বিজয় ট্রেনে যাত্রাঃ তথাগত আচার্য

 

বিজয় ট্রেনে যাত্রা

তথাগত আচার্য

 


বারো কামরার একট ট্রেন। যে ট্রেনের হুইসেল উলুধ্বনি হয়ে যাচ্ছে আর ধোঁয়ার নাম মায়ের রান্নাঘর। ১৮৫৩ সালে যখন ভারতে প্রথম রেলপথ চালু হয় তখন মানচিত্রে দেশ ছিল অখণ্ড এক রান্নাঘর, যে রান্নাঘরের মাথায় ভাঙ্গা চাঁদের আলো পড়ে, ধোঁয়া কয়লার বেরোয়। মানচিত্র ছেড়ে, পরিবার ভাগ হয়, থালা-বাসন ভাগ, তরঙ্গ পুটলি কোলে কাখে বাচ্চা-কাচ্চা এদিক ও সেদিক ছড়িয়ে থাকে কাঁটাতার….
  তারপর শুধু ট্রেনের শব্দ ঝমঝম, শব্দদ্বৈত। শব্দদ্বৈত দেশি শব্দেরই হয়, তৎসম বা তদ্ভব শব্দের শব্দদ্বৈত এ দেশে খুব প্রচলিত নয়, যেমন ভারতবর্ষের রেলের ধারণা তেমন প্রচলিত ছিল না। বিলেতের শিল্প সভ্যতার অনিবার্য দান রেলপথ ভারতকে গ্রাম গ্রামাঞ্চল থেকে যেমন জুড়তে থাকে তেমনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শেষ ট্রেন গোয়ালন্দের ঘাট নীলফামারীর হাট যশোর খুলনা, তারপর একটা ব্যথা, ব্যথার গল্পগুলো কবিতা হয়ে যায়, গল্পরা কবিতা হয়ে।

১৯৮৫ থেকে ১৯২২ এই ৩৭ বছর, বারোটা কাব্যগ্রন্থ, একেকটা গ্রন্থ যেন একেকটা কামরা। বয়লারের পেট যেন কিছুতেই ভরে না আগুনের মতন খিদে তার, পেট ফেঁপে ওঠে, রান্না ঘরের ধোঁয়ায় খিদের গন্ধ থাকে। দুর্গা বমি করে … খিদে শুদ্ধ বমি সুদ্ধ লাইনটি ফিরে আসে কবিতার ভেতর। 

বিজয় দে'র ‘প্রিয় পঞ্চাশ’, স্বনির্বাচিত কাব্য সংকলনটি কবির বারোটি কাব্যগ্রন্থের পঞ্চাশটি কবিতার সংকলন। ৮৫ সালে বিজয়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘হে ধুতু হে ডাকটিকিট হে অরণ্য’র  কবিতা-পংক্তিটি শুরু হচ্ছে, ‘একজন অপদার্থ কবি শুধু নিজের কথাই ভাবে।’ এ যেন বাকি কবিতা পড়ার আগের ডিসক্লেইমার। বিজয়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থটি লেখা হচ্ছে ১৯৮৫ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন কার্যত নিশ্চিত। আর কবি ‘শুষে’ নিচ্ছে ‘সিকিম ডিস্টিলারি’। সময়ের ছাপ পড়ে কবিতায়, ‘ফরেন লিকার’ সহজ লভ্য না দেশে। ভূগোল শিলান্যাস করে কবিতার। একই কাব্যগ্রন্থের পরের কবিতা ‘নভেম্বর কার্নিভাল’ শুরু হচ্ছে  ‘শুষে খাই’ শব্দটি দিয়ে। অর্থাৎ ‘শুষে খাই’ শব্দটির যে অমোঘ প্রয়োগ করছেন শারীরিক ও মানসিক ভাবে তা অনেকটা এরকম, তিনি ‘শুষে খাচ্ছে’ ‘দৃশ্যাবলী অপছন্দ শূন্যতা ভালোবাসি শূন্যের উৎসাহজনক গোল কাঠ ও কুঠারের সমন্বয়বাদী ধর্ম ও ইউনিয়ন ও ফেস্টুন চিত্রকলা সর্বদা ভালবাসি না’। লক্ষণীয়, শব্দ ধীরে ধীরে রাজনৈতিক হয়ে উঠছে, ধর্ম ও ইউনিয়ন ফেস্টুন শিল্পকলার পাশে ঠিক যেভাবে ‘সর্বদা ভালবাসি না’ শব্দটি জায়গা করে নেয়।রাজনীতি হতে যাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনকে উড়িয়ে দিয়ে একটি সম্পূর্ণ কবিতা হয়ে ওঠে। কবিতাতেই কবি লিখছেন, ‘একই রকম জীবন যাপন স্বপ্ন দেখি খাই মহেন্দ্র দত্তের ছাতা তিস্তা প্রকল্প  নির্লোম উরু … খাই দেখি করি শুই খাই’ এগুলোকে বাতিল ক্রিয়াপদ হিসেবে তিনি উল্লেখ করছেন। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কলকাতা ১৯৬০-এর আমেরিকায় সোশ্যাল মুভমেন্ট হচ্ছে, তারপর কবিতায় হাঙ্গরি আন্দোলন, প্রথম কাব্য গ্রন্থে বিজয়ের নিরাশক্ত দিন যাপনের বর্ণনা মাত্র চারটি বাতিল ক্রিয়া পদ দিয়ে যেন তার কবিতাকে রাজনৈতিকভাবে পুরোপুরি সচেতন করেও নিজের এক অসম্ভব গতানুগতিকতার ছবি এঁকেছেন। একদিকে ঠান্ডা লড়াই, অন্যদিকে আমেরিকা বিরোধিতা ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী টালমাটাল অবস্থায় মহেন্দ্র দত্তের ছাতা, তিস্তা প্রকল্প আর পাঁচটি ক্রিয়া পদের মধ্যে রচিত হচ্ছে নভেম্বর কার্নিভাল। এই কবিতার নামটির দিকে খেয়াল করলে বোঝা যাবে নভেম্বরের সাথে বিপ্লব শব্দটির পরিচিত ছক না, রাজনীতির ভাষায় কবি যেন দেশের মাটিতে এক ‘এইরকমই জীবন যাপন’ এর আখ্যান লিখছেন কার্নিভাল করে। বিপ্লব যেখানে কার্নিভাল হয়ে ওঠে।

বছর পর ১৯৯৫। বিশ্বায়িত দুনিয়ায় দেশের সংজ্ঞা পাল্টাচ্ছে, নতুন করে মানচিত্রের রেখাগুলো-কে বৃত্তাকার করতে করতে দেশের মানচিত্র রেখার নাম হয়ে যাচ্ছে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ। সংযুক্ত রাশিয়া ভেঙে গেছে অনেকদিন হলো। ‘কাঠুরিয়া আন্তর্জাতিক’ লেখা হচ্ছে। বিজয় লিখছেন, ‘ভাদ্রের চাঁদ হয়ে একটি কুকুর আছে আমার কাছে।’ কবিতার শব্দ পাল্টাচ্ছে ক্রমশ। নভেম্বর থেকে ভাদ্র ঠিক কতটা দূরে? বিজয় লিখছেন, ‘লাথির স্বপ্ন দেখে একটি কুকুর খায় মাংসের ছবি।’ ‘লাথি’ শব্দটার সাথে দেশভাগ চাঁদ আর একটা মাংসের ছবি সাথে খিদে রাজনৈতিকভাবে এক যন্ত্রণাকে প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠা করছেন। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো যেন মাংসের টুকরো আর তার ছবি হয়ে ওঠে। যদিও কোন রাজনৈতিক বার্তা প্রতিষ্ঠার দায় তাঁর নেই সেখানে, কুকুর আর কবির চাওয়া গুলো এক হয়ে যাচ্ছে … জীবনানন্দ এর ১৯৪৬-৪৭  পর এভাবে কুকুর মানুষ দেশ চাঁদ বিশুদ্ধ কবিতায় আর কি খুব বেশি এসেছিল? 

স্বাধীনতার আভিধানিক একটা অর্থ মুক্তি বটে। স্বাধীনতা ও মুক্তি শব্দ দুটির মধ্যে অর্থ গত সাদৃশ্য থাকলেও ভাবগত বিস্তারের একটা বিরাট পার্থক্য আছে। ১৯৬০ সালের আমেরিকার সামাজিক আন্দোলন মুক্ত হতে চেয়েছিল সেখানে স্বাধীনতার চেয়ে মুক্তি শব্দটা অনেক বেশি জরুরি ছিল। এবার দেখা যাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী কবিতায় কবি বলছেন, ‘আমার দুই পায়ের পূর্ণ স্বাধীনতা দিবস। আজ থেকে আমি আর মাতৃভূমি আমার দুই হাতের মুঠোয় ঝুলছে দুটি দেশের মৃত্যু।’ কবি এক প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সত্যকে কবিতার মধ্যে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন যেখানে বলছেন, ‘এই আমার দুই পা যেখানে জল ছাপ সেখানেই মা। আমার পায়ের মাপে স্থির হোক সেরা মানচিত্র।’ এক বাঙাল পরিবারের এপারে  চলে আসা, জলছাপ দিয়েছে মানচিত্র রচনা করছে যে জলছাপ তার মায়ের পা। মাকে আন্তর্জাতিক করছে জলছাপ শব্দটি দিয়ে যেমন ওয়াটার শেড দিয়ে তৈরি হয়েছিল সম্পূর্ণ ইতালির মাতৃভূমির লড়াই। জলছাপে তৈরি কবিতা গদ্য উপন্যাস উপন্যাস নাটক কাঁটাতারকে মুছে দিতে পারিনি। জলছাপের দাগ বাংলা সাহিত্যে দেশ ভাগ স্মৃতিতে যতটা গাঢ় তা বাঙালি পাঠকের মনে একটা নিজস্ব মানচিত্র রচনা করে প্রতিদিন। কবিতাটি শিরোনামে প্রকাশ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ শব্দটির মধ্যে যে প্রতিপক্ষের রাজনীতি আছে তার উল্টোদিকে শুধু থাকে মায়ের পায়ের জলছাপ। এরপরই, জিওপলিটিক্স এর সঙ্গে বিজয়ের কবিতায় নীলফামারীর মত মফস্বলের চাঁদ যখন আরেকটি মফস্বলের উঠোনে এসে পড়ে কবির মফস্বল- কবি সত্তাটা প্রবল ও প্রকট হয়ে ওঠে পূর্ণিমার চাঁদের মত। জিওপলিটিক্যালি দুটো মফস্বলকে ডাক নামের আদরে ডাকেন, একটা সীমান্ত কবির আশ্রয় হয়। তার কবিতায় অমোঘ উচ্চারণ হয় রান্নাঘরে ‘পাগলি কোলে আয় ভাত খাব।’ তারপর লেখা হয় সেই বিশুদ্ধতম উচ্চারণ ‘তার দুই স্তনে শরণার্থীর মতো মুখ রেখে বলি ছড়াও কাঁটাতার সীমান্ত পেরিয়ে আমরা বিবাহে যাব।’ দেশভাগ কাঁটাতার একবার গল্প হয়ে উঠছে, একবার প্রেম কখনো রাজনীতি। কিন্তু সে কখনোই তার বিশুদ্ধ কবিতা থেকে সরে যায় না। কবিতার রাজনীতি থেকে সরে যায় না। দেশ ও মা বারবার ফিরে আসে বিজয়ের লেখায়। ‘কাঠুরিয়া আন্তর্জতিক’-এর  বিজয় যেন অনেক বেশি দেশি হয়ে ওঠে শব্দ ব্যবহারে, আস্তে আস্তে খোলস ছাড়তে থাকে কবি। বিজয় বলে ‘যুবতীর স্তন থেকে ঝরে পড়ছে সাদা কেরোসিন।’ সেই কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলছে আগুন, একলা রাত, নিরুদ্দেশের পথিক, বজ্র শিখা, ঝড়ের হাওয়া। সাদা দুধ কেরোসিন হয়ে যায়,  যা শেষে ‘তোমাকে’ই পুড়িয়ে ফেলছে। সমকালে জয় গোস্বামীর লেখা অসামান্য ‘গান' নামক কবিতায় বলছে, কুমারীর বুকে এসে কি কান্ড টাই না ঘটিয়েছে মনে করলে বোঝা যাবে, দুটো কবিতা বিজয়ের যোজন পার্থক্য, একই সময় লেখা দুটো কবিতা কোথায় গিয়ে স্পষ্ট রাজনৈতিক হয়, অথচ কবিতার সমস্ত শর্ত পালন করে। অর্থাৎ প্রেম থেকে রাজনীতি আবার রাজনীতি থেকে প্রেম, দুটোই অবিচ্ছেদ্য, দুই পারের দেশের মত, কী অনায়াস যাতায়াত বিজয়ের কবিতায়, মাঝে শুধু একটা আন্তর্জাতিক কাঁটাতার।

শতাব্দি পেরিয়ে আসে বারো কামরার ট্রেনটি। ২০০০ সালে লেখা হচ্ছে বম্বে টকি। লেখা হচ্ছে ‘১. নুন আনতে চিন্তা ফুরায়, ঘুনপোকাদের ভ্রুন সমস্যা।’ ছন্দ লক্ষ্য করলে বোঝা যাচ্ছে ছন্দ ভাষার। এক অদ্ভুত ছন্দ সমস্ত কাব্যগ্রন্থ জুড়ে কবি ব্যবহার করেছেন যা তীব্রভাবে রসাত্মক এবং সাথে সাথেই রাজনৈতিক। প্রথম পংক্তিটির সাথে দ্বিতীয় পংক্তিটি অর্থনৈতিক ও জৈবিক ক্রিয়াকে যেভাবে তিনি ছন্দে এনেছেন মাত্র দুটি লাইনে, একটি কবিতার নির্মাণ হচ্ছে দুটো লাইন ধরে। লেখা হচ্ছে স্বাধীনতা তুমি মুক্ত করো। স্বাধীনতা ও মুক্তি একই লাইনে পরপর দুটি শব্দ। পরাধীন গীতবিতান বা দায়বদ্ধ পূজা। অসম্ভব ভঙ্গিতে দেশ ও সংস্কৃতির নতুন পাঠ দিচ্ছেন কবি। বলছেন, ‘স্বদেশ ও প্রকৃতির যৌথ মেদিনীপুর’। স্বদেশ শব্দটি দেশ থেকে আরও কিছুটা নিজের। ‘মেদিনীপুর’ শব্দটিকে ব্যবহার করছেন যেমন স্বদেশ অর্থে আবার সতীশ সামন্ত সুশীল ধারা তাম্রলিপ্ত সরকার গভীর রাতে পতাকা উত্তোলন। কবি বলছেন বিপ্লবী পতাকার কথা। এখানেও এসে প্রেম ও রাজনীতির মতন বিপ্লব ও ‘হাহাকার রবীন্দ্রনাথকে’ মেলাচ্ছেন এক অনুকরণীয় রসিকতা দিয়ে। যেখানে রবীন্দ্রনাথকে ‘হাহাকার ঠাকুর’ বলছেন। অসম্ভব রাজনৈতিক সচেতন হয়ে বিজয় বলছেন একমাত্র ঠাকুরই জানেন ভীষণ কষ্টের আগস্ট মাস। ৪২ এর আন্দোলনের কথা মনে পড়ে গান্ধী মনে পড়ে। অহিংস চিরসত্য আমাদের নাম ধরে ডাকে। স্বদেশ এবং স্বরাজ শব্দটির ঐতিহাসিকভাবে প্রচারক ছিলেন গান্ধী স্বাধীনতা এবং মুক্তি দুটো পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করলেও গান্ধীও কি বিজয়ের কবিতার মত চিরসত্যকে বুঝেছিলেন, যা অহিংস শব্দটির ভেতর যে সত্য থাকে, সেই ভাবে। ঠিক যেমন চিরসত্য কবিতার ভেতরে থাকে একটা তাম্রলিপ্ত সরকার একজন সুশীল ধারা একজন সতীশ সামন্ত একজন গান্ধী আর থাকে এক চিরসত্য। কবিতাই সত্য হয়ে ওঠে দিনের শেষে। কবিতার রাজনীতি হয়ে ওঠে চির সত্য আমাদের। ঠিক পরের কবিতাটি কবি বলছেন, তোমরা আমাকে অক্ষর দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিব। বিপ্রতীপ এ পরাধীন পাঠ্য পুস্তকের ভেতর ‘শব্দ সন্ন্যাসীদের সশস্ত্র আনন্দমঠ’ --- কি সাংঘাতিক শব্দের ডিকশন। কী বৈপরীত্য! সশস্ত্র সংগ্রাম বিজয়ের কবিতায় শব্দ সন্ন্যাসীর প্রবল চিৎকার হয়ে আনন্দমঠে। তারপরেই কবি বলে, ‘তোমরা আমাকে তেঁতুল পাতা দাও আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেব/ তোমরা আমাকে বকফুল দাও আমি তোমাকে স্বাধীনতা দেব/ সশস্ত্র আনন্দমঠ এর ভেতর থাকে একজন জীবানন্দ।’ বিজয় সেখানে আশ্রয় নেয় আরেক কবি কাছে। সশস্ত্র আনন্দমঠের পাশে বসে মুখচোরা জীবনানন্দ। সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে জীবনানন্দ বা কাঠুরিয়া আন্তর্জাতিক সব ই তৈরি হচ্ছে বাংলা ভাষায়। শব্দের সন্ন্যাসী সংঘ বিপুল গেরুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে তোমরা আমাকে কামরাঙা দাও আমি তোমাদের ট্রাম লাইন দেবো। খেয়াল করলে ‘রক্ত’-এর বদলে বসানো শব্দগুলোকে পরপর  সাজালে দেখা যায়, তেঁতুল পাতা বকফুল এবং কামরাঙ্গা। অনিবার্য ট্রামলাইনের শুয়ে থাকেন জীবনানন্দ। কোন তেঁতুল পাতা কামরাঙ্গা জীবনানন্দ হয়ে ওঠে সীমান্ত থেকে ছেড়ে আসার শেষ ট্রেনের গায়ে লেপ্টে থাকা গন্ধ। গেরুয়ার বিপ্রতীপে  থাকা কবির নাম হয় নিরস্ত্র জীবনানন্দ। ঠিক তারপরই কবি বলেন,’ভোরবেলা কোন দেশ ভাগ হয় না।’ কবি লেখেন দেশ মানে কি?  ‘দুই লাইন ধানক্ষেত/ তিন লাইন সূর্যাস্ত/ বা চার লাইন পোস্টকার্ড….’ ‘একটা দেশ ভাগ না হওয়া সকাল বেলা, এখানে তোমার ও আমার ইচ্ছা অসম্ভব সমান।’ ভোর শব্দটিকে কবি কী দারুণভাবে ব্যবহার করেন এবং দেশ ও ঘুম ভাঙ্গা সকালের ইচ্ছে গুলোকে এক করে দেন। তাই দুই লাইন ধান ক্ষেত তিন লাইন সূর্যাস্ত বা চার লাইন পোস্ট কার্ড … দুই তিন চার প্রতিটা লাইন পাল্টে যাচ্ছে গল্প হয়ে। যেখানে কবিতারা গল্প হয় গল্পেরা কবিতা। ‘পথের গল্প এবং কাঁঠাল তলার বঙ্কিম বাবু’, কবি লিখছেন ভবানী পাঠকের গোপন আস্তানার কথা দেবী চৌধুরানীর কথা, এবার সশস্ত্র বিপ্লবের একদিকে যেমন ভবানী পাঠক থাকেন এক দিকে বঙ্কিমের আনন্দমঠ থাকে আরেকটা থেকে নদী যে নদীকে বিজয় বলছেন ‘তিস্তা একটি প্রবল রাস্তা’!  যেখানে কাঁঠাল গাছের তলায় বঙ্কিম বসে থাকেন। লক্ষ্য করুন, কাঁঠাল গাছের তলায় বঙ্কিম বসে থাকা এবং ইউরোপীয়  গদ্যে স্টাইলকে ব্যবহার করা বঙ্কিমকে কবি বলছেন, ‘চাঁদ ঝলমল তারা ঝলমল জল ঝলমল। আমার সব গান নদীর বাপের আমল।’ এবার কবিতা গদ্য হয় না বা গদ্য কবিতা হয় না। কবি গদ্যকারের কাছে যায়, গদ্যকারকে কবিতা শোনায়। যেখানে একটা দেশ, একটা নদী আর কিছুটা গা ছমছম পড়ে, মুখ লুকিয়ে থাকে। ঠিক যেমন চোখের ভেতরে একখানি দেশের বাড়ি থেকে। কবি বলেন সেই দেশে একটা শীতকাল থাকে একটা দুধ ভাত থাকে বকফুল থাকে আর থাকে কিছুটা একা হয়ে যাওয়া কবি বলেন ‘একা হতে হতে আর কতটা একা হতে পারো তুমি?’ এই একাকীত্ব ঠিকানা থেকে দূরে চলে আসা শেষে সেই অমোঘ উচ্চারণ, যেখানে ‘শূন্যতা একা নয়।’

কাব্যগ্রন্থ যত  সামনের দিকে এগোচ্ছে রেল সভ্যতার মতো বিজয়ের ভাষা পাল্টাচ্ছে। বিজয় তৎসম শব্দ দিয়ে শৌখিন মায়াজাল বোনেরনি। বিজয়ের লাইন গুলো প্রতিটাই খুব স্পষ্ট এবং ঋজু, সেখানে তৎসম শব্দ ব্যবহার বেশ কম বললেই চলে! যে শব্দ মুখের শব্দ, যে শব্দ মনের শব্দ সেই শব্দ দিয়ে পরপর লিখে যাচ্ছেন। তাঁর কবিতায় কখনো তৎসম ভাব দিয়ে দেশ ভাগ হয় না। দেশভাগ হয় লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ দিয়ে, মা চলে আসেন, ভাতের গন্ধ পাওয়া যায়। চাঁদ উঠে ফুল ফোটে সবই যেন ওপার থেকে বাস্তু ছেড়ে চলে আসা একজন পিতার সন্তান। 

বিজয় ২০১৫ বিজয় লিখছেন ‘জঙ্গল সূত্র’। জঙ্গলসূত্রর ‘আলাদা’ কবিতাটিতে বলা হয়েছে, ‘চোখের জল মোছার জন্য একটা আলাদা কোম্পানি আছে/ চোখের জল তৈরির জন্য একটা আলাদা কম্পানি আছে/ নিম গাছের বাচ্চারা স্কুলে যাবে কিনা এটি জানার জন্য একটা আলাদা দপ্তর আছে/ রেললাইনগুলো কিভাবে গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল এটি জানার জন্য একটি আলাদা দপ্তর আছে!/ কবির স্ত্রী চুল খুলে রাখলে কবিতার লাইন কেন গোপনে বিনুনি বাধে এটার জন্য একটা আলাদা বিভাগ আছে।’ শেষ লাইনে আছে, ‘হাঁটু অব্দি বৃষ্টিপাত হলে কেন সমস্ত প্রবাদ ধুয়ে মুছে যায় এটি জানার জন্য অন্য কিছু নয় একজন আলাদা কবি আছে।’ এই নির্মাণে বিজয় সম্পূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে দপ্তর অফিস কোম্পানি ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে যে নজরদারি রাষ্ট্রের একটা সংজ্ঞা নির্মাণ করেছেন তার শেষ লাইনে বিজয় রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে কার্যত কবির মুখোমখি দাঁড় করিয়েছেন এবং ক্রমে ইতিহাস মুছে দেওয়া এই সভ্যতা এই রাষ্ট্র এর জন্য আলাদা কোন দপ্তর নেই। একজন কবি আছে। কিন্তু সম্পূর্ণ কবিতার মধ্যে কোথাও কোন বিপ্লবাত্মক উচ্চারণ নেই নির্বিকার ভাবে বলে যাওয়া এক সহজ সত্য ভাবলেশহীন ভাবে কবি আছেন রাষ্ট্রের কাছে প্রমাণ করেন বিজয়, আপাত নিরীহ এক সাধারণের ভাষা, বিশেষ বেশি ভাষা। অর্থাৎ কবির রাজনৈতিক বোধ এবং কবিতার রাজনীতি নিয়ে এখানেই বিজয় সফল হচ্ছে। কবি হিসেবে রাষ্ট্রের নিজের অস্তিত্ব কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করে যে কবিতা গুণগতভাবে শৌখিন বিপ্লব চর্চা নয়।

‘কাগা বগা’ কবিতা কী ভাবে যেন স্নেহ মায়া দেশ ও মা সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে এক জঙ্গল ও ভয়ের সামনে। ‘মা কোনদিনও জ্যান্ত বাঘ দেখেনি বাঘের বাচ্চাও দেখেনি। মা কোনদিনও জঙ্গল দেখেনি।’ দেখুন শব্দের প্রয়োগে ‘জ্যান্ত বাঘ’ শব্দটার জান্তব রূপ এবং ‘বাঘের বাচ্চা’ শব্দটির সাথে বিজয় মেশাচ্ছেন জঙ্গল নামক এক আলাদা ভূখণ্ডকে যা ময়ের থেকে অনেক দূরের ভূখণ্ড। এখানে একটি লাইনে বিজয় এরকম ভাবে বলছেন, ‘তো এর মধ্যে একদিন মা ঠিক করে ফেলল।’ লক্ষ্য করার তো কবিতা বলতে বলতে ‘তো’ শব্দটা আবার যেন ওপরের পঙক্তিগুলোর সাথে নিচের কবিতার যে যুক্ত করছেন বিজয়। পাশে বসে যেন কেউ বলছে কাকা বগার গল্প একটা ছায়া হয়ে যাওয়ার গল্প। যে ছায়া নীলফামারীতেও পড়ে জলপাইগুড়িতেও পড়ে। ‘নিমন্ত্রণ’ ‘কবিতায় হাতি তোর পায়ের তলায় কুলের বিচি’ পরের লাইনেই ‘বন্দেমাতরম জঙ্গলের মাথা গরম।’ অর্থাৎ দুটো কথ্য প্রবাদকে বিপুল রাজনৈতিক শুধু নয় ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করা দুটো প্রবাদকে এক জায়গায় আনছেন কি অবলীলায় বিশুদ্ধ রস ও ব্যাঙ্গের ছলে হাতির পায়ের তলায় কুলের বিচি শব্দের পাশে তিনি রাখছেন ‘জঙ্গলের মাথা গরম’  বন্দেমাতরম শব্দটি যেন বঙ্কিম বাবুর আনন্দমঠ থেকে ডুয়ার্সেরজঙ্গল হয়ে যাচ্ছে। মাথা গরম জঙ্গল সবুজ হয়ে উঠছে…

বিজয়ের পঞ্চাশটি কবিতায় বারবার শব্দ পাল্টাচ্ছে। পৃথিবী আরো বেশি গ্লোবাল হয়ে উঠছে, বিজয়ের ভাষা শব্দ সীমা ছড়াচ্ছে কল্পনার হয়ে উঠছে। সমস্ত প্রেডিকশনকে ভাঙতে ভাঙতে যাচ্ছে বিজয়। ১৯৮৫ র ভাষা আর ২০১৫ ভাষা এক নেই। বিজয়ের ভাষা আধুনিক কিন্তু আরবান না। পিউরিটান তৎসম  বিশুদ্ধতার পথে বিজয় হাঁটেননি। বিজয়ের ছত্রে ছত্রে শব্দদ্বৈত এর প্রয়োগ এবং শব্দদ্বৈতকে ভেঙে ফেলার প্রবণতা এক নতুন শব্দ বন্ধের সৃষ্টি করে। পাঠকের পরের পংক্তি কল্পনা করার পরিসরকে ভাঙ্গতে ভাঙতে যায়। যদিও যুক্ত হয় অসামান্য রসবোধ এই রসপদ অনুকরণীয়। অট্টহাসির রসবোধে নয় এর মধ্যে তীব্র শ্লেষ ব্যঙ্গ এবং সমস্ত অদ্ভুতকে মনের সবচেয়ে সরল শব্দ দিয়ে অনুবাদ করে শব্দবন্ধ করে দেওয়া ক্ষমতা বিজয়ের আছে, বিজয় শব্দ জাল তৈরি করেননি।

ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে লেখা হচ্ছে ‘বাবলি বাগান’ সেখানে কবিতা শুরু হচ্ছে, ‘ভ্রমণ শুরু হয় মন থেকে’ কি অনিবার্য সত্য কথাকে বিজয় লিখে গেছেন রিংটোন নামের কবিতায় সম্পূর্ণ রিংটোনের শব্দদ্বৈত শেষ হচ্ছে এদেশে যৌন শিক্ষা …. পুরোটা কবিতা জুড়ে একটা জার্নি লংমার্চের বই রংপুরের কলেজ পাটক্ষেত নতুন কাকিমা ইত্যাদি। সেখানে বিজয় সমাজবিদ্যার প্রবাহমানতাকে ব্যাখ্যা করেছেন শব্দদ্বৈত রিংটোন দিয়ে। যেখানে ভ্রমণ মানসিক এবং যৌনশিক্ষা এদেশে টিং টং ডিং ডং। খেয়াল করলে বোঝা যাবে ২০১৬ নতুন কেন্দ্রীয় সরকার পুনরায় ভোট জিতে আসার পর, নব্য শিক্ষানীতি ঘোষণা করছে (নিউ এডুকেশন পলিসি)। রিংটোন কবিতাটি বলা হচ্ছে আভা বিটি পাস করে জলপাইগুড়িতে টিচারি করতে এসেছে। যেন শিক্ষা ব্যবস্থা, নতুন শিক্ষানীতি, নতুন দিদিমণির চাকরি, যৌন শিক্ষা একাকার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা চেনা জীবনের ছক থেকে ছিটকে যাচ্ছে না  এই চেনা পরিসর বা চেনা পরিসরকে কবিতায় নিখুঁত ভাবে তৈরি করেছেন বিজয় বারবার। কখনো সেটা মফস্বল, কখনো আভা, কখনো বঙ্কিম, কখনো কামরাঙ্গা রঙের পতাকা। দুই দেশের পতাকাতেই কামরাঙ্গা রং উড়ে বিজয় পতাকা হয়ে।

২০১৭ সালে লেখা হচ্ছে ‘কবির স্বপ্ন জ্বলে সাপের মাথায়’। ‘কোজাগর’ কবিতাটিতে কবি বলছেন, ‘মায়ের চোখ লক্ষ্মীর পা।’ ঠিক পরের লাইনে লেখা ‘যৌন চিহ্নহীন ঘর যেমন দরজা তেমনি জানালা আজ ভুলে যাব ঘুম খুলে দেব চাঁদের আকাশ ভরা তালা’। ‘জানো গো ছোট মাসি? ওগুলো কিন্তু লক্ষ্মীর পা নয়। এরা সব আমার মায়ের চোখ। দুপুর জোৎস্নায় ওই চোখগুলো থেকে নাকি গেরস্থের ছেলেপিলে হয়।’ লক্ষণীয় লক্ষ্মীর পা মায়ের সাদা চোখ হয়ে যাচ্ছে। লাইন শুরু হচ্ছে ‘জানো গো ছোট মাসি’ --- আবার সেই আন্তরিক গল্প বলার ঢং, নিখাদ বিশুদ্ধ কবিতার মধ্যে, এমন বিশুদ্ধ বাঙালের গল্প বলা অন্যমাত্রা যোগ করে ‘জানো গো’ শব্দটাই। লক্ষ্মীর পা মায়ের চোখ হয়ে ওঠায় ‘কোজাগর’ নামে কবিতা রচনা হয়। ‘ঈশান কোণের ভালোবাসা’র শেষ লাইনে আছে, ‘হে ঈশান কোণের বাংলা বিকেল বেলা কবিদের এরকম ভালোবাসা হোক।’ এই ‘বাংলা’ শব্দটা বিজয়ের কবিতার ক্ষেত্রে ভীষণভাবে রাজনৈতিক যেখানে বিজয়ের মধ্যে একটা দেশি ‘বাংলা’ অন্তর আছে। যেই বাংলা অন্তর দিয়ে বিজয় একের পর এক বারো কামরা ট্রেনের কবিতা লিখে যান। 

 

‘হাতবোমা’ কাব্যগ্রন্থে কবি লিখছেন ‘দুর্গা হেঁটে গেলে কয়েকটি হলুদ লেখার হাত খসে পড়ল/ লক্ষ্মী হেঁটে গেলে কয়েকটি অজানা পূর্ণিমা যেন/ সরস্বতী হেঁটে গেলে কয়েকটি নির্জন আমলকির অপেক্ষা,/’ ঠিক পরের লাইনেই লিখছেন ‘শ্যামাসঙ্গীত হেঁটে গেলে কয়েকজন রামপ্রসাদ খসে পড়ল।’ কবিতাকে তিনি শ্যামাসংগীত ও কবিকে রামপ্রসাদ দিয়ে দেখেছেন, এই দেখা নিখাদ তৎসম বর্জিত বাঙালি অন্তর দিয়ে দেখা। নভেম্বর কার্নিভালের কবি যেভাবে বাংলা পার্বনকে দেখছেন, কার্নিভাল থেকে পার্বণ শব্দটির অর্থ দূরত্ব ৩১ বছর। সমস্ত রকম আচার লৌকিকতাকে দূরে সরিয়ে দিন বদলের স্বপ্ন বিজয় কবিতার মধ্যে দেখেন নি। বিজয়ের কবিতায় লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ, দুর্গা সরস্বতী --- যেখানটায় দেশভাগ হয় কোজাগরি পূর্ণিমার দিন বা ভোরবেলা, সেখানে বিজয় এড্রেস করেছেন সমস্ত বাংলার জনজীবনকে। শুধুমাত্র কবিতাকে আটকে রাখতে চাননি তাই বিজয়ের কবিতা কখন এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়নি। রাজনৈতিক ভাবে সচেতন বিজয়, কী ভাবে নিজের কবিতাকে রাজনৈতিক কবিতা না করেও সচেতন রাজনীতির  ছাপ রেখেছে, তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অবশ্য পাঠ্য।

২০১৮ সালে লেখা হচ্ছে ‘সকল বৃক্ষের চুমুক’ সেখানে কবির ‘লেজ’ নামক কবিতায় লিখছেন ‘পৃথিবীতে যখন কোন ডানা ছিল না তখন একদিন কথা নেই বার্তা নেই পৃথিবীতে প্রথম তেজপাতা এল’ --- পড়লে বোঝা যাবে কবিতা জুড়ে তেজপাতা উড়ে বেড়ালো, ভেসে বেড়ালো, কবির আহ্লাদের সীমা থাকলো না। কবি এই লেজ দিয়ে কবি ইশতেহার লিখল স্বপ্নকে স্পর্শ করল কবিতাকে আদর করল কিন্তু এই লেজ দিয়ে কখনো আগুন লাগাতে পারেনি। অসম্ভব রাজনীতি সঙ্গে ভালোবাসা ও স্নেহকে একই সঙ্গে স্পর্শ করছে তেজপাতার মতো তুচ্ছ অথচ প্রয়োজনীয় গন্ধময় অনুসঙ্গে সারা কবিতা জুড়ে যেন তেজপাতার গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে। সম্পূর্ণ রাজনীতিগন্ধী হতে গিয়েও, ইশতেহার না হয়ে, আগুন না জ্বালানো স্নেহময় হাত হয়ে উঠছে। যেখানে গানের ক্লাস কবিতায় কবি ৯৪ সালে ‘আগুন দিয়ে আগুন পুড়িয়েছেন’ সেখানে লেজ দিয়ে কোন বানর লঙ্কাকাণ্ড ঘটায়নি। ঈশ্বর এসেছেন এই লেজের দেখাশোনা করতে। সালটা ২০১৮ কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বিতীয়বারের জন্য এনডিএ ক্ষমতায় এসেছে। কবি লঙ্কাকাণ্ড না হওয়ার স্বপ্ন দেখে যাচ্ছেন তেজপাতার মধ্যে দিয়ে, লেজের মধ্যে দিয়ে।

২০১৯ এ ‘টুকটুকি বাড়ি নেই’ কাব্যগ্রন্থে ‘একজন আকাশী রংয়ের বিড়াল’ কবিতায় লিখছেন ‘শুভ্র জোছনা সে বাংলার উত্তর দিক থেকে ভেসে ওঠা একজন দিদিমণি’। লিখছেন, ‘বিড়ালের নিজস্ব কোন আলো নেই।’ ‘বিড়াল’ বারবার করে কবির কবিতায় এসেছে আর সেই বিড়ালের শরীর-মন-রং এক হয়ে যাচ্ছে, কবি আশঙ্কা করছেন এক মাথায় পরা নতুন বাংলা কবিতার জন্মের। কবি বিড়াল থেকে জন্ম দিচ্ছেন এক এক করে বাংলা নিঃশব্দ বাংলা কবিতা।

২০২০ সালে প্রকাশিত,’বৃষ্টি মাতরম্‌।’ বৃষ্টির পাশে জাতীয় স্তোত্র শ্রাবণের মতন ঝরছে আর আশ্বিন আসলে আকাশের নিচে একটি ফুল গাছ হয়ে যাচ্ছে কবি নিজে। মুক্তাসুন্দরী নামটি ঠাকুমার নাম। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন বাদর লাঠিকে ‘অমলতাশ’ বলছেন তখন মুক্তা সুন্দরীও একটি গাছের নাম দিচ্ছেন। নতুন শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে মুঘল সরাইয়ের নাম হচ্ছে ‘দীন দয়াল উপাধ্যায়’। গাছের নাম রাখা চলছে, রাজ্যের নাম রাখা চলছে, মাঠের নাম, ঘাটের নাম, রাস্তার নাম রাখা চলছে।  সারা দেশ জুড়ে যেন চলছে নামকরণের উৎসব। বিজয়-এর আগেই নভেম্বর কার্নিভাল কবিতায় বলেছেন মন্ত্রীপুত্রের নামকরণ উৎসব মিছিলে সামিল হওয়ার কথা। মুক্তা সুন্দরী গাছ হয়ে যায় শেষ লাইনটিতে। কবি বলছে, আশ্বিন মাসের আকাশের নিচে একটা নামহারা গাছ, চাঁদ উঠল ফুল ফুটল কদম তলায় কে? নভেম্বর কার্নিভালের কবি শিশুপাঠ্য ছড়া দিয়ে শেষ করছেন, কবিতা লিখছেন, গাছটির এই প্রশ্নের যেন আর শেষ নেই। রাশিয়া থেকে বাংলার দূরত্ব জানা নেই। সম্ভবত রাশিয়া থেকে বাংলা কোন রেলপথও নেই!

প্রিয় পঞ্চাশের শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘মধুবালা কেবিন’ তার ‘অন্তিম প্রবাহ’। ‘তোমার দ্বারা তো কিছুই হইল না শুধু মধুবালা নিয়াই পইড়া থাকলে তোমার চলতে পারে আমার তো পেট ভরবে না।’ কবি বলছেন, ‘তারপরেই আমার মাকে দেখি গামছার ভেতরে উঠানটাকে পুটুলি করে নিয়ে তিনি বাইরের দিকে দৌড়াচ্ছেন। এই ‘গামছা’, ‘পুটলি’ এবং ‘উঠোন’ শব্দ তিনটি যেন এক অন্তিম প্রবাহের যাত্রা। যে ট্রেন দিয়ে শুরু হয়েছিল, তেরো কামরার একটি ট্রেন, যেখানটায় হুইসেল শাঁখের ধ্বনি হয়ে যায়। স্টিম বয়লারের ইঞ্জিনে যে ট্রেন যাত্রা শুরু করেছিল ‘হে থুতু হে ডাকটিকি হয়ে অরণ্য’ থেকে সেই ট্রেন যেন সমস্ত সীমারেখা মুছে এক পুটুলি ভর্তি উঠান, মা ছেড়ে আসা দেশ, দেশের উপর রেল গাড়ি সভ্যতা --- একটা বিস্তীর্ণ ন্যাড়া মাঠের মত জায়গা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে আরও সামনের দিকে সামনের দিকে। পেছনে পড়ে থাকে একটা কবিতার মত দেশ, স্টিম ইঞ্জিনের রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া বেরোয়।

 

প্রিয় পঞ্চাশ

বিজয় দে

প্রকাশক: এখন ডুয়ার্স

মুল্য: ১৯৫

 

মূল পাতায় যান






















Comments

Popular posts from this blog

সূচীপত্রঃ শারদ সান্ধ্য জলপাইগুড়ি

বাজারি গপ্পোঃ নিঝুম ঠাকুর