কি।’
‘আহারে কি সুখ আমার, আমার জন্যে পাগল।’
‘শোন না একটা কথ।’
‘কী, বল?’
‘তোকে না খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। একটা ফটো দিবি প্লিজ।’
‘এত রাতে, এখন।’
‘হ্যাঁ রে।’
‘দাঁড়া দিচ্ছি।’
‘বাহ তোকে লাল শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে। আর কানের দুলটা বেশ মানিয়েছে। খুব সুন্দর লাগছে।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
‘তুই চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি আমি, তুই অনেকটা জুড়ে ছিলি আমার মধ্যে। তুই ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ রে।’
‘আহা, এতো বুঝি ভালবাসিস আমাকে? তা কোনোদিন তো মিষ্টি মুখে কথা বলতে দেখলাম না সামনে থেকে।’
‘সত্যি রে, বিশ্বাস করসছিস না, কী করলে বুঝবি বল?’
‘আচ্ছা থাক কিছু করতে হবে না। যেটা বলছি মন দিয়ে শোন, কম্পিটিটিভ পরীক্ষার জন্য ভালো করে পড়, আমাকে নিয়ে বেশি ভাবতে হবে না। আমি সবসময়ে তোর সঙ্গে রয়েছি, আর থাকব।’
‘আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম রে। কী যে হবে ভবিষ্যতে এই নিয়ে সারাটা দিন ভাবতে থাকি আমি।’
‘ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি উল্টাপাল্টা ভাবতে হবে না। বর্তমানে ঠিক করে খাট। পরে যা হবে হবে।’
‘তুই থাকলে সব পারব।’
‘আমি তো বললাম আমি আছি। চিন্তা করিস না। মনটা শান্ত রাখবি সবসময়ে। খারাপ কিছু লাগলে আমাকে বলবি।’
‘ঠিক আছে, তোকে বলবো।’
‘হ্যাঁ বলবি। শোন এখন অনেক রাত হল, প্রায় দুটো বাজতে চললো। এখন ঘুমো।’
‘এখনই ঘুমিয়ে পড়বি?’
‘হ্যাঁ রে কাল সকালে ইম্পরট্যান্ট ক্লাস রয়েছে। ঘুমোতে হবে।’
‘ওকে। ঠিক আছে। গুড নাইট। সুইট ড্রিম।’
‘ইউ টু। বাই। খেয়াল রাখিস নিজের।’
‘তুইও রাখিস। বাই। কাল কথা হবে।’
বাইশ
স্রো ত স্বি নী
বেশ কয়েকদিন পর ভানু রাজদের বাড়িতে আসে। এসেই প্রথমে খেয়াল করলো রাজ বাড়িতে নেই। খবর নিলে জানতে পারে রাজ জিনিয়াদের বাড়িতে গিয়েছে। জিনির জ্বর চলে আসে, শরীরটা ভালো নেই, অতএব তাকে দেখতে গিয়ছে। রাজের মা ভানুকে জানায় যে কিছুদিন আগে জিনিয়া তাদের বাড়িতে এসেছিলো সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে তার জ্বর চলে আসে। ভানু কিছুক্ষণ নিজের সুরে নিজের বিভিন্ন তাল রাগে কথা বলে বাড়ি ফিরে গেলো।
এভাবেই পরপর তিন-চার দিন রাজদের বাড়িতে এসে রাজের দেখা পায় না সে। আর একদিন শেষে মুখ ফসকে ভানু বলে, ‘আমিও তো কত বৃষ্টিতে ভিজি কই আমার তো জ্বর আসে না।’
রাজের মা হেসে বলে, ‘আরে আমরা কত ছোট্ট থেকে মাঠে ঘাটে, রোদে বৃষ্টিতে মানুষ হয়েছি। ওরা কি আর তেমন। ওদের কি ওসব সহ্য হয়?’
ভানু আর কিছু বলে না। ভানু স্পষ্ট দেখল যে রাজের মা নিজের কাজের ছলেই এসব কথা বলছে। ভানুর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। ভানু হঠাৎই উঠে বাড়ি ফিরে যায়, তার চিরপরিচিত অভ্যাসের মতই।
বাড়িতে রোজ রোজ শুয়ে থাকে ভানু। সকাল-বিকাল শুয়ে থাকে, রাতে পড়ে পড়ে ঘুমায়। অনেক সময় দিনের বেলাতেও শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ে। রান্না-বান্না, স্নান, বাড়ির অন্যান্য কাজ ছেড়ে দিয়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকে। বিরক্ত হয় ভীম। প্রথম কয়েকদিন ভীম স্ত্রীর অসুবিধা দেখে নিজের হাতেই বাড়ির সমস্ত কাজ সেরে কাজে যেত। কিন্তু যখন কাজ থেকে ফিরে এসে দেখেন স্ত্রী না খেয়েই সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়েছে তখন নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছেন। তবে যে তার স্ত্রী রোজ না খেয়ে থাকতেন এমনটা নয়। যখন ভীষণ রকম খিদে পেত তখন ঠিক কিছু না কিছু খেয়ে নিতেন। কিন্তু একটা সময় পার হবার পর ভীমের সবকিছুই উৎপাত মনে হতে লাগলো। জিজ্ঞেস করলে, ভানু বলজ, ‘দেখতে পাচ্ছো না আমার জ্বর এসেছে!’
ভীম নিজে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ এনে দিলেও, সেসব মুখে তুলতো না ভানু। ভীমের সন্দেহ হলে গায়ে হাত দিয়ে দেখতে পায় যে ভানুর শরীরে জ্বরের কোন চিহ্ন নেই, কিন্তু শরীরটা বেশ দুর্বল।
ভানু জানে যে এইরকম ভাবে উৎপাত করতে থাকলে খবরটা ঠিক রাজদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাবে। তারপর একদিন ঠিক রাজ আসবে তাকে দেখতে। কিন্তু কই এতদিন কেটে যাওয়ার পরও তো তার স্বামী খবর দেয়নি সেই বাড়ি।
তারপর একদিন হঠাৎই সে সকাল সকাল কোন রকমে কাপড় বদলে চলে আসে রাজের বাড়িতে।
মাসিকে দেখতে পেয়েই রাজ জিজ্ঞেস করে, ‘কি মাসি এতদিন কোথায় ছিলে? দেখলাম না যে? কোথাও গিয়েছিলে নাকি?’
ভানু হাসিমুখে জবাব দেয়-‘আমি তো বাড়িতেই ছিলাম। আমার জ্বর এসেছিলো। তাই ঘর থেকে বেরোতে পারিনি। এখন একটু কমেছে। তোমরা তো আমার খবরই নাও না, আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি। কত ভাবলাম তোমরা আসবে আমাকে দেখতে, তোমরা সব স্বার্থপর। আমি আর আসবো না তোমাদের বাড়িতে। চললাম।’
অকস্মাৎ যেমন ঝড়ের মতো এসেছিলো ভানু তেমনি আবার হঠাৎই চলে গেলো। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বলে যাচ্ছে- ‘রাজের মা আমি গেলাম রে, আর আসব না তোদের বাড়িতে। দেখে নিস আর আসবো না তোদের বাড়ি।’
রাজের মা বাইরে এসে জানতে চায় যে ভানু এসেছিলো নাকি। রাজ জানায় যে চলে গেছে। রাজের মা জানে যে ভানু যতই বলুক আসবো না আসবো না ঠিক পরে এসে হাজির হবে। তাই ওর কথা নিয়ে কেউই গুরুত্ব দিতে নারাজ। ভানু ভানুর মতো রাস্তা দিয়ে চলে যায়। অনিমা অনিমার মতো আবার রান্না ঘরে ঢুকে গেলো রান্না করতে। রাজ বিকেলের মক টেস্টের জন্য পড়তে শুরু করে দিলো।
যেরকম ভাবে কথা দিয়ে আগের দিন সকালে বেরিয়ে গেছিলো ভানু রাজের বাড়ি থেকে ঠিক পরের দিন তেমন ভাবেই বিকেলে এসে হাজির হল রাজের বাড়িতে। বিকেলে এসে রাজকে দেখতে না পেয়ে জানতে পারে যে, ওরা সব বন্ধু মিলে জিনিয়াদের বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছে।
ভানু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘রাজের মা, তুই কিন্তু মেয়ে দেখে রাজের বিয়ে দিবি। আমিও যাবো দেখতে। এমন মেয়ে খুঁজে বের করবি সে যেন তোর দেখাশোনা করে। সব মেয়ে কিন্তু তোকে দেখবে না, আমি বলে দিলুম। এমন মেয়ে দেখে বিয়ে দিবি, যে কিনা তোর সব কথা শুনবে। তোর ছেলে কিন্তু তোকে দেখবে না, মেয়ে ভালো না হলে …।’
রাজের মা ভানুর সব কথা শুনছে না দেখে, নিজের দিকে আকর্ষণ তৈরি করার জন্য ভানু একপ্রকার জোর করেই নিজের চোখে জল এনে কাঁদতে শুরু করে দেয়। আর বলতে থাকে, ‘আমার তো ছেলে নেই। আমি বাঁজা। আমাকে কে দেখবে। আমি এতদিন জ্বরে ভুগলাম, কেউ দেখতে আসেনি। তোরা কেউ ভালো না। কেউ ভালো না। আমি মরলে কে জল দেবে আমাকে। আমার মুখে কে আগুন দিবে। আমার কেউ নেই।’
শাড়ির আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছে। রাজের মা জানে যে, ভানুর এসব কীর্তি রোজকার দিনের। তাই বিচলিত হয় না। ভানু নিজেই শান্ত ও চুপ হয়ে আসে।
হালকা বৃষ্টি হচ্ছে, পাড়ার ছোট মাঠে বেশ কয়েকটা বাচ্চা ছেলে ফুটবল খেলায় মেতে আছে। তার মধ্যে একটা ছেলে, নাম রজত। ভানু ছাতা নিয়ে রাস্তা দিয়ে আসছিলো পাড়া বেড়াতে বেড়াতে। রজতকে দেখতে পেয়েই ভানু থমকে দাঁড়ালো। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছেলেদের দৌড় ঝাঁপ দেখছিলো। তারপর হঠাৎই হাতের ইশারায় রজতকে কাছে ডাকল। রজত দৌড়ে এসে ভানুর কাছে দাঁড়ায়। ভানু নিজের থলে থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে দিলে, রজত স্বভাব বশতই তা ফিরিয়ে দেয়। বারেবারে ভানু জোর করতে থাকে, কিন্তু রজতকে কিছুতেই সে পরাস্ত করতে পারেনি। তারপর আবার দশ টাকার নোট বের করে দিতে চাইলেও সেখানে তাকে প্রত্যাখ্যান হতে হয়। ভানুকে একলা ফেলে রজত আবার বন্ধু মহলে চলে যায় ফুটবল খেলতে। আর এতেই বিগড়ে যায় ভানুর মাথা। এটুকু বাচ্চা সেও তাকে প্রত্যাখ্যান করছে, এতো সাহস। হঠাৎই আর নিজেকে না সামলাতে পেরে চিৎকার করে ওঠে-‘পাগলের বাচ্চা’ তারপর নিজেই বিকট দাঁত বের করে আত্মপ্রসাদের উপভোগের মতোই হা হা করে হাসছে।
তারপর ঘটে গেলো লঙ্কাকাণ্ড।
লঙ্কাকাণ্ড বিস্তারিত বলার আগে রজতের আদি কাণ্ডটা বলা প্রয়োজন। নিম্নে বিস্তারিত বলা গেল।
আজ থেকে প্রায় আটবছর আগে এই রকমই বর্ষার সময়েই ঘটেছিলো একটা ঘটনা। আষাঢ় মাসের রথের মেলার পর থেকেই পাড়ার মধ্যে দেখা যেত এক পাগলীকে। যেখানে যা পেতো তাই মুখে দিতো। পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে বেশ খেতে দিত খাবার। আর রাতে এক মুদির বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকতো।
পাগলীর উপরে লোকজন নারাজ হতে পারেনি কারণ সে ছিল গর্ভবতী। সম্ভবত পেটে ছিল ছয় কি সাত মাসের বাচ্চা। অন্তত পক্ষে তাই হবে কারণ তখন সেখানকার মহিলারা তাই অনুমান করেছিলো।
পাগলীর মাথা ভর্তি চুল প্রায় জট লাগা অবস্থায়। মাথা চুলকে চুলকে ঘুরত আর খাবার খুঁজত। যেখানে যা খাবার পেত সব খেত।
পাড়ার লোকের ঠিক করলো এই বর্ষায় ক্লাবের বারান্দায় খড় বিছিয়ে ত্রিপল টাঙ্গিয়ে একটা ছোট্ট তাবু করে দিলে সেখানে এই পাগলী থাকতে পারবে।
পাগলীর যখন খাওয়া জুটতো না তখন রাস্তার পাশে শুয়ে কাটাত। বেশ কিছুদিন এভেবে কাটার পর একজন বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এলেন এবং তিনি তার সাধ্যমতো এই পাগলীর দুবেলার খাওয়ার দায়িত্ব নিলেন।
খাওয়া দাওয়া শেষে রাতের বেলায় ক্লাবের বারান্দায় একা থাকতে হতো এই পাগলীকে। ঠিক তখনই একদিন রাতের বেলায় যখন সবাই প্রায় ঘুমে আচ্ছন্ন তখনই হঠাৎই পাগলীর চিৎকার শুনে পাশের বাড়ির লোকজন ছুটে যায়, দেখতে পায়, পাড়ার জগা মাতাল এসে পাগলীকে ধর্ষণের চেষ্টা করছে। লোকজন তৎক্ষণাৎ জগাকে ধরে নিয়ে গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাড়ার মাতব্বররা চড়, কিল, ঘুষি বসিয়ে দিলেন দমাদম। রীতিমত খবর দেওয়া হল পুলিশে। পুলিশ এলেন আর জগার স্থান হয়ে গেল শ্রীঘরে।
এই ঘটনার সুবাদে ফের পাগলীর বাসস্থান পরিবর্তন হল। ফের এগিয়ে এলেন সেই বয়স্ক মহিলা যিনি খাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি তার ঘরে স্থান দিলেন এই পাগলীকে।
বয়স্ক মহিলাটির কোন ছেলে সন্তান নেই। যাও একটি মাত্র মেয়ে ছিল বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের এই পর্যন্ত কোন সন্তান হয়নি পনেরো বছর কেটে যাবার পরেও।
তিনি মনে মনে কোথাও একটি ক্ষীণ সূক্ষ্ম আশার আলো পান। পাগলীর যদি কোন সন্তান হয় তবে সে সন্তান তিনিই রেখে মেয়েকে দিবেন; সে তাকে মানুষ করবে। আর এই পাগলীকে নিজের বাড়িতে রেখে যত্ন আত্তি করবেন।
দিন কেটে যায়। ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের তিথিতে হঠাৎ খুব ঝড় ওঠে রাতে। পাগলীর প্রসব আসন্ন। সেই ঝড় রাতেই পাশের লোকজনকে খবর দিলে, পাড়ার লোকজন বৃদ্ধা বিন্দু মাসিকে ডেকে আনেন। তিনিই আগে প্রচুর সন্তান প্রসবে সহায়তা করেছেন। তিনি এলে তড়িঘড়ি গরম জল থেকে শুরু করে, নিজের অস্ত্রের সাহায্যে, ভোর রাতের দিকে একটি পুত্র সন্তান প্রসব করান। সন্তান এবং পাগল মা উভয়েই সুস্থ। সন্তানের কান্না শুনে পাগলী হেসে ওঠে। তারপর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে।
পরদিন হয়েছে আরেক কাণ্ড। আশেপাশের গ্রাম থেকে হাজির হয়েছে শ’য়ে শ’য়ে লোক। সকলেই দেখবে এই পাগলীকে আর পাগলীর সন্তানকে। বহু মহিলা ভিড় ঠেলে এসে বলতে লাগলো-‘আমাকে দিন ছেলেটা, আমি দুটো মানুষ করেছি আরেকটা করবো।’
অন্য আরেকজন বলে, ‘আমার খালি মাত্র একটা মেয়ে, ছেলের মা হতে পারিনি আমাকে দিন। ছেলের মুখে মা শুনতে পারবো।’
আরেকজন বললেন, ‘আমার অনেক সম্পত্তি, যেভাবে সোনার চামচ দিয়ে বাকিগুলো মানুষ করেছি একেও করব।’
ভানুও সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিল, সে বললে, ‘দিদি আমাকে দিন, আমার কোন ছেলেপিলে নেই। আমিও মা হব।’
বয়স্ক মহিলাটি কোনোরকমে পরিস্থিতি সামলে নিয়ে, নিজের কাছেই সন্তান রাখলেন। কেউ আর সন্তানের মায়ের খোঁজটাই রাখে না। সকলের সামনে সুযোগ বুঝে নিজের মনের কথা জানায় সে। ‘এত দিন আমি আদর যত্ন করে পাগলীকে সামলেছি। আমার দায়িত্বেই পুত্র সন্তান হয়েছে। এই সন্তান আমি আমার মেয়েকে দেবো। আর এই পাগলী যতদিন আমাদের বাড়িতে থাকবে ততদিন আমিই খেয়াল রাখবো।’
তার দাবির উপরে উঠে আর কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনা।
পাগলীটি ধীরে ধীরে সুস্থ সবল হয়ে উঠলো। খায় দায় ঘুরে বেড়ায়। সন্তানের কোন খোঁজ রাখে না। কিংবা তার যে কোন সন্তান রয়েছে সে চেতনাও তার মধ্যে নেই। এভাবে দুমাস কেটে যাওয়ার পর, পাগলী যেভাবে হঠাৎ এসেছিলো একদিন হঠাৎই উধাও হয়ে গেল। কেউ আর কোন খোঁজ রাখে না। অতএব শেষে সন্তানটি নিয়ে বয়স্কার মেয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যায়।
তারপর সময় আপন বেগে বয়ে গেল। অনেক ঝড় আসলো অনেক হাওয়া বয়ে গেল নদীর জল গড়িয়ে গেল। সবাই প্রায় সব কিছু ভুলে গেল।
এবারে আসা যাক লঙ্কা কাণ্ডে। ঠিক যখন রজতকে পাগলীর ছেলে বলে চিৎকার করতে লাগছিল ভানু, ঠিক তখনই সে পথে ছাতা নিয়ে রাজ হেঁটে যাচ্ছিলো দোকানে। রাজকে দেখতে পেয়ে ভানু আরও জোরে চিৎকার করে সপ্তম সুরে রজতকে উদ্দেশ্য করে যা খুশি গালাগাল করতে শুরু করে দেয়।
রাজের নজরে বিষয়টা পড়লে তৎক্ষণাৎ পরিস্থিতি সামলে নিয়ে মাসিকে ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও যে বিষয়টা সেখানে সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিলো তেমনটা নয়। আসল আগুনটা লাগলো এখন।
রজত বাড়ি গিয়ে ক্রমে ক্রমে মায়ের কাছে এবং দিদার কাছে জিজ্ঞেস করতে লাগলো যে তাকে কেন একটা মহিলা ‘পাগলীর ছেলে, পাগলীর ছেলে’ বলে ডাকছিল।
রজতের দিদা খবর নিয়ে জানতে পারে যে রজতকে ভানু পাগলী ‘পাগলীর বাচ্চা, পাগলীর ছেলে’ বলে চিৎকার করছিলো।
তারপর রজতের দিদা সঙ্গে সঙ্গে ভানুদের বাড়িতে গিয়ে শাসাতে গেলে উল্টে ভানু আরও চিৎকার করে বলে যে সে যা করেছে তা ভালোই করেছে। এমনকি সে আরও জানায় যে যতবার রজতকে দেখতে পাবে ততবার পাগলীর ছেলে বলেই ডাকবে। বাড়িতে ভীম ছিলেন না। ভীষণ রকম রেগে গিয়ে ভানুর চুলের মুঠি ধরতে গেলে, ভানুও কাঠের চ্যালা নিয়ে ছুটে আসে। রজতের দিদা পরিস্থিতির বিপরীত স্থানে থাকাতে কোন রকমে তখন তিনি বেরিয়ে আসেন।
সন্ধ্যা বেলায় রজতের দিদা, মা এবং আরও দুজন ভানুদের বাড়িতে আসেন। ভীম বাড়িতেও ছিলেন। সমস্ত বিষয়টা খোলসা করে বললে রীতিমত ভীম রেগে যায় এবং স্ত্রীকে চড় মারতেই, ভানু ঘরের ভিতরে দৌড়ে গিয়ে কাঠের বাটাম নিয়ে ছুটে আসে। তার একটুও ভ্রূক্ষেপ নেই যে সে একটা ভুল কাজ করেছে। সকলের সামনেই সকলকে শাসিয়ে দেয় যে, কেউ যদি তার গায়ে হাত তুলে, তাহলে সেও এই বাটাম দিয়ে খুন করে দিবে। সে কোন খারাপ কাজ করেনি, একটুও আক্ষেপ নেই, আরও বলে, ‘যতবার সে ওই ছেলেকে দেখবে ততবারই পাগলীর বাচ্চা বলেই ডাকবে।’
মাত্র এই কয়জন লোক এসে যে কোন কাজ হয়নি তাতে বুঝতে কারও অসুবিধা রইলো না। এই সমস্যার একটি স্থায়ি সমাধান খুব জরুরি। সকলের মধ্যে জল্পনা কল্পনা চলতে লাগলো।
রাজের দিদা পঞ্চায়েতে খবর দিলে, পঞ্চায়েতসহ আরও তিনজন মাতব্বর ঘটনার সত্যতা যাচাই করে, সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়াসী হয়।
পরের দিন বিকেলে মিটিং বসবে। ভীম ছেত্রী এবং তার স্ত্রী ভানুমতী ছেত্রী দুজনকে মিটিঙে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
ভীম তো ভীষণ চিন্তিত সকাল থেকে। ভানুর রোজ রোজ এইসব কীর্তিকলাপ তার আর ভালো লাগে না। রোজ রোজ এত ঝক্কি আর এত লোকের কথা সহ্য হয় না। সেও মনে মনে একটা স্থায়ী সমাধান চায়।
বিকেলে মিটিং বসলো রজতের দিদাদের বাড়িতে। ভীম এবং ভানু দুজনেই উপস্থিত রয়েছে। সঙ্গে আরও উপস্থিত রয়েছে রাজের মা সহ আরও পাঁচ ছয় জন। মিটিং শুরু না হতেই পাড়ার মহিলারা ভানুর সম্পর্কে নানান অভিযোগ করতে শুরু করে দেয়। সকলেই এই ঝগড়াটে ভানুর থেকে নিষ্কৃতি চায়। তবে বর্তমানে যে অভিযোগটি রয়েছে তা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মিটিঙের মাঝে একজন লোক বেশ বোঝাচ্ছিলেন যে, এই বাচ্চাটিকে সরাসরি এভাবে আক্রমণ করা ভানুর উচিত হয়নি। এতে বাচ্চাটির ভবিষ্যৎ সংকটের মুখে পড়তে পারে। বাচ্চাটি ছোট থেকেই নানান দুশ্চিন্তা করতে শুরু করে দিবে। আর রজত যেহেতু এখন এখানকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়েছে এবং এখানেই থাকবে তাই এইরকম ঘটনা বারেবারে ঘটলে, পরে বড় হয়ে পিতৃ পরিচয় জানতে চাইবে। শেষে সত্যটা জানতে পেরে যদি কিছু একটা খারাপ কাজ করে বসে কিংবা আত্মহত্যা।
মাতব্বররা বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে চাইলে, স্থানীয় মহিলারা বিষয়টির উপরে জোর দেয়। বলে যে বিষয়টি অতি গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। একটা স্থায়ী সমাধান চাই।
ভীমের এইসব ঝামেলা মনে হয়। তার আর এখানে বসে থাকতে ভালো লাগে না। সে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে নেয় ভানুর হয়ে, ‘ভানু আর কোনোদিন এমন কাজ করবে না।’
অন্য আরেকজন বলে ওঠে, ‘আপনি কী করে ভানু পাগলীর কথা দিচ্ছেন? আপনি কি সারাদিন ওর পাহারা দেবেন?’
ভানু শুনতেই এতো লোকের মাঝে ফেটে পড়ে, ‘পাগলী কাকে বললি? তোর চোদ্দগুষ্টি পাগল। আমি কোন ভুল করিনি। আমাকে কেন শাস্তি দেওয়া হবে? তোদের সবগুলোকেই মরতে হবে।’
রাজের মা ভানুকে বারেবারে বুঝিয়ে শান্ত করে। ঘরের বাইরে নিয়ে এসে আলাদা করে বসে। ভানু ধীরে ধীরে রাজের মাকে জানায়, ‘এই বাচ্চাটিকে আমাকে দিল না কেন? তোর তো ছেলে আছে। আমার ছেলে নেই, আমার কেউ নেই। আমি কি মা হতে পারবো না?’
শেষে ভানুর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে পঞ্চায়েতেরা স্থায়ী সমাধানের জন্য ভীমকে স্পষ্ট ভাবে জানায় যেঃ ‘রজত যেহেতু আমাদের এখানে থাকবে তাই ভানুকে আর এদিকে আসতে দেওয়া যাবে না। আর যদি তা সম্ভব না হয় তবে অনিশ্চিত কালের জন্য বাপের বাড়ি বা অন্যত্র যেতে হবে তাকে। নয় তো তাদের পাড়ার বাইরে যেতে হবে। আর সেটা তারা চায় না।’
পঞ্চায়েতেরা কিছু পথ দিলো ভীমকে। একটি পথ বেছে নিতে হবে।
ভীম এবং ভানু উভয়ে বাড়ি ফিরে আসে। ভীম জানে ভানুকে ঘরবন্দি করে রাখা যাবে না। তবে কি তাকে এখন বাপের বাড়ি দিয়ে আসবে। কিন্তু এই শেষ বয়সে বাপের বাড়িতে দিয়ে আসা বোধ হয় ঠিক হবে না, যেখানে মা নেই দাদা নেই রয়েছে নিজের বলতে বুড়ো বাপ। শেষে ঠিক করে যে তারা পাড়ার বাইরেই একসঙ্গে থাকবে।
ভীম পঞ্চায়েতের কাছে গিয়ে জানায় যে তারা পাড়ার বাইরে গিয়েই থাকবে, একটা জমি দিলে ভালো হয়। পঞ্চায়েত আশ্বাস দেয় যে তাদের বর্তমান জমির সঠিক মুল্য ঠিক জোগাড় করে দিবে। আর তা দিয়েই বসবাস যোগ্য একটা জমি পাইয়ে দিবে।
কয়েকটা দিন এইসব কাজের জন্য ভীমের মাথা যখন ঠিকঠাক কাজ করছে না তখন প্রতিদিন স্নান খাওয়া দাওয়ার অনিয়মে, এবং বাধ্যতামূলক ঘরবন্দি হয়ে যাওয়াতে ভানুর জ্বর চলে আসে।
রাতের জানালা খোলা, শোঁশোঁ করে বাতাস ঢুকছে ঘরে। ভানু কিসব যেন হিজিবিজি কথা বলতে থাকে। চোখের সামনে ভাসে একটা ফুটফুটে ছেলে। তাকে মা মা করে ডাকছে। সে খাইয়ে দিচ্ছে। আরও কিসব যেন ভাবে, বড় হলে রাজের মতো হবে, কলেজে যাবে, আর সে ভাত রান্না করে অপেক্ষা করবে অনিমার মতো। তারপর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে খাইয়ে দিবে ভাত।
সারাটা রাত এইসব ভাবে। ঠিক করে ঘুম হয় না। ভোরবেলায় দুটো পাখি খোলা জানালায় উড়ে এসে কিচিরমিচির করলে ঘুম ভেঙ্গে যায়।
দুপুর পর্যন্ত ভ্যাপসা গরমে ঘরে মনমরা হয়ে বসে থেকে যখন আর মন মানে না তখন আর কিচ্ছুটি না ভেবে এই ঘরবন্দিকে উপেক্ষা করে সে চলে আসে রাজের বাড়িতে। রাজের মাকে জানায় তারা আর এখানে থাকবে না, জমি বিক্রি হয়ে যাবে এরমধ্যেই। রাজের মা কিছু বলতে পারে না, এমনকি তিনি সান্ত্বনাটুকু দিতে পারেন না। অথচ ভানু কোন সান্ত্বনা চাইতে আসেনি। সে এসেছে শুধুমাত্র একটিবারের জন্য রাজের সাথে দেখা করতে।
রাজ স্নান করে এসে ভানুর পাশ দিয়ে ঘরে ঢুকে। ভানুর চোখ আটকে যায় রাজের নগ্ন দেহ দেখে। তার মাথা আর ঠিক থাকে না। সোজা ভানু চলে যায় রাজের ঘরে। রাজ পোশাক পড়তে শুরু করলেই, সে রাজের হাত চেপে গালে ঠোঁটে চুমু দিতে শুরু করে উন্মাদের মতো।
রাজ প্রথমে কি করবে বুঝতে না পারলেও তৎক্ষণাৎ এটা বুঝতে পারে যে, ভানু মাসি থেকে বাৎসল্য রস ঝরছে না, এ রস মধুর রস। নিজের সম্বিৎ ফিরে পেতেই রাজ এক ঝটকা দিয়ে দেওয়ালে ধাক্কা দেয় ভানু মাসিকে। তার কপালে লাগা সত্বেও এবং তা দেখা সত্বেও রাজ তাকে সতর্ক করে দেয় যে আর কোনোদিন যদি ভানুকে এ বাড়িতে দেখা যায় তাহলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে। আরও বলে, ‘ছিঃ! তোমাদের এখানে থাকাই উচিত নয়। সব পাগলের দল।’
এই প্রথম ভানু রাজের মুখে পাগল শব্দটা শুনলো। ভানু তৎক্ষণাৎ রাস্তা দিয়ে ছুটে সোজা বাড়ি ফিরে আসে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে তার চোখে জল চলে আসে। আর একা একা বলতে থাকে, ‘রাজ আমাকে পাগল বলল। আমি পাগল! রাজ আমার ছেলে না, রাজ আমার কেউ না, কেউ না। একদিনও আসেনি আমাদের বাড়িতে। আমার যে জ্বর সেটাও দেখল না। থাকবো না আমরা এখানে থাকবো না। চলে যাবো অনেক দূরে চলে যাবো।’
কথা বলতে বলতে ঘরের বারান্দায় বসে পড়ে, আরও বলতে থাকে-‘আমাকে কেউ ভালোবাসে না, কেউ না, ভীম না, রাজ না, রজত না, অর্জুনও না!’ অর্জুনের কথা মনে পড়তেই তার মনে পড়ে সেই দিনের কথা, কী ভাবে বাড়ির উঠোনে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছিল অর্জুন, সে কিচ্ছু করতে পারেনি। চিৎকার করে ওঠে ভানু, ‘আমি অর্জুনকে চাই।’
তারপর আবার তার হঠাৎই মনে পড়লো মিটিঙে কে একজন বলেছিল রজত বড় হলে আত্মহত্যা করতে পারে। ভানু মাথা নাড়ে আর বলতে থাকে, ‘রজত কেন আত্মহত্যা করবে? আত্মহত্যা করবে ওই বিকাশ মাস্টার।’
তারপর আবার ভাবে ভানু ভাবে বিকাশ মাস্টার যেদিন মরেছিল কতলোক গিয়েছিল তাকে দেখতে। এমনকি রাজও গিয়েছিল।
মনে মনে ভাবে ভানুও যদি মরে তবে তাকে দেখতে অনেক লোক যেমন আসবে তেমনি রাজও আসবে।
যেমন ভাবনা তেমন কাজ, ভীম সারাদিন বাড়িতেই ছিল। ভানু হঠাৎই দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে চিৎকার করে বলে, ‘আমি মরলাম তোমরা থাকো!’ ঘরে রাখা বিষাক্ত ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে ফেলে।
ভীম এইসব কীর্তিকাণ্ড দেখে ভীত হয়ে পাশের লোকজনকে ডেকে আনলে ভানুর অবস্থার শোচনীয় দশা দেখে, সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
স্টমাক ওয়াশের পর ভানুকে বেডে দেওয়া হয়।
সেদিন রাতের বেলায় সমস্ত ঘটনা রাজ জিনিয়াকে ফোনে জানায়। পরের দিন যিনি জোর করে রাজকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে আসে ভানু মাসিকে দেখতে। জিনি ভানুর কাছে যেতেই, ভানু একটু হেসে, জিনিয়ার কপালে চুমু দিয়ে, চুলে হাত বুলিয়ে বলে-‘তুমি আমদের রাজের বউ হবে দেখে নিও।’
রাজ কাছে ঘেঁষে না। দূর হতে একটা বিস্ময়ের হাসি হেসে জিনিকে সঙ্গে করে নিয়ে বাড়ি ফিরে।
সকলেই জানল যে তাকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে দেখে সেই শোকে বিষ পান করেছে। কিন্তু আসল সত্য রাজের কাছে গোপন রয়ে গেল।
রাতের বেলা রাজের ঘুম আসছে না, ভীষণ গরম, জানালা খুলে রেখেছে। ভাবতে লাগলো, কেন এই বিষ পান। এই বিষ পান কি মৃত্যুর জন্যে নাকি নতুন কোন ছক, নতুন কোন কৌশল নিজেকে টিকিয়ে রাখার। আর এই বিষ পান তো তার প্রথম না।
রাজ একে একে ভাবতে থাকে ভানুর গোটা জীবন। যেন একটা সম্পূর্ণ জীবনই ট্র্যাজেডি। প্রথমে আসাম, তারপর অর্জুন, তারপর সংসার, তারপর সন্তান, তারপর ভীম, তারপর রজত, তারপর উচ্ছেদ, তারপর রাজ। যদি ভানুর মৃত্যু হয়ে যেত তবে কি সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতো সে যে জানে অন্তত পক্ষে এই বিষ পানের কারণ। কাল সকালে একা গিয়ে একবার ক্ষমা চেয়ে আসবে, রাজ মনে মনে ঠিক করে রাখল।
পরদিন সকালে রাজ ভানুদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলে দেখতে পেলো বাড়ির বারান্দায় বসে ভানু রজতকে কোলে নিয়ে আদর করে খাইয়ে দিচ্ছে।
যেমনটা এই প্রথম রাজ ভানুদের বাড়িতে নীরবে এলো তেমনি হয় তো এই শেষবারের মতো সে ফিরে গেল নীরব শান্ত চিন্তামুক্ত হাসি হেসে।
বিষপান করেই ভানু আবার রয়ে গেল নিজ পাড়ায়। হয়তো এই বিষপান করেই রাজের থেকে নেশা কেটে গেলো ভানুর। হয় তো আবার নতুন কোন বিষয়ের উপর উন্মাদ হয়ে উঠবে। এই যে গোপনে গোপনে একটা প্রক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে গেল তা দুজনের কাছেই হয়তো চির গোপন রয়ে যাবে। এই গোপন ইতিহাস কোন বইয়ের পাতায় খুঁজলেও পাওয়া যাবে না।
বুড়ি বালাসনেও না জানি কত ইতিহাস গোপন রয়ে গেছে। কত যুদ্ধ, কত হার, কত ক্লান্তি, সেও বারে বারে বিষপান করে ধুঁকতে ধুঁকতে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু শেষে আবার জীবনে ফিরে আসে। বয়ে চলে আপন ধারায়।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে। মোবাইলের নীল ছাবির থেকে মন উঠে যায়, স্পষ্ট বুঝতে পারে কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা কাম। কোনটা বাৎসল্য রস, কোনটা মধুর রস, কোনটা যৌনতার রস!
জানালা, আসলে জানালা অনেক প্রকার। জানালা খুললেই আমরা দেখতে পাই বাইরের পরিবেশ, বিশেষ করে গাছপালা, পাখি, আকাশ, সূর্য। জানালা খুললেই সোঁ সোঁ করে ঘরে ঢুকে বাতাস। জানালা খুললেই দেখা যায় শিশু কোলে মায়েরা পথ দিয়ে হেঁটে ঢুকে যায় বিশ্ব সংসারর বাজারে। জানালা খুলে এইসব দেখার জন্য চাই দৃষ্টি, চাই মননের দৃষ্টি।
জানালা খুলে দিতে পারলেই গর্ভধারিণী হতে পারবে নারী। জানালা খুলে দিতে পারলেই হতে পারবে সন্তানের মা।
জানালা খুলে দিতে পারলেই জীবন যুদ্ধে ফিরে ফিরে আসা যাবে মুক্ত স্রোতস্বিনীর মতন।
স মা প্ত
Comments
Post a Comment